কেমন আছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ?


১৭ই মার্চ ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধু তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। মানব ইতিহাস বলে, যারা সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন, সমাজ তাকে বেশিদিন বাঁচতে দেয় না। তার কীর্তি সমাপ্ত হলে নিয়তি তাকে নিষ্ঠুরভাবে ছিনিয়ে নেয়। তবে এরা এদের কীর্তির জন্য অমর হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ‘বাংলাদেশ’। তিনি অমর। এতবড় নেতাকে বাঙালি ধারণ করতে পারেনি। তাই তাকে মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে মরতে হয়েছে। এখনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে বুঝে উঠতে পারেনি। এ জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন। যতই দিন যাবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন আরো প্রতিভাত হবেন। এই মহান নেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আবারো দাবি উঠেছে, দণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে বাংলাদেশি এক কিশোরীর এমন দাবি সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

তাজউদ্দীন আহমদ যখন মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নেন তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, ‘আমি বঙ্গবন্ধু’র মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দেখি’। ঘটনা তা-ই। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ, তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে হবে। কেমন আছে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ? সদ্য শততম ক্রিকেট টেস্টে শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশ জিতেছে এবং সেটা অগ্নিঝরা মার্চ মাসে। একশটি টেস্টের মধ্যে বাংলাদেশ ক’টিতে জিতেছে তা জানি না, তবে মুক্তিযুদ্ধকালে শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানকে এর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছিল তা জানি। এ জন্য এ বিজয় গৌরবের। ক্রিকেট নিয়ে অধুনা তেমন উৎসাহ অনুভব করি না, টেস্ট নিয়ে তো নয়ই! কারণ এখন মনে হয় টেস্ট ক্রিকেট ‘সময়ের অপচয়’ অথবা ‘অলসদের খেলা’। হয়তো এ জন্য আমেরিকায় ক্রিকেট নেই। ‘ওয়ান ডে’ ম্যাচ না থাকলে ক্রিকেট হয়তো বিলুপ্ত হতে যেত? অথবা ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘ওয়ান ডে সীমিত ওভার’ খেলার উদ্ভাবন।

সুপ্রিম কোর্ট মুফতি হান্নান ও তার দুই সহযোগীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছে। এই দণ্ড কার্যকর করতে এখন আর কোনো বাধা থাকল না? বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মুফতি হান্নান ছিলেন এর প্রধান। ২০০৪ সালে ঢাকায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে হত্যার নিমিত্ত গ্রেনেড নিক্ষেপের দায়ে তিনি অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হন। ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯ মার্চ বলেছে, এখন শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন বাকি আছে, যা মেলার সম্ভাবনা কম। প্রায় একই সময়ে দেশে বেশ ক’টি আত্মঘাতী হামলা হয়েছে। হঠাৎ করে এসব হচ্ছে কেন, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে? একদল বলছেন, বাংলাদেশে মৌলবাদ বাড়বাড়ন্ত এ কথা বলে ভারত শেখ হাসিনাকে চাপে রাখতে চাইছে বা সামরিক চুক্তি করতে চাইছে। আর একদল বলছেন, মৌলবাদ দমনে তিনি সিদ্ধহস্ত এ যুক্তি তুলে শেখ হাসিনা দিল্লির কাছে তার অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে চাইছেন।

ঘটনা যাই হোক, মৌলবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে খেলা ভালো নয়! সদ্য শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘ইসলামি কার্ড আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে’। আওয়ামী লীগ সেটা বুঝলে হয়তো মরীচিকার পেছনে ছুটত না? হেফাজত সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক ভাস্কর্য সরানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়ে যে আল্টিমেটাম দিয়েছিল তা শেষ হয়েছে। ওনারা এখন চুপ কেন? হয়তো ভারতের উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় তারা আনন্দে আছেন? সৌদি প্রিন্স সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন যে, ট্রাম্প মুসলমানের বন্ধু। এরপর তো হুজুররা ট্রাম্পের পক্ষে মিছিল বের করতে পারেন। তবে দেশের হিন্দুদের প্রতি মোল্লাদের এত রাগ কেন বুঝি না। ক’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মোল্লা বলেছেন, গ্রিক মূর্তি না সরালে হিন্দুদের দেশে থাকতে দেয়া হবে না।

আর শুধু কি গ্রিক মূর্তি? তা নয়, কলকাতায় মোল্লারা মৌলানা আজাদ কলেজের বেকার হোস্টেল থেকে শেখ মুজিবের মূর্তি সরানোর দাবি তুলেছে। এই দাবিটি করেছেন ‘সারা বাংলা সংখ্যালঘু ফেডারেশন’-এর সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ কামরুজ্জামান। তাকে সমর্থন করেছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা কাসেম সিদ্দিকী। সব মোল্লার একই ‘রা’? বাংলাদেশটা যেন মনে হয় মোল্লাদের বাপের সম্পত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু এত সোজা না; ভারতে তিন তালাকের বিরুদ্ধে দশ লাখ মুসলিম নারী স্বাক্ষর করে এই প্রথা বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন। উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড রাজ্যে মোদির বিশাল বিজয়ের পক্ষে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- মুসলিম মহিলারা ব্যাপকভাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। তারা তিন তালাক বাতিল চান। নারী জাগলে মোল্লাদের খবর আছে!

নওয়াজ শরীফ সদ্য বলেছেন- পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমানের সমান অধিকার এবং হিন্দুদের অধিকার রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। ‘একই কথা শুনি আজ পাকিস্তানের মুখে?’ হোলির এক অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তার সামনে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করছেন এক হিন্দু নারী। এ দৃশ্য পাকিস্তানের জন্য নতুন। অথচ ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে হোলি উৎসব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এক মোল্লা বলেছে, দোল উৎসব ‘হারাম’। উত্তরে জনৈক হিন্দু বলেছেন, ‘আপনি বলার কে’? তবে শাঁখারীবাজারে রিকশা করে যাওয়ার সময় দুই পর্দানশিন তরুণীকে জোর করে রং মেখে দেয়ার ঘটনা ঘটিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার অপচেষ্টা হয়েছিল। ভাগ্য ভালো, পুলিশ দ্রুত ক’জনকে ধরেছে এবং এরা কেউ হিন্দু নয়। সূর্যবার্তার সুমি খাঁন ১৯ মার্চ এক রিপোর্টে বলেছেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করতে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র : মন্দির-গির্জা আক্রমণসহ ১৭ নাগরিক হত্যার জেএমবির জঙ্গি পরিকল্পনা ফাঁস।’

শুধুই কি জেএমবি? দাউদকান্দিতে মসজিদের ভেতরে ঢুকে কোরান অবমাননা করার ঘটনা কি নাসিরনগর ঘটনার মতো উসকানি নয়? তবে সম্প্রতি সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন ড. তুহিন মালিক। তিনি হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে এখন বিপাকে আছেন। প্রশ্ন উঠেছে, ৫৭ ধারা কি শুধু একটি ধর্মের জন্য? তুহিন মালিক কি আইনের ঊর্ধ্বে? চতুর মানুষ ড. মালিক, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-টিক্ষোভ দেখে দ্রুত বলেছেন, ওটা তিনি পোস্ট করেননি। এ এক নতুন খেলা, ‘আমি কলা খাইনি’। পুলিশ কিন্তু সহজেই বের করতে পারবে ঘটনা কি, প্রশ্ন হলো, তাকে ধরা হবে কিনা? নাকি শুধু রসরাজ-উত্তমরা বিনা অপরাধে জেল খাটবে? এ ক্ষণে ড. তুহিনের একটি ভিডিও দেখলাম যাতে তিনি বলেছেন, ‘কিসের জাতির পিতা, কিসের চেতনা, কিছুই থাকবে না ইনশাল্লাহ’। সত্যি, এই মার্চ মাসে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, তুহিন মালিক বা মৌলবাদই কি বারবার জিতে যাবে?

নিউইয়র্ক, ২০ মার্চ ২০১৭

শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

SUMMARY

1716-1.png