ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা


২৪ জানুয়ারি পালিত হলো ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক মাহেন্দ্রক্ষণ এবং যুগান্তকারী ঘটনা। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের এই দিনে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক লৌহমানব আইয়ুব খানের পতনকে তরান্বিত করেছিল। এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল আর তা হচ্ছে ঐক্য। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে ঐক্য অনৈক্যের ওপর বিজয় অর্জন করে। ১০ জন ঐক্যবদ্ধ লোক ১০০ জন ঐক্যহীন লোকের সঙ্গে বিজয়ী হয়। এ চিরন্তন সত্যটি হাজার হাজার বছর আগেও সত্য ছিল হাজার বছর পরেও সত্য হবে। পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন, বৈষম্যমূলক শাসননীতি, অন্যায়, অবিচার ও অশান্তি এবং ধর্মীয় বিভেদ-বিভাজন বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাঙালি জাতি। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতার ফসল ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থান সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে ছয়দফা প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে এবং ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।

২০ জানুয়ারি বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ নিহত হলে স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিন দিনের মাথায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর নিহত হলে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন হয়। এই গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, কাজ ও নির্দেশনায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে স্ত্রী-পুত্র, পরিবার, সহায় সম্পত্তি ত্যাগ করে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্য্যুদয় ঘটায়। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের ৪৮ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও এর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। কিন্তু পরবর্তী ৪৬ বছর এই জাতিকে আর ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়া হয়নি। বরং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মতবাদের ওপর গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল এবং ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি, দাঙ্গা, বিদ্বেষ এবং ধর্মের অপব্যবহারের কারণে জাতি আজ সার্বিকভাবেই অনৈক্য, সংঘাত এবং হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি আমাদের দেশের ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি তাকে ভুল খাতে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার, অপরাজনীতি এবং জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেছে। এই ধর্মব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য প্রতিপক্ষকে মুরতাদ, কাফের ফতোয়া দিয়ে বিধ্বংস এবং অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে তাণ্ডব, গত বছর ১৪ মার্চ নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ীর পোরকরা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকদের ধর্মীয় উন্মাদনার ভয়ঙ্কর তাণ্ডব, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা চালানো হয়েছে। ঐক্যহীনতার কারণে আমাদের চেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ইরাক, সিরিয়াকে কীভাবে ধ্বংস করে দেয়া হলো। সেখানে না আছে কোনো বংশ পরিচয়, ধর্ম পরিচয় ও পার্টির পরিচয়; কিছুই নেই। আমাদের এই জন্মভূমি আজ গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। একদিকে অনৈক্য, জঙ্গিবাদ ও রাজনীতিক হানাহানি এবং পক্ষান্তরে সা¤্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। তাই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সব অনৈক্য ও বিভেদ ভুলে আল্লাহর তওহীদের ওপর ১৬ কোটি মানুষের ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ে তুলতে হবে।

মোহাম্মদ ইয়ামিন খান
হাবেলী, গোপালপুর, ফরিদপুর।

SUMMARY

1725-B2.jpg