শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক মার্চ মাস। এই মাসের ১৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দ্বিঘল পুরুষ। তার অবয়ব ছিল বিশ্বের সেরা সুদর্শন ও নান্দনিক। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রনায়কই এতটা নিখুঁত সুন্দর নন। একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গেই তার সৌম্যকান্তি চেহারার তুলনা চলে। তার গায়ের রং ছিল বাংলাদেশের মাটির মতো, তার মাথার চুল ছিল বাংলার কালবৈশাখী ঝড়, তার দুই চোখ ছিল বাংলার সবুজ দিগন্ত, তার গায়ের মাংস ছিল বাংলার কাদামাটি, তার গায়ের রক্ত ছিল নদী-জল। তিনি এসেছিলেন বাংলার প্রাচীন জনপদ ‘বঙ্গ’ থেকে। নেতাদের মধ্যে একমাত্র শেরেবাংলাই এ জনপদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন বাংলার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে, প্রান্তিক জনপদ থেকে। অনভিজাত, মধ্যবিত্ত ও ধান্য পরিবার থেকে। তার পিতামাতা ছিলেন সরল, অনাড়ম্বর, সাদাসিধে।
রবীন্দ্র-নজরুলের মতো তিনি ছোটকাল থেকে রাজনীতি চর্চা শুরু করেন, যেমন মহান দুই কবি ছোটবেলা থেকে কাব্যচর্চা শুরু করেছিলেন। তৃণমূল থেকে লড়াই করে উঠে এসেছিলেন। তার ছিল সরলতা, রাজনৈতিক সততা, ছিল সাহস, ছিল ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা। ছোটকাল থেকে ছিল নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা, ছিল লক্ষ্যবিন্দু। তিনিও তার মুরব্বিদের অনুকরণ করেছেন, তিনি তার নেতাদের মান্য করতেন। তারা যা বলতেন তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডের রাজনীতি করতেন না, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতেন। তার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেরেবাংলা এবং মওলানা ভাসানীর প্রভাবও ছিল তার ওপর।
নিজস্ব সাংগঠনিক প্রতিভার জোরে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গিয়েছিলেন। তিনি তিলে তিলে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। তার রাজনীতিতে কোনো অপকৌশল ছিল না। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি বাংলার রাজনীতিতে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। দুজনই স্থপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন আজীবন বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির জন্য পরিশ্রম করেছেন ও লড়াই করেছেন, অন্যজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, বাঙালির মুক্তির জন্য লড়াই করতে করতে জীবন বিসর্জন দিলেন সপরিবারে। এক রাতে তার পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। তার মধ্যে ছিলেন সদ্যবিবাহিতা নারী, ছিল শিশু, সন্তানসম্ভাবনা জননী। যিশুখ্রিস্টের চেয়েও নির্মম ছিল তার হত্যাযজ্ঞ।
তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ১৫ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত তাকে কেউ রোধ করতে পারেনি। বলেছিলেন তার অগ্নিœগর্ভ ভাষণে ‘এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ তাই করেছিলেন, কেউ রোধ করতে পারেনি। সব প্রকার দ্বিধাদ্ব›দ্ব চুরমার করে, সব ভ্রæকুটি উপেক্ষা করে তিনি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি পাপেট নন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি সাম্রাজ্যবাদকে তোয়াক্কা না করে বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত, এক ভাগে শোষক অন্য ভাগে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ তিনি আমৃত্যু শোষণহীন সোনার বাংলা কায়েম করার লড়াই করে গেছেন। জাতিসংঘের মতো বিশ্বসভায় তিনি মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। এটাও তার অপ্রতিরোধ্যতা। এ জন্যই মহান, কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, মুজিবকে দেখেছি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে তিনি ভিয়েতনাম ও প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন। এটাও তার অপ্রতিরোধ্যতা। বাংলাদেশ ও বাঙালির শত্রু ড. কিসিঞ্জার বিদ্রƒপ করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি।’ তিনি মার্কিনের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে এই উপহাসের উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাংলাকে শোষণ করে ইসলামাবাদ ও লন্ডনের ডান্ডি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদেরও সম্পদ আছে, আমরাও উঠে দাঁড়াবো।’ এটা যেমন তার অপ্রতিরোধ্যতা, তেমনি আত্মপ্রত্যয়।
বাংলার মাটিতে পা দেয়ার আগেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, মহীয়সী নারী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রæতি আদায় করেছিলেন। অন্য নেতারা একবারই দেশ স্বাধীন করেছেন, তিনি দুবার দেশ স্বাধীন করেছেন। তিনি যখন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনে এসে নামলেন, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত কাজ ফেলে দৌড়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশের বিজয়ী নেতাকে স্বাগত জানাতে, নিজ হাতে তার গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এতে বাঙালির মাথা উঁচু হয়েছিল। লন্ডনে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে আজ আমি অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি রাষ্ট্রদোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দিজীবন কাটাচ্ছি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। রেডিও, কোনো চিঠিপত্র দেয় নাই।’ অধ্যাপক আবু সাইয়িদের এক কলাম থেকে জানতে পারি, ইয়াহিয়া খান গ্রেপ্তারের পূর্বে ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে। কোনো ব্যবস্থাই তার মনোবলে চিড় ধরতে পারেনি। তার জিহ্বা থেকে এমন শব্দ আদায় করতে পারেনি যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে পারে। তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ তো একবারই মরে।’ এটাও তার অপ্রতিরোধ্যতা।
এত বড় রাষ্ট্র চীন আমাদের বিরোধিতা করেছে। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভেরও বিরোধিতা করেছে। কিন্তু তিনি তার ক্যারিশমা দিয়ে জাতিসংঘের সদস্যপদ ছিনিয়ে এনেছেন। সেই জাতিসংঘে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। এটাও তার অপ্রতিরোধ্যতা। মহাকবি মাইকেল মাত্র সাড়ে ৩ বছরে বাংলার কাব্যকে ৫০ বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন, আর তিনি ৩ বছরে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। আমেরিকার এক পত্রিকা তাকে বলেছে ‘রাজনীতির কবি’। বাঙালি কবি নির্মলেন্দু গুণও ৭ মার্চের ভাষণকে বলেছেন ‘অমর কবিতা খানি’। এ দেশের প্রতিটি মানুষকে, প্রতি ইঞ্চি মাটিকে, প্রতিটি পাখ-পাখালিকে, প্রতিটি বৃক্ষ-পল্লবকে ভালোবাসতেন তিনি। তার ভালোবাসা শুকতারা হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করছে। জয় বাংলা।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।