মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী


বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির আর কোনো এজেন্ডা ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভূমিকার একটি চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হবেন কিন্তু তাকে ক্ষমতা দেয়া হবে না। তবুও বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছিলেন। ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক মেনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর কাছের লোকদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে জিতে আমি ইয়াহিয়া খানের সব শর্ত ছিঁড়ে ড্রেনে ফেলে দেব।’ আরো বলেছিলেন, ‘সামনে যে যুদ্ধ আসছে তার নেতৃত্ব কে দেবে তা নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক হওয়া দরকার।’

অনেকে নানান অজুহাতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই।’ এটা ছিল পাকিস্তান রক্ষার প্রতিধ্বনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনই আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। বিশ্বের দেশগুলোর কাছে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলতেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়েছিলাম, আমাদের ক্ষমতায় বসার কথা, সেখানে আমাদের বুকে চালানো হলো গুলি। এখন যুদ্ধ করে দেশ স¦াধীন করা ছাড়া আমাদের আর পিছু হটার পথ নেই।’

বিচারপতি চৌধুরীর এই বক্তব্য বিশ্ব বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে ভারতের বাঙালি রাষ্ট্রদূত শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, বাংলাদেশের স¦াধীনতা ঘোষণা করা হলে ভারত যেন আমাদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। এই প্রস্তাবে সম্মত হননি পণ্ডিতজী। মি. ব্যানার্জিকে তিনি বলেছিলেন, ‘মুজিবকে বলবেন, ব্যক্তিগতভাবে কারো অনুরোধে অস্ত্র সহযোগিতা দেয়া যায় না। তিনি যেন এমন রাজনীতি করেন যাতে প্রত্যেক বাঙালি বলে যে আমরা পাকিস্তানে থাকব না, স্বাধীন হব।’

বঙ্গবন্ধু সেভাবেই রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তিনি স্বাধীনতার দ¦ারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তিনি ৬ দফার প্রশ্নে অটল থাকেন। ষাটের দশকে এক গোপন আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু কমরেড মনি সিংহ ও খোকা রায়কে বলেছিলেন, ‘যত দফাই দেন না কেন পাকিস্তানিরা বাঙালির দাবি মানবে না। স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালিদের কোনো গতি নেই।’ বঙ্গবন্ধুর সেই চিন্তা কঠিনতম বাস্তবে রূপ পেল ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায়। বলেছিলেন তিনি, অনির্দিষ্ট কালের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলো। মূলত সেই দিন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সেই দিনই প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ¯েøাগান উঠেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ঘোষণা করেছেন। ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর আগে প্রায় ২৪ দিনের অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মুছে ফেলেন। ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শেখ মুজিব ৩৫টি নির্দেশ জারি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে মানসিকভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেটাই কাজে লেগেছিল। ২৬ মার্চ চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জেনারেল শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বাঙালিরা সশস্ত্র খান সেনাদের মোকাবেলা করে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে। সেখানে বাঙালির রক্ত ঝরে, বাঙালিরা জীবন উৎসর্গ করে। আর চট্টগ্রামে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছে বাঙালিরা তার বীরত্বপূর্ণ ঘটনা লিখে রেখেছেন সত্যেন সেন তার ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ বইতে। বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। মেজর জিয়াউর রহমান তার উপরের র‌্যাঙ্কের অফিসার হওয়ার সুবাদে বারবার বাধা দিয়েছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আগাম আক্রমণ করতে। ওই হুকুম অমান্য করেই মেজর রফিক ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করেন এবং তাদের আটক করেন। তখন জিয়া যাচ্ছিলেন সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে তার বস পাক সেনা অফিসার জানজুয়ার নির্দেশে।

বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থী ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। মেজর জিয়া ও মওলানা ভাসানীও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তারা দু’জনই ভারতবিরোধী রাজনীতি করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবদান অসামান্য। বঙ্গবিবেক আবুল ফজল বলেছেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার জন্য আমরা বাংলাদেশের বাইরে কারো কাছে যদি এককভাবে ঋণী হয়ে থাকি, তাহলে তিনি হচ্ছেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ দুঃসাহসী ও দূরদর্শিনী মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতা শুধু যে বিলম্বিত হতো তা নয়, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্গতিরও সীমা থাকত না। মাত্র ন’ মাসে যে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি তার প্রধান কারণ ভারতের হস্তক্ষেপ। সে হস্তক্ষেপ মানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। এ যুগের বিশ্ব-ইতিহাসের এক অসামান্য নারী।’ (শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি, আগামী-সংস্করণ, ১৯৯৭,পৃ. ১০)।

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার এক কলামে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ৬/১২/১৬ তারিখে দৈনিক সমকালে তার কলামটি প্রকাশ পেয়েছে। নাম ‘বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও মার্কিন বিরোধিতা’। ১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর শ্রীমতি গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে নিক্সন প্রশাসনের নোংরা আচরণের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ড. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উল্লেখ করেছেন, ‘ওই দিন তিনি নৈশভোজে বলেন, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তিনি ৩৬ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন। ৩৭৫টি মিটিং করেছেন এবং বিভিন্ন দেশে সাড়ে তিন লাখ সম্মানিত নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তিনি এখানে এসেছেন শান্তির প্রত্যাশায়।’ এরপর ড. সাইয়িদ বলেছেন, নিক্সন শ্রীমতি গান্ধীকে ‘ডাইনি’ বলে গালি দিয়েছেন। তার মেধা, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্যশীলতা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কাজে লেগেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শ্রীমতি গান্ধী তার শুভ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন একজন মহীয়সী নারীকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জঘন্য ভাষায় অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তিনি এখনো বাংলাদেশে যথার্থ স্বীকৃতি পেয়ে ওঠেননি। অনেক বিবেক খরচ করে তিনি ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি ওই উত্তেজিত মুহ‚র্তেও পা গুনে গুনে চলেছেন। সংযত ভাষায় কথা বলেছেন, মার্জিত আচরণ করেছেন। এটা তার অত্যাশ্চর্য কৌশল যে তিনি ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগাম আক্রমণের উস্কানি দেননি। পাকিস্তানই আগে ভারত আক্রমণ করেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের আস্ফালনের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমাদের দুঃখ এই যে, পাকিস্তান চূড়ান্ত মূঢ়তা প্রকাশ না করে ছাড়ল না, এবং দুঃখ এই যে, উপমহাদেশে যখন সবচেয়ে বেশি দরকার উন্নয়নের, তখন ভারত এবং পাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের ভেতর ঠেলে দেয়া হলো। আমরা প্রতিবেশীর মতো বসবাস করতে পারতাম কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কখনো এ কথা বলারও সুযোগ হয়নি।’

(ড. প্রেমেন আড্ডি- ইন্দিরা গান্ধী, অনুবাদ-সঞ্চিতা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০০৮,পৃঃ ১০)।

মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।

SUMMARY

1728-B12.jpg