বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-মাহমুদুল বাসার

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-মাহমুদুল বাসার

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন ৮ জানুয়ারি। পৌঁছেছিলেন তিনি লন্ডনে। উঠেছিলেন লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে। তাঁর শরীর যথেষ্ঠ দুর্বল ছিল, কাঁপছিলেন তিনি। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে বিদায় জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ সময় ১২টা ৩৫ মিনিটে লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়। হিথ্রো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, আমি বেঁচে আছি। আমি সুস্থ রয়েছি।’

বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন থেকে ক‚টনীতিকরা বিমানবন্দরে ছুটে এসেছিলেন। বিবিসি নির্ধারিত অনুষ্ঠান প্রচার স্থগিত রেখে বঙ্গবন্ধুর আগমনের ওপর বিশেষ বুলেটিন প্রচার করতে থাকে। দলে দলে লোক লন্ডনের রাজপথে নেমে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর আগমনের ওপর লন্ডনে এদিন বিশেষ টেলিগ্রাফ পত্রিকা সংখ্যা প্রকাশিত হয়। হিথ্রো বিমানবন্দরে শ্রমিক দলনেতা ও পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা মি. হ্যারল্ড উইলসন সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। হোটেল ক্লারিজেসে আগত বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকের সামনে তিনি ইংরেজিতে বিবৃতি পাঠ করে শোনান। সারগর্ভ, ওজোগুণসম্পন্ন এই বিবৃতির প্রতিটি কথা মূল্যবান। বলেছিলেন, ‘‘আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি।” বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, ‘জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। যেখানে আমাকে তারা কোনো রেডিও, কোনো চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা জানতে দেয়নি।’

১০ জানুয়ারি ১৯৭২, সকালে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছেছিলেন। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি ডি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। পালাম বিমানবন্দরের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়। অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল, আর আজ যখন তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী।’

বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন। রাষ্ট্রপতি ভবনেও যান। দিল্লির জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রথমে ইংরেজিতে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শ্রোতাদের অনুরোধে পরে বাংলায় বলেন। ১০ জানুয়ারি অপরাহ্ণে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দর জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়। অতিকষ্টে জাতির জনককে একটি খোলা ট্রাকে তোলা হয় এবং বিমানবন্দর থেকে সারা পথ প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্য দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে আসতে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রাকটির প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল।

বিউগলে বেজে উঠল জাতীয় সঙ্গীত। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে এক করুণ মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়। বঙ্গবন্ধু দুহাতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে জড়িয়ে একই দৃশ্যের অবতারণা। জেনারেল (অব.) ওসমানীকে জড়িয়ে ধরলেন, উপস্থিত যুব ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে ৩ ঘণ্টাব্যাপাী সাঁতার কেটে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছেন। ৫০ লাখের অধিক জনসমাবেশের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেলেন। তিনি সেদিন এতই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে, বক্তৃতার মধ্যে কয়েকবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি মর্মস্পর্শী। (সূত্র-রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী-৭১-এর দশ মাস)।

বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ঐতিহাসিক ভাষণ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পদযাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ঘটে গেছে। ওই অগ্নিগর্ভ ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি শত্রু অধিকৃত দেশে, স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার অব্যর্থ লক্ষ্য সামনে রেখে। আর ১০ জানুয়ারির ভাষণটি দিয়েছিলেন তিনি বিজয়ী জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে, রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশলে।

এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পরে সংবিধান রচনা করার সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ যুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে রাষ্ট্রের নীতিমালা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষণা করার কারণে। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র হয় না। পৃথিবীতে ধর্মভিত্তিক কোনো রাষ্ট্র নেই। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম নেই। জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ- এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন- এই তিনটি রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এরা কেউ মুসলিম রাষ্ট্র নয়। উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান লেখক মীর মশাররফ হোসেন বলেছেন- তার ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থে, ‘রাজচক্র ধর্মের মতো সরল জিনিস নয়, তার ভেদ বুঝা মুশকিল।’

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে ১০ জানুয়ারিতে আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম এবং ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তি হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা।’

বঙ্গবন্ধু যে ইসলামের ন্যূনতম অবমাননা চাননি, ১০ জানুয়ারির ভাষণে তার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকদের মতো আর কেউ যেন ইসলামকে শোষণের হাতিয়ার করতে না পারে। বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারির ভাষণটি ছিল সব দিক থেকে বাস্তবতানির্ভর ও দিকনির্দেশনামূলক। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, কিন্তু নির্ভুল বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, ‘গত ২৫ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে বর্বর হানাদার বাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্যমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল সুষ্ঠু তদন্ত করুক। জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে, তার ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ করা।’

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় সম্পূর্ণ হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর সঙ্গে থাকতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা, সান্ত¡না ও বিপ্লবের প্রতীক। তার বজ্রকণ্ঠের বৈপ্লবিক আহ্বানে বাঙালি স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মোৎসর্গ করেছে, উৎসর্গ করেছে ত্রিশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ। আজ পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ এক আদর্শ সংগ্রাম ও গৌরবের প্রতীক। এই প্রতীকে মূর্ত হয়ে আছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। (রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী-৭১-এর দশ মাস, পৃ. ৭৭১)।

মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।

SUMMARY

1723-B7.jpg