পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন, যার প্রধান রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য অধ্যায়টি ছয়দফা ও ১১ দফার। পরের অধ্যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনী রায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে বাঙালি জনতার অভূতপূর্ব জেগে ওঠা, যারও মূল নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর এবং শেষটি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্বিচার গণহত্যা শুরুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তাঁরই আহ্বানে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার শেষ অধ্যায়ের নায়ক, যার হাতে জাতীয় ইতিহাসের সুবিশাল কর্ম সম্পাদিত হয়েছে। এই সরকারের শীর্ষ নেতারা প্রায় সবাই স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশের জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে প্রায় সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক মাসের মাথায় মুজিবনগর সরকারের চার শীর্ষ নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল পরিকল্পিত, যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রের ইতিহাসকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। সৌভাগ্য যে, শেষ পর্যন্ত তারা পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেনি। প্রায় দুই যুগের অবৈধ দখলদারির পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঐতিহাসিক আধিপত্য সদর্পে ফিরে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন সামরিক ও বেসামারিক কর্মযজ্ঞের পুরোধা ব্যক্তিরাও। তবে কেউ কেউ আজো আছেন, যারা সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী এবং যাদের হাতে সময়ের প্রয়োজনে নানা ঐতিহাসিক কর্ম সম্পাদিত হয়েছে। সেদিনের তরুণ ব্যারিস্টার এবং এমএনএ, আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের ১৯৭১-এর অন্যতম হুইপ, বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য এম আমীর-উল ইসলাম তাদেরই একজন। প্রবাসী সরকারের অন্যতম মুখ্য কর্মকর্তা হোসেন তৌফিক ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী এবং খন্দকার আসাদুজ্জামানসহ আরো কয়েকজন আছেন, যারা যুদ্ধকালীন সরকারের বিশেষ চালিকাশক্তি ছিলেন।
এ লেখাটি একজন ঐতিহাসিক মানুষের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা। কারণ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে তার জীবনের ৮২ বছর পাড়ি দিচ্ছেন। আশি বছরের ওপরে উঠে কর্মক্ষম থাকা সবার ভাগ্যে জোটে না। কিন্তু সদা কর্মচঞ্চল ব্যারিস্টার আমীর ব্যতিক্রম। এ বয়সেও দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আইন পেশার শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম তিনি। প্রখর মেধা ও বিবেকসম্পন্ন এই মানুষটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বর, যাকে দেশবাসী আলাদা করে ভাবতে শিখেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই অস্ত্র ছেড়ে আমি সাংবাদিকতা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হই। অনেকের মতোই আমিও ইতিহাসের পক্ষ ধারণ করি, পঁচাত্তর ও একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই। ফলে ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক এবং বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে আমাকে বিতাড়িত করে। শুরু হয় ব্যক্তিজীবনের আরেক বড় লড়াই। আশ্রয় নিতে হয় আইনের। দীর্ঘ সেই আইনি লড়াইয়ের সুবাদে অনেক বছর ল’ এসোসিয়েটে যাতায়াত করেছি। বলাই বাহুল্য, আমার সেই লড়াইয়ে পরিপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার, সেদিনের বিজ্ঞ আইনবিদ ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে, যিনি ল’ এসোসিয়েটের আইনজীবী হিসেবে আলোচিত মামলাটির ‘ফাইলিং এডভোকেট’ হয়েছিলেন। কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরকে, যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অশেষ যতেœ মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক পেশাজীবীর প্রতি সরকারি অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছেন তারা সবাই।
ছোট পরিসরের এই লেখাটিতে ব্যারিস্টার আমীরের কর্মজীবন নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠজন। প্রথম সরকারের গঠন ও পারিচালনার ওপর গবেষণা চালাতে গিয়ে দেখেছি, ঢাকা থেকে ভারতের মাটিতে পাড়ি দেয়ার বিপদসংকুল পথে ব্যারিস্টার আমীর ছিলেন জনাব তাজউদ্দীনের মূল সহচর। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে নতুন দিল্লি পৌঁছান। সেদিনও কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত তার সফরসঙ্গী ছিলেন আমীর-উল ইসলাম। এই তরুণ ব্যারিস্টারের হাতেই লেখা হয় তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণ, যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১। তার হাতেই রচিত হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’, চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল আইনি ভিত্তি।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের ঐতিহাসিক শপথ নেয়ার অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ব্যারিস্টার আমীর এবং সেদিনকার এমএনএ আব্দুল মান্নান। সময়ের নানা জরুরি কাজ সম্পাদনের পর এরা দুজন কলকাতা প্রেসক্লাব থেকে ১৬ এপ্রিলের শেষ রাত ও ১৭ এপ্রিল ভোরবেলায় শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক নিয়ে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আসেন। অনুষ্ঠান আয়োজনে আরো বিশেষ ভূমিকা রাখেন তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন আহমদ ও সেদিনকার মেজর (পরবর্তীতে লে. কর্নেল) সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী।ইতিহাসের সব অধ্যায়ই অমোচনীয়, যদিও পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহে কিছু কিছু অধ্যায় দূরে সরে যায়, বা রাখা হয়। এমনও হয় যে, কেউ কেউ সময়ের সংঘাতে জড়িত হন কিংবা শিকার হন সময়ের। কিন্তু সত্যিকার ইতিহাসকে রক্ষা করাই জাতির বড় লাভ।
জন্মদিনে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। প্রত্যাশা করি কর্মক্ষম থাকুন তিনি আরো বহুকাল।
হারুন হাবীব : সাংবাদিক, লেখক।