বাগ্মীতায়, শব্দচয়নে, দিকনির্দেশনায়, পরিস্থিতির বর্ণনায় এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও উদ্দীপ্ত করার যে মহাকাব্য রচনা করেছিলেন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জনগণের কাছেই শুধু নয় তা গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো জাতীয় নেতার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবেই তা আজো বিবেচিত হয়ে আসছে।
জাতির সম্মান রক্ষার, জাতির অধিকার আদায়ের, জাতিকে সব প্রকার বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে তাঁর বাল্যকালে তিনি যেভাবে দৃঢ়পদে অগ্রসর হতে শুরু করেন তা এক অবিস্মরণীয় গতি সঞ্চার করে তাঁর জীবনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। রাজনৈতিক জীবনও তাঁর বিচিত্র। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক মধ্যবিত্ত সম্মানিত কৃষকের ঘরের সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়ে তিনি সহসাই কলকাতা গিয়ে কৈশোরেই মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ভারতবর্ষ তখন অবিভক্ত। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতা। মুসলিম লীগ তখন এক সাম্প্রদায়িক দাবি উত্থাপন করেছে। দাবি করে বসেছে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ প্রথম শ্রেণির সব বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাই ওই দলের প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে একমত ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিভাভাজন শিষ্য। তাই মুজিব ভাই পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, নানা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি, ভারতীয় রাজনীতির মূলধারার কিছু কিছু ব্যর্থতা ও ব্রিটিশ এবং মুসলিম লীগের যৌথ ষড়যন্ত্র ও অপরদিকে বাংলার মুসলিম জনগণের মধ্যে ধর্মীয় সৃষ্টি বিভ্রান্তি ইত্যাদি মিলিয়ে শেষতক দ্বিজাতিতত্ত্ব ও সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিতে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো এবং তা বাস্তবে রূপ পেল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হলো।
অন্য অনেকের মুজিব ভাইও চলে এলেন পূর্ব বাংলার অর্জিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে। নিজ জন্মভূমিতে। পূর্ব বাংলায় ফিরে এসেও তিনি বসে থাকেননি। নিজেকে পুনরায় নিয়েজিত করেন রাজনীতিতে। অচিরেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটল। মোহমুক্তি ঘটল মুসলিম লীগ সম্পর্কেও। যখনই দেখলেন, মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাঙালিবিরোধী এবং তা এতটাই তীব্র যে তারা বাঙালি মুসলমানদের প্রকৃত মুসলমান বলে মনেই করেন না, যখন দেখলেন মুসলিম লীগের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্ব বিশেষ করে পাঞ্জাবি ধনিকদের নেতৃত্ব পূর্ববাংলাকে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে শোষণ করতে অতিশয় ব্যস্ত এবং আরো দেখলেন খাজা নাজিমউদ্দিনসহ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানি ওই নেতৃত্বের পক্ষে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই নিয়োজিত পূর্ববাংলার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, তখন সমমনা অপরাপর মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে একমত হয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হলেন তিনি।
প্রক্রিয়াটি শুরু করতে দেরি হয়নি। তৎকালীন রাজনীতিতে সাধারণ মুসলিম জনগণের অংশগ্রহণ ছিল নেহাতই অনুল্লেখিত। রাজনীতির মূল ধারা ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বের হাতে। কংগ্রেস যদিও ছিল অসাম্প্রদায়িক দল তবু তার মূল নেতৃত্বে সর্বত্রই ছিল হিন্দুদেরই প্রাধান্য। কিন্তু দেশ বিভাগের ভিত্তি সাম্প্রদায়িক হওয়াতে তারা ১৪ আগস্টের আগে থেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবাংলায় চলে যেতে থাকেন। পরিণতিতে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয় এক গভীর শূন্যতার।
শিক্ষা-দীক্ষা চরমভাবে অনগ্রসর বাংলার মুসলিম সমাজ তখন মূলত কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং ফিউডাল প্রভাবে তারা ছিলেন তখনো বঞ্চিত। ফলে গড়ে ওঠেনি মধ্য বা নি¤œমধ্যবিত্ত একটি তরুণ সমাজও। অপরপক্ষে ধর্মের নামে ব্যাপকভাবে নানা বিভ্রান্তিকর প্রচারও তাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হওয়ায় বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক যেমন গান, নাচ, মেলা, আল্পনা প্রভৃতি ছিল তাদের কাছে না-জায়েজ। ফলে সীমাহীন পশ্চাৎপদতায় ভুগছিল বাংলার মুসলিম সমাজ। এ পরিস্থিতে ভারতে গঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ যার পাকিস্তানি অংশ ‘অল ইস্ট পাকিস্তান’ (‘অল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’) নামে মুসলিম লীগের তরফ থেকে দাঁড় করানো হয়েছিল তার পরিবর্তে ১৯৪৮ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে নতুন একটি মুসলিম লীগবিরোধী ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি।
১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নেতৃত্বে গঠন করেন ‘পূর্ব পাকস্তিান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। প্রতিষ্ঠাকালে দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক আর যুগ্ম সম্পাদক পদে শেখ মুজিবুর রহমান। অল্পকাল পরেই শামসুল হক মৃত্যুবরণ করলে দলটি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। অতঃপর তিনি সভাপতি পদে এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন।
ইতোমধ্যে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের এবং দলভুক্ত কমিউনিস্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠাপ্রত্যাশী দলে পরিণত হয় এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের নীতিও আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে।
১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে পূর্ববাংলার সংগঠিত তাবৎ গণআন্দোলনের নেতৃত্বেও থাকে আওয়ামী লীগ। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এক অপূর্ব অসাধারণ সৃজনশীল জননেতায় পরিণত হন। পরিত্যাগ করেন সাম্প্রদায়িক রীতি আর গ্রহণ করেন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি। পুঁজিবাদী গতানুগতিক শোষণমূলক অর্থনীতির পরিবর্তে গ্রহণ করলেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও দলীয় মেনিফেস্টোতে। সংগঠন আন্দোলন সংগ্রামে নানা সময়ে নানাবিধ গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এক অসাধারণ গতিশীলতা নজিরবিহীনভাবে প্রবর্তন পেতে শেখ মুজিব নিজেকে বাঙালি জাতির প্রাণের অন্তরের গভীরে বিশাল একটি স্থান দখল করে নেন। চিরস্থায়ীভাবে একটি স্থান তিনি তাঁর নেতৃত্বকে এক অসীম উচ্চতায় নিয়ে যেতেও সক্ষম হন।
৭ মার্চে প্রদত্ত জাতির উদ্দেশে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে যে পটভূমির উল্লেখ করলাম তা নেহাত প্রয়োজন মনে করেই করেছি। উদ্দেশ্য সবার স্মৃতিতে তা তুলে আনা এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে ওই ভূমিকা শিক্ষণীয় এক টুকরো মূল্যবান ইতিহাস পারিবেশন করা।
গোটা ষাটের দশকজুড়ে চলছিল পাকিস্তানব্যাপী কঠোর সামরিক শাসন জেনারেল আইয়ুব খানের অধীনে। বাঙালির বুকে নেমে এসেছিল দীর্ঘমেয়াদি এক নির্যাতনের দশক। কারা নির্যাতন, লঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাস, সংখ্যালঘু নির্যাতন, দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন, শত্রু সম্পত্তি আইন নামক বৈষম্যমূলক সাম্প্রদায়িক আইন প্রবর্তন বাঙালির বুকে দুঃস্বপ্ন হিসেবেই নেমে এসেছিল। আজো সে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কেউ করেননি। অপরপক্ষে ওই নির্যাতন, জুলুম প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও সামরিক শাসনের অবসান ও সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) যৌথ নেতৃত্বে বা কখনো পৃথকভাবে পরিচালিত হতে থাকে তীব্র গণআন্দোলন। একই সঙ্গে অবিলম্বে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিও জোরেশোরে উত্থাপিত হয়। ইতোমধ্যে ১৯৬৩ সালে বৈরুতের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরলোক গমন করায় বঙ্গবন্ধু হয়ে দাঁড়ান আওয়ামী লীগ ও বাঙালির একক ও একচ্ছত্র নেতা।
শেষ পর্যন্ত লৌহমানব আইয়ুবকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন, ‘১৯৭০-এ সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচন, এক ইউনিট বাতিল ও সক প্রদেশের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি। সামরিক শাসকদের ধারণা ছিল, পূর্ববাংলায় সর্বাধিক আসনে আওয়ামী লীগ জিতলেও সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ মিলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা একচেটিয়াভাবে অর্জন করে পূর্ববাংলার সামান্য যে কয়েকটি আসন মুসলিম লীগ পাবে তাই দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকবে। কিন্তু ফলাফল ঘটল একেবারেই বিপরীত। পূর্ববাংলার নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের ফলে শুধু আওয়ামী লীগই সমগ্র পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় সরকারি প্রতিশ্রæতি ও আইনের বিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার দাবিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রমাদ গুনল পাকিস্তানের সেনাশাসিত স্বৈরাচারী সরকার।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দলীয় পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে অনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানালেন দ্রুত শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। সমগ্র বাংলার মানুষ অকুণ্ঠভাবে এই দাবি সমর্থন জানাল। তদুপরি বেলুচিস্তান ও উত্তর পাশ্চিম প্রদেশে ওয়ালী ন্যাপ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে বঙ্গবন্ধুর ওই দাবির প্রতি সমর্থ জানায়।
এবারে পাঞ্জাবের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আবির্ভূত হন ভিন্ন দাবি নিয়ে। তিনি যেহেতু সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়েছেন তাই তিনি বঙ্গবন্ধুর নিখিল পাকিস্তান একক নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছয় মাস বঙ্গবন্ধু ও ছয় মাস ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার অদ্ভুত দাবি জানিয়ে বসলেন সামরিক শাসকদের ইন্ধনে। সারা পাকিস্তানের কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ বা দলই ভুট্টোর দাবি সমর্থন না করে বঙ্গবন্ধুর হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন।
এই সুযোগে সামরিক সরকার একদিকে সংসদ অধিবেশন ডেকে বঙ্গবন্ধুসহ পাকিস্তানের সব দলের বিজয়ী নেতাদের আপস আলোচনার প্রস্তাব দিলে সবাই তা গ্রহণ করেন। আলোচনায় বসতে রাজি হলেও বাঙালির ছয় দফার প্রশ্নে আপস নেই- এ কথাও বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন। ওয়ালী মোজাফ্ফর ন্যাপ ও গোপন কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সামরিক শাসকরা প্রমাদ গোনে। তারা আপস আলোচনার নামে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও হাজার হাজার সৈন্য পূর্ববাংলায় আনতে শুরু করে। অপরদিকে পূর্ববাংলায় আন্দোলনরত মানুষকে স্থানে স্থানে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে ও ভয় দেখাতে শুরু করে। বারংবার সংসদ অদিবেশনের তারিখও পাল্টাতে থাকে। এহেন পরিস্থিতে সৃষ্ট জটিলতার মুখে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা বস্তুত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হিসেবেই বিবেচিত হয়। আজো ওই ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ।
বঙ্গবন্ধু বলেন, কীভাবে বাঙালিকে দেয়া প্রতিশ্রæতি অমান্য করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ১৯৭০-এর বিজয়কে নস্যাৎ করে সামরিক শাসন অব্যাহত রাখার ও বাঙালি নিধনের পথ ধরে তারা অগ্রসর হচ্ছে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু জানান, ‘আর যদি একটা গুলি চলে আমার লোকের ওপরে’ বা ‘আমি যদি আর হুকুম দেবার নাও পারি’ বা ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ বা ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’; ‘বাংলার মানুষের অধিকার চাই’ বা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ প্রভৃতি। এই বক্তব্যের সঙ্গে লাখো জনতার মুহুর্মুহু করতালি ও সমর্থনে কেঁপে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আর স্বাধীনতায় লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হন সমগ্র বাঙালি জাতি। সর্বত্র প্রকাশ্যে ও গোপনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অশ্রæপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতি নতুন মাত্রা অর্জন করে। শেষতক ২৫ মার্চ রাতে তারা চালায় আক্রমণ।
রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক।