ডিসেম্বর : ১৯৭১ থেকে ২০১৬


সময় খুব দ্রুতই যাচ্ছে। অনেক হিসাব-নিকাশ আমাদের সামনে। ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। গৌরবের মাস এই ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ৪৫ বছর পার করে দিল। অর্জন নেই তা বলা যাবে না। কিন্তু আরো অনেক কিছুই হতে পারত। হয়নি। একটি কালো শক্তি গলা চাপা দিতে চেয়েছে এই জাতিকে বারবার। বহুবার। একটি জাতির জীবনে এমন উল্লেখযোগ্য সময় কয়েকটি মহাকাল পরই আসে। বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশমাতৃকার জন্ম তেমনি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৭১ থেকে ২০১৬ সময়ে তাই এর মূল্যায়ন দরকার। এই বয়সে একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি কতটা পূর্ণতা পেতে পারে তা নিয়ে কথা চলতে পারে পক্ষে-বিপক্ষে। কিন্তু পাওয়ার ঝুড়ি যদি তুলনামলক শূন্যের কোটায় থাকে, তবে সে দুঃখবোধ হয়ে পড়ে হৃদয়বিদারক। বাংলাদেশের বেশ কিছু ক্ষেত্রে তেমনটি হয়েছে।

সাড়ে চার দশক সময়ে বাংলাদেশে প্রধান দুঃখবোধটি হচ্ছে মানুষের ন্যায্যতা ও সুশাসন। যার ফলে যে চেতনা নিয়ে রাষ্ট্রটি বিজয়মাল্য পেয়েছিল তা রোদনে পরিণত হয়েছে অনেকভাবে। একটি রাষ্ট্র কাঠামো উঠে দাঁড়ানোর আগেই তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে অত্যন্ত জঘন্যভাবে। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল সেই পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা।

১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ যারা তোলেন এটাও তারা খুব ভালো করে জানেন পাকপন্থী একটি সনাতনী ব্যুরোক্রেসি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার চালানো ছিল দুরূহ কাজ। সমন্বয়ের অভাব, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নিষ্পেষণ, দেশি বেনিয়া গোষ্ঠীর তীব্র অসহযোগিতা চুয়াত্তরের মন্বন্তরকে কাগুজে বাঘে রূপান্তরিত করে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাসন্তীকে ‘জাল’ পরিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম করা হয়, যা পরে প্রমাণিত হয়েছে। বাহাত্তর-পরবর্তী সময়ে ঘনীভূত রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার বিরোধিতার নামে হঠকারী সিদ্ধান্ত পরাজিত রাজাকারদের ভাগ্য ক্রমেই খুলে দিতে থাকে। পাকপন্থী সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে ঘটানো হয় পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক। এরপর কারা কীভাবে ক্ষমতায় এসেছে এবং কী করেছে, এদিকে নজর দিলেই বোঝা সহজ হবে পরাজিত রাজাকারদের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল। পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নানা ভেকভণিতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের লেবাসে তিনি আলবদর-রাজাকারদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করেন। এমন হীন অপকর্ম তিনি কিছুই বাদ রাখেননি, যা তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য দরকারি ছিল। সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলেও তার জারি করা ফরমানের ফলে রাজাকাররা স্থায়ী আসন গেড়ে নিতে সমর্থ হয়। এরপর সামরিক জান্তাতন্ত্র চলতে থাকে ওই একই ধারাবাহিকতায়। জাতীয়তাবাদের ‘বাংলাদেশী’ সংস্করণ যা শুধু ক্ষমতা দখলের মুখ্যমন্ত্র হিসেবেই কাজে লেগেছিল, তারই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রণয়ন করেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ। এর পরের দশকটি বাঙালি জাতিকে কাটাতে হয়েছে স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে। নূর হোসেনকে শহীদ হতে হয়েছে রাজপথে, স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক এ ¯েøাগান বুকে-পিঠে লিখে। নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে জনগণকে। ডা. মিলনের খুনিরা মিশে গেছে, রাজনীতির কাফেলায়। সুদীর্ঘ আন্দোলন, ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে নিপাত যায় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। যৌথ গণতান্ত্রিক উদ্যোগে প্রণীত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা। ১৯৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। জনগণকে বলা হয়, আমরা গণতন্ত্রের পথেই এগিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯১-৯৬ সময়কালীন সরকার বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং মৌলবাদের গোড়াপত্তন শুরু করে। জে. জিয়ার রাজাকার পুনর্বাসন প্রকল্পের এক্সটেনশন হিসেবে জঙ্গিতন্ত্রের বীজ রোপিত হতে থাকে বাংলার নরম মাটিতে। গ্রামাঞ্চলে এরা গড়তে থাকে দুর্গ। দুর্নীতিবাজদের চরম দাপটের গালে চড় বসিয়ে জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আনে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে। ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সবার সঙ্গে ক্ষমতা শেয়ার করার মানসে জাসদ একাংশের আ স ম আবদুর রব এবং জাতীয় পার্টির একাংশের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব দেন। কিন্তু থেমে থাকেনি রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবানরা দু-দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিজেদের দখলে রেখে চালাতে থাকেন ক্ষমতার ত্রাসতন্ত্র। দেশটি শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় স্থান পেতে থাকে। অন্যদিকে মৌলবাদী জঙ্গিরাও সংগঠিত হতে থাকে তলে তলে। আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা ঘাতক-রাজাকারদের বিচারের ব্যাপারে আগে সোচ্চার থাকলেও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তারা তা বেমালুম ভুলে যান বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জামায়াতিদের সঙ্গে আওয়ামীপন্থিরা অনেক জয়েন্টভেঞ্চার ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে তোলেন। এসব ফিরিস্তি দেশবাসীর অজানা নয়।

ফলে আবারো পতন ঘটে আওয়ামী লীগের। দেশের জনগণ ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংসদে নিয়ে আসে। তারা ক্ষমতায় বসে। ২০০১ থেকে ২০০৬ এ সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায়। পুরো দেশটিকেই ক্রিকেট খেলার মাঠে পরিণত করে জোটের নেতা-মন্ত্রীরা। প্রধানমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় তার পুত্রদ্বয় তারেক-কোকো হয়ে ওঠে দেশের সর্বোচ্চ নেপথ্য নীতিনির্ধারক। সবকিছুকে ‘ডেম কেয়ার’ করে গণভবনের আদলে গড়ে ওঠে প্যারালাল হাওয়া ভবন। দেশ পরিণত হয় জঙ্গিদের লীলাক্ষেত্রে। যত্রতত্র বোমা ফুটতে থাকে। আক্রান্ত হতে থাকেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা। আদালত প্রাঙ্গণ ভেসে যায় রক্তে।

এই নির্মমতম ঘটনাগুলোর নেপথ্য কাণ্ডারি ছিল সেই পরাজিত রাজাকার শক্তি। যারা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ পরিকল্পিতভাবে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। এই ঘাতকদের উত্তরসূরিরাই কবি শামসুর রাহমান, ড. হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করেছিল, তা পরে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে। শুধু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে তাদের গডফাদার রাজাকার পাষণ্ডরা। এভাবেই বাংলাদেশের একটি ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেশে ঘটে যায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের অবকাঠামো। এই সময়ে বিচারের মাধ্যমে দুই প্রধান জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলাভাইকে ফাঁসি দেয়া হয়। প্রশ্নটি হচ্ছে এই দুই জঙ্গিকে ফাঁসি দেয়ার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদকে কি বাংলার মাটি থেকে সমূলে বিনাশ করা গিয়েছিল? না- যায়নি, বলেই হলি আর্টিজানে আমরা দেখেছি রক্তবন্যা।

৪৫ বছরের বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে মৌলবাদের প্রসার। মৌলবাদ দমনে বিশ্বের নীতিনির্ধারকরা প্রকৃতপক্ষে আন্তরিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, মৌলবাদ সব সময়ই সামন্তবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে ভেঙে খান খান করে দিতে পুঁজিবাদীরা এটাকে ব্যবহার করেছে। এমন কি গোত্রগত সংঘাত চাঙ্গা করে রাখতেও ব্যবহৃত হয়েছে মৌলবাদী দানতন্ত্র। তবে কি পরোক্ষভাবে গণতন্ত্রই মৌলবাদের সহচর? আসতে পারে সে প্রশ্নটিও। দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার নামে কোনো কোনো দেশে মৌলবাদকে উসকে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- এটাও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পুঁজিবাদীরা একে ব্যবহার করেছে তাদের প্রয়োজনে। পরে দেখা গেছে, এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে বিষবাষ্প। দূষিত হয়ে গিয়েছে ক্রমশ! গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষের নিঃশ্বাসের আবাসস্থল। বাংলাদেশে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে তা করতে হচ্ছে এই কালোশক্তিকে মোকাবেলা করে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকছে ক্ষমতাসীনদের কারো কারো দখলদার মনোবৃত্তি। এদের কি সরকারপ্রধান দেখছেন না? এরা যে সরকার ও দলের জন্য খুব ভয়ঙ্কর- তা কি সরকারপ্রধানের অজানা?

ডিসেম্বর এলেই আমার যে কথাটি খুব মনে পড়ে তা হলো আমরা একটি শান্তির দেশ চেয়েছিলাম। কেমন আছেন এই দেশের সাধারণ মানুষ? খবর বেরিয়েছে- মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হককে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো ও গ্রেপ্তারের দাবিসহ সারা দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন শেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান আদিবাসী পার্টির নেতা-কর্মীরা। সেখানে তারা বলেছেন- ‘স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও সরকার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে, নির্দোষ রসরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন বলছে রসরাজ নির্দোষ। তারপরও তার জামিন হচ্ছে না। গাইবান্ধায় সাঁওতালদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সরকার ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সেখানে জনপ্রতি ছয় হাজার টাকা করে অর্থ সাহায্য করলেও তাদের ৩০০ পরিবারের বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়নি। তারা অসহায় জীবনযাপন করছে।’ এর মাঝেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- দেশের আর্থ-সামাজিক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দরকার। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। সেই বাংলাদেশ আজও চায় প্রজন্ম। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এর বিকল্প নেই। কারণ একটি রাষ্ট্রের মৌলিক শক্তি হলো সেই জাতির বিশ্বাস ও প্রত্যয়। এই ডিসেম্বরে সে কথাটি আমি আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই।

ফকির ইলিয়াস : কবি ও সাংবাদিক।

SUMMARY

1727-1.png