১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনের সম্মানে দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। ছাত্র বয়স থেকেই তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সব আন্দোলনে অগ্রনায়ক ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর এই মহান জন্মদিনে, তাঁকে দলের ঊর্ধ্বে, বিশাল ক্যানভাসে দেখা প্রয়োজন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক এবং বিশ্ববরেণ্য একজন মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নন, সারা বিশ্বের গর্ব। তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বলিষ্ঠ ও সহজাত সম্মোহনী নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তাঁর জন্মদিনে হাজার কোটি সালাম।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পূর্ববর্তী সময়ে শেখ মুজিব ছিলেন ছাত্রনেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের জন্ম হয়। তাঁর প্রস্তাবনা ভাষা আন্দোলনে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং সর্বদলীয় পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। অতঃপর ৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬-দফা, ’৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ, ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধ- সব কিছুতেই ছিল এই কালজয়ী নেতার মহান নেতৃত্বের আলোর অনবদ্য ছটা।
বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায়, ৭ মার্চের অনুপ্রেরণায় এবং তাঁর মহান নেতৃত্বে বাঙালি হেঁটে গেছে ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় অর্জনের পথে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির মুক্তির সনদ ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশিত সৈয়দ আবুল মকসুদের মতামত অত্যন্ত সময়োপযোগী, বিশেষ করে আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য খুবই শিক্ষণীয়। আবুল মকসুদ বলেন, ‘৭ মার্চের বার্তা হলো অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ৭ মার্চের শিক্ষা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রজ্ঞার অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নাগরিক রাজনৈতিক সচেতনতার জন্য যেমন অর্থবহ, তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শাসনব্যবস্থা অধ্যয়নে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাঙালির স্বাধীনতায় তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রজ্ঞার অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণ আমি স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে পরবর্তী সময় লেখায় অলোকপাত করব। এখন শুধু দুটি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
প্রথমটি হলো- বর্তমানে আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাস্তব অনুসরণ খুবই কম লক্ষ করা যায়। রাজনীতিতে চরম সুবিধা গ্রহণকারীদের, অত্যধিক ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি সম্পন্নদের ও ভোগবাদীদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল স্কুল অফ থট যারা অনুসরণ করে না তাদের অধঃপতনের কথা বাদই দিলাম। কিন্তু তাকে অনুসরণের নামে যারা এটি করে, সেটি তো মেনে নেয়া যায় না। এর লাগাম টানার সময় এসেছে। পাশাপাশি ভিন্ন মতাবলম্বীদের অনুপ্রেবেশ ঠেকাতে হবে।
দ্বিতীয়তটি হলো বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে অপরিমেয় অন্যায্যতা করা হয়েছে, তার হিসাব নেয়ার সময় এসেছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিয়ে ইতিহাস বদলানোর চেষ্টা হয়েছিল। মিথ্যাচার করা হয়েছিল ৭ মার্চের ভাষণ নিয়েও। তিনি বলেন, এক সময় এ দেশে ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ ছিল। যার ফলে একটি প্রজন্ম কিছুই জানতে পারেনি।
ইতিহাসের অত্যন্ত নিন্দনীয় সত্য যে, পঁচাত্তরের দুষ্কৃতকারীরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং পরাজিত শক্তির দোসরদের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে (তাঁর দুই কন্যা ব্যতীত) হত্যা করে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা এতেই ক্ষান্ত হয়নি। এরাই ইতিহাস বিকৃতকারী স্বার্থান্বেষী মহল। তারা বঙ্গবন্ধুর মহান অবদানকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা কীভাবে দেখায়। ধিক তাদের, আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ঘৃণা তাদের জন্য। পঁচাত্তরের দুষ্কৃতকারীদের সহযোগী এবং কতিপয় পরাজিত শক্তির দোসর ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের এবং বিশ্বের বহু মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান একজন কালজয়ী মহান নেতা হিসেবে জ্বলজ্বল করছে। অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে তাঁর মহান ইতিহাস বিকৃতি করতে। এই কালজয়ী বিশ্ববরেণ্য মহান নেতার ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা আর কোনোদিন বরদাস্ত করা হবে না।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমাদের প্রতিশ্রæতি হোক তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শিক্ষা নেয়া, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে শিক্ষা নেয়া এবং তাঁর মহান ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা প্রতিহত করা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার : স্থানীয় শাসন, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।