অগ্নিঝরা মার্চ মাস শুরু। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল মাস। এই মাসের ১৭ মার্চ বাংলার মাটিতে সেই মহান অদ্বিতীয় শিশুর জন্ম হয়। যার জন্ম না হলে এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হতো না। এই মার্চেই আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালে জাতির জনক অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, যাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বললেও অযৌক্তিক হয় না। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আক্রমণের পরপরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ১৭ মার্চ যে খোকার জন্ম হয়েছিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, বাংলাদেশের এক সাধারণ পল্লীতে, এক মধ্যবিত্ত সম্মানীয় মুসলিম পরিবারে। সেই খোকাই বড় হয়ে মহীরূপে ধারণ করে বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য স্বাধীন করলেন। বাংলা ভাষায় কথা বলার চিরদিনের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন। বাঙালি জাতিসত্তাকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপ দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। সেই খোকাই মুজিব ভাই, শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক ও হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
বাংলাদেশ ও বাঙালিকে স্বাধীন করার কৃতিত্ব আর কোনো নেতার পক্ষে পুনরায় অর্জন করা সম্ভব নয়। বাংলার ইতিহাসে তাই তিনি চিরঞ্জিব। এই মার্চেই বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বাংলাদেশে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন বিশ্বের অনেক দেশেই সংঘটিত হয়েছে, অনেক দেশই সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। উদাহরণস্বরূপ কিউবা বা ভিয়েতনামের কথা বলা যায়, কিন্তু যে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো তার চিত্র ও প্রকৃতি ভিন্ন। একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ যে সফলতা অর্জন করেছে তা সত্য সত্যই বিস্ময়কর। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী প্রতিবাদ, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ৬ দফা ভিত্তিক নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের প্রতিটি স্তরে শেখ মুজিব যে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। একটা সাংস্কৃতিক, গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সমন্বিত করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন অন্তত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় খুব সহজ ছিল না। ৮০ ভাগ মানুষ যেখানে মুসলিম, সে ধর্মের প্রতি আকর্ষণের কারণেই যারা ভোট দিয়ে ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম দিল, সেই পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলে একটা অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সহজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মতো অসাধারণ, অসাম্প্রদায়িক, মানব মূল্যবোধে বিশ্বাসী এক অসাধারণ নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব হয়েছে। বাঙালি তো পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে তার নাগরিকত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের কুশাসন, নির্যাতন ও শোষণের ফলে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে যে প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল, তা সফল হলে বাঙালি তো পাকিস্তানি বনে যেত। পাকিস্তানের মুখ্য শাসকরা কোনোদিন ভেবে দেখেননি যে, প্রায় ১ হাজার মাইল ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যাকে তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বিমুখ করে আর এক ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। তাই বাস্তবতার কারণেই বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকরা যখনই আক্রমণাত্মক অভিযান চালিয়েছে, তখন বাঙালি মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছে। এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৭০-র নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে পূর্ব বাংলায় বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকরা যখন সংসদের অধিবেশন ডেকেও তা বাতিল করল, গোলটেবিলে বসে শেখ মুজিব যখন ৬ দফার প্রশ্নে আপসহীন তখন পাকিস্তানি শাসকরা চিরদিনের জন্য দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইল বাঙালিকে। ২৫ মার্চের কালরাত্রে তারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর আক্রমণ করল। আক্রান্ত হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন।
১৭ মার্চ ইতিহাসে শুভদিন। প্রকৃতপক্ষে ওই দিনে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেছেন তিনি বাঙালির ও বাঙালি তার। তাই বাংলার পবিত্র মাটির সঙ্গে তার কখনও বিশ্বাস ঘাতকতা করার ইচ্ছা ছিল না। মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য তাকে বারবার জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি পাকিস্তানি শাসকদের একটিমাত্র অনুরোধ করেছিলেন তা হলো- ‘তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তার মৃতদেহ যেন বাংলার পবিত্র মাটিতে সমাধিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু কিন্তু জানতেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, তার জীবনের বিনিময়ে হলেও। হানাদার বাহিনীর কাছে তিনি কখনো আত্মসমর্পণ করেননি। তবে ধরা দিয়েছিলেন শুধু একটি মাত্র কারণে, তার মতো নেতার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর আটক হলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হবে। যারা বলেন, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন, এটা প্রতিহিংসা পরায়ণমূলক বক্তব্য ছাড়া আর কিছু না।
অসহযোগ আন্দোলন বিষয়ে বলতে গেলে অবশ্যই বলতে হয়, ওটা একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান। একটা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিরাই জনগণকে শাসন করবে, অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় নয়, সামরিক শাসকরা এটা বিশ্বাস করেন না। তখন প্রয়োজন পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের। আমাদের অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক বিস্ময়। একটা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পূর্বে, সরকার গঠন করার পূর্বে কীভাবে একজন জননেতা একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অগ্রাহ্য করে দেশের শাসনভার প্রায়ই তিন সপ্তাহ চালিয়ে যেতে পারেন, বঙ্গবন্ধুই তার অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বেই তিনি জনগণকে শাসন করেছেন। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে। তারই নির্দেশে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও এমনকি সুপ্রিম কোর্টও পরিচালিত হয়েছে। একমাত্র সেনানিবাস ছাড়া সর্বত্র তখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শাসন কার্যকর ছিল না। পাকিস্তানের একজন নেতা আজগর খান তখন বাংলাদেশে এসে মন্তব্য করেছিলেন, একমাত্র শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে পারবে না। আর মুজিব ৭ মার্চেই বলে দিলেন তার সংগ্রামের লক্ষ্য কী। মুক্তিই তার সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য, সে লক্ষ্য অর্জনই হলো স্বাধীনতা। ৭ মার্চেই তিনি প্রথমে মুক্তি ও পরে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। এই স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল সব প্রকারের অন্যায়, বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্তি। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ দেশের অনেক প্রগতিশীল নেতাই নির্বাচন করতে চাননি। তাদের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করবেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হিসেবে তারা সেই ভাবেই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তারা ভুলে গেলেন যে, ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় সলিমুল্লাহ হলে এক জনসভায় বলেছিলেন, ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন আদায় হয়েছে, বাকি ২ ভাগ আদায় করতে খুব কষ্ট হবে না। ওই সভায় আমার থাকার সুযোগ হয়। আমার মতো অনেকেই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে শেখ মুজিব তুষ্ট হতে পারেননি। তবে সিলেটের অন্য সভায় ওই ধরনের বক্তব্য পেশ করায় বঙ্গবন্ধু বোধহয় ক্ষুব্ধ হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে পড়েছিলেন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর যদি ওই সময় বঙ্গবন্ধু তার ৬ দফা ঘোষণা না করতেন এবং ওই ৬ দফার স্বপক্ষে জনমত গঠন ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারতেন, তাহলে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হতো না এবং ১৯৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। ’৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয় অর্জন আওয়ামী লীগের জন্য সম্ভব হতো না। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অধ্যায় হচ্ছে ৬ দফা আন্দোলন। এই ৬ দফার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হয়ে উঠে। অনেকেই বলেছেন, আদমজী পাটকলের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করেন। আর অনেকের ধারণা ছিল তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেই তিনি তুষ্ট হবেন। কিন্তু তিনি যখন বললেন, ‘আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ তখন সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটে। হিমালয় পর্বতের মতো বিশাল মুজিব, অটল দেহের অধিকারী মুজিব, মানুষের জন্য জীবন দিতে পারেন কিন্তু আত্মসমর্পণ করতে পারেন না। নিজের স্বার্থে জীবনে কিছু করেননি, পরিবারের স্বার্থ তো নয়ই। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুক্ত বাঙালি। তিনি স্বাধীন করে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু মুক্ত করতে পারেননি। সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব তার কন্যা শেখ হাসিনা পালন করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে, আদর্শগত অবস্থানে, রাজনৈতিক চিন্তাধারায়, জনগণের কল্যাণের প্রশ্নে পিতা ও কন্যার এমন অদ্ভুত মিল আর কোথাও দেখা যায় না। শেখ হাসিনা যখন বলেন, পিতার স্বাধীন করা দেশে পিতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেন, তা জনগণ বিশ্বাস করেন। জনগণ বিশ্বাস করেন, একটার পর একটা ঘটনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন জনগণের কল্যাণই তার একমাত্র লক্ষ্য। ব্যক্তিস্বার্থ কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনিও তার পিতার মতো জীবনকে বাজি রেখে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তার কর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
জনকল্যাণগামী দেশপ্রেমিক এমন শাসক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল, তাই বিশ্বসভায় তিনি সমাদৃত। জাতি তাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন। একমাত্র জামায়াত-বিএনপি, মৌলবাদী গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসী জঙ্গি ছাড়া আর সবাই মনেপ্রাণে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন, জনগণের প্রয়োজনে তাকে ক্ষমতায় থাকতে হবে এই নীতিতে বিশ্বাসী। নির্বাচনের প্রয়োজন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। এমন সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তার দল ও অনুসারীরা যদি মারাত্মক কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করেন, তবে দেশের জনগণ ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন, তা মনে হয় না।
ডা. এস এ মালেক : বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কলামিস্ট।