‘ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে’; ‘এসো বাংলার স্বাপ্নিক, স্বাগতম’; ‘ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়’; ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’; এসব ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনাম। রবীন্দ্রনাথ যে মহামানবের উত্থানের স্বপ্নময়তার আবেশে তাঁর কবিতার পরতে পরতে আবির মাখাতেন; সেই মহামানব যেন মহাসমুদ্রের কল্লোল নিয়েই এদিন স্পর্শ করেছিল ঢাকার রাজপথ। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন-সাধ স্বাধীনতার সূর্য যিনি এনে দিয়েছিলেন এ ভূখণ্ডের আকাশে, অনাগত কাল থেকে লড়ে যাওয়া সংগ্রামের জিয়নকাঠিতে যিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন বঞ্চিত-নিপীড়িত বাংলার মানুষকে, যিনি বিশ্বকে জানিয়েছিলেন বাঙালি লড়তে জানে, মৃত্যুর সমুদ্রকেও পরোয়া করে না, গণমানুষের ওপর ভর করে যিনি সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে বাংলাদেশকে বিজয়ী করেছিলেন, লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল সবুজের পতাকা যিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন ৫৬ হাজার বর্গমাইল; সেদিন তাঁর ফিরে আসার দিন। ১০ জানুয়ারিতে পিতার ফিরে আসা তাই আমাদের স্বাধীনতা আর বিজয়ের পূর্ণাঙ্গতার তুলির আঁচর।
বোয়িং ৭০৭ যখন ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে, সে সময়টাতেই যেন জীবন ফিরে পায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষও। তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কা ছিল; ফাঁসির কাষ্ঠেও তিনি অপেক্ষমাণ ছিলেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যে শুধু তাঁর স্বদেশবাসীরই ছিল, এমনটি নয়। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র-মানবিকতা-ন্যায়বিচার-স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল প্রত্যেকটি মানুষ সমাবেশ, মিছিল, লেখালেখি, প্রতিবাদের মাধ্যমে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার মুক্তির জন্য সোচ্চার হয়। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিও তাই বীরোচিত। সকাল সাড়ে ৬টায় বিমানটি যখন হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছায় সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। খবর পেয়ে তিনি দ্রুতই চলে এলেন, দেখা করলেন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া এক রাষ্ট্রের স্থপতির সঙ্গে। আরো দেখা করলেন বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসন, পার্লামেন্টের অনেক সদস্য, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতা নিয়ে দরকষাকষির প্রশ্নই ওঠে না। আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’ করতালিময় সংবাদ সম্মেলন যেন পরিণত হয়েছিল বিমুগ্ধ, মুখরিত জনসভায়; জাতীয়তাবাদী-স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বিশ্বকে আবারো জানিয়ে দিলেন তাঁর আপসহীন উচ্চারণ। ১০ জানুয়ারি সকালে বিমান পৌঁছালো দিল্লির পালাম বন্দরে। সে সময়ের বিবরণ দিয়েছেন সহযাত্রী ফারুক চৌধুরী এভাবে- “ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন, পিনপতন নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে আছেন সহাস্য, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করলেন আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ- ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন আবেগের অশ্রæতে ঝাঁপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি ভি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্যরা, ক‚টনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় দুপাশের লাখো জনতা।”
লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট বিমানটি তেঁজগাওয়ের মাটি স্পর্শ করে বিকেল ৩ টায়। একুশবার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের উল্লসিত চিৎকারের মধ্য দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিল। ঢাকার রাজপথ যেন গেয়ে উঠল সুরে সুরে “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী/ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে/তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে!” আহমদ ছফা বলেছিলেন, মুজিব আর স্বাধীনতা দু’টি যমজ শব্দ। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন, ৬ দফা, গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শীর্ষক কালজয়ী ভাষণ, ২৩ মার্চে পতাকা উত্তোলন, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালি জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানে কারাবন্দি থাকা পর্যন্ত বাঙালির লড়াইয়ে, অস্তিত্বে, রণকৌশলে, অনুপ্রেরণায় তিনি কীরকমভাবে মিশে ছিলেন তার প্রমাণ মেলে হুমায়ুন আজাদের লেখায়- ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়টি ভরে তিনিই ছিলেন নিয়ন্ত্রক ও প্রেরণা, তিনিই ছিলেন, এক অর্থে, মুক্তিযুদ্ধ। সমগ্র বাঙালির রূপ ধরে তিনিই করে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাই ছিল মুজিবের দ্বিতীয় সত্তা।’ তাঁর প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক সে ক্ষণে বাঙালির হৃদয় থেকে তাই উৎসারিত হয়েছিল- ‘বাংলাদেশের অপর নাম, শেখ মুজিবুর রহমান’। লাখো শহীদের রক্ত ভেজা সবুজ শ্যামলা বাংলাদেশে ‘রক্তের দাগ না শুকাতে শুকাতে’ই ফিরে এলেন পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া সদ্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জনক। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছতে সেদিন তাঁর সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। নিজেকে বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল বলা রাজনীতির মহাকবি সেদিন অশ্রæসিক্ত হয়েছিলেন সংগ্রামী জনতার ভালোবাসার পরশে। পুরো পথ জুড়ে, কখনোবা জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে সেদিন তাঁর জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছিল ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী।
স্লোগানকম্পিত সেদিনের রেসকোর্স বঙ্গবন্ধুর কান্নাজড়ানো কণ্ঠ শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার বক্তব্যের পরতে পরতে ছিল বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা। দুই চোখে গড়ানো অশ্রæ মুছে মুছে শতাব্দীর মহানায়ক, বাঙালির মণিকোঠায় যার চিহ্ন যিনি অপরাজেয় করে চিরদিনের জন্য এঁকে দিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু জনতাকে সাক্ষী রেখে বললেন, ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি, বিশ্বকবি তোমার সেই আক্ষেপ মিথ্যা প্রমাণিত করে সাত কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে।’ পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র তখনো শেষ হয়নি, তাদের হুঁশিয়ারি করে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না।’ বিজয়ীর বেশে জনতার কাছে ফিরে আসার আহ্বানেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, কেমন বাংলাদেশ চাই আমাদের, আমাদের রাষ্ট্রের লক্ষ্য কি, স্বাধীনতাকে আমরা কিভাবে মর্যাদা দিতে পারি, নাগরিকদের করণীয় কি। জননায়ক সেদিনও প্রমাণ রাখলেন রাষ্ট্রনায়কের দূরদর্শিতার মধ্য দিয়েই তিনি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, লাখো শহীদের স্বপ্নের প্রতিফলন নিশ্চিত করবেন। তাঁর উচ্চারিত ‘মরে যাব, তবু বাংলার স্বাধীনতা হারাব না’ যেমন গেঁথে গিয়েছিল বাঙালির হৃদয়ে, তেমনি জবাব দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে, যারা তখনো মনে করেছিল আমাদের স্বাধীনতার সৌধ তারা গুঁড়িয়ে দেবে। বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাবন্দি থেকেছেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় ক্যান্টনমেন্টে বন্দি শেখ মুজিবকে মুক্তির জন্য ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে আওয়াজ তুলেছিল, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ এ যেন ছিল বাস্তিল দুর্গের পতনের হুঙ্কারের মতো। প্রতিবারই তিনি ফিরে এসেছেন অসম সাহসিকতায়, মানবিক বীরত্বে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি বন্দি ছিলেন লায়াল আর মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন সেলে। বন্দি মুজিব কত শক্তিশালী তাঁর প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়। কিন্তু এবারের ফিরে আসা একেবারেই মৌলিক; প্রথমবারের মতো তিনি বন্দি ছিলেন দেশের আলো-হাওয়ার বাইরে। আবার ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া’ তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় প্রত্যাবর্তন করলেন প্রথমবারের মতোই। ইতিহাসের কক্ষপথে ১০ জানুয়ারি তাই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বাংলাদেশের ‘আলোক-ঝরনাধারা’।
বিপর্যস্ত-ভঙ্গুর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি নির্মাণ করে চললেন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, প্রগতিশীল সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-রাজনীতি গঠন, দালাল আইন প্রণয়ন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেশে ফিরে যাওয়া, অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা, গণমুখী শিক্ষা-স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কৃষক-শ্রমিকের জীবনের মানোন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশের মধ্য দিয়ে নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যখন তার গতিময় যাত্রা নিশ্চিত করেছে; সে সময়ই বাঙালির জাতীয় জীবনের ট্র্যাজেডি হয়ে আসে ১৫ আগস্ট। বেদনার এ মহাকাব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন আর লক্ষ্যকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে প্রতারণা করে স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে। বঙ্গন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বাঙালি জাতির আশার প্রদীপ হয়ে আবার জ্বলে উঠেছেন। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে অপশক্তির দুর্গে যেমন তিনি হানা দিয়েছেন, তেমনি দেশকে মুক্ত করেছেন সামরিক স্বৈরাচার থেকে, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলা’ বাংলাদেশকে তিনি পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর অঙ্গীকারে পুনর্নির্মাণ করেছেন। বাংলাদেশকে তিনি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি দিয়েছেন, তলাবিহীন ঝুড়িকে পরিণত করেছেন মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর দেশকে তিনি রূপান্তর করেছেন আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশে। বাংলাদেশ আজ সুষম অর্থনীতির, বৈশ্বিক মানে উত্তীর্ণ, মানবসম্পদে সমৃদ্ধ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বনির্ভর একটি জাতিরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যেমন বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগর, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সোনার মানুষের প্রতিষ্ঠান হয়ে, দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণে নিয়োজিত থেকেছে।
পিতা ফিরে এসেছিলেন স্বপ্নের বুনন নিয়ে। কন্যা সেই স্বপ্নেরই ফেরিওয়ালা হয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে গণমানুষের স্বপ্নসৌধ নির্মাণে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছেন।
আরিফুর রহমান লিমন : সহসভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।