২৬ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যে ৭-৪০ মিনিটে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী আনুষ্ঠানিকভাবে পঠিত হয়। বিপ্লবী বেতার সূত্র উদ্ধৃত করে স্বাধীনতার ঘোষণার উল্লেখ করে। উল্লেখ্য প্রথম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষণার বাণী পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা প্রচারে সহায়তা করেন, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান কায়সার ও মোশাররফ হোসেন প্রমুখ এমপিগণ।
যদিও বিকাল থেকেই চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলীবৃন্দ স্বউদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার পরেই বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা আরও সুশৃঙ্খল হয়। সে সময় রেডিওতে আরো একটি কণ্ঠ শোনা যায়। ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ কণ্ঠটি ছিল আবুল কাশেম স›দ্বীপের। তার ঘোষণার পর প্রচারিত হয় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়, হবে হবে, হবে নিশ্চয়’ সমবেত কণ্ঠের গান। চারদিক সুনসান তার মধ্য থেকে এই গান যে শুনেছিল তার মনেই বয়ে যায় এক আশার জাগানিয়া। গান শেষ হওয়ার পর আবার ঘোষণা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’ এবারের কণ্ঠ সুলতানুল আলমের। আবার সমবেত কণ্ঠের গান- ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফ্যাল কররে লোপাট’ এবং ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম দশ জন হলেন, বেলাল মোহাম্মদ, প্রকৌশলী রাশেদুল হাসান, মুস্তফা আনোয়ার, কাজী হাবিবুদ্দিন, আবুল কাশেম সন্দীপ, প্রকৌশলী রেজাউল করিম, আবদুস শাকের, শরফুজ্জামান, আমিনুর রহমান ও আব্দুল্লাহ আল ফারুক। প্রত্যক্ষ সহায়ক ছিলেন অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ, মাহবুব হাসান, সেকান্দর হায়াত খান, হারুন খান, সৈয়দ আনোয়ার আলী, রঙ্গলাল দেব, আবদুল্লাহ আবদুস শাকের, ডা. মনজুলা আনোয়ার, ইঞ্জিনিয়ার আশিকুল ইসলাম, দিলীপ চন্দ্র দাশ এবং কাজী হোসনে আরা ও ড্রাইভার এনাম প্রমুখ।
শনিবার ২৭ মার্চ ১৯৭১ রাত ৮টায় মেজর জিয়া বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। উল্লেখ্য মেজর জিয়াউর রহমানের এই স্বাধীনতা ঘোষণার বক্তব্য নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির সদস্য সর্বজনাব এম এ হান্নান, মীর্জা আবু মনসুর ও মোশারফ হোসেন ফটিক ছড়িতে অবস্থানরত জনাব এ কে খানের কাছ থেকে স্বাধীনতাপত্র খসড়া নিয়ে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টারে মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট পৌঁছে দেন। ২৮ মার্চ সকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাপাঠটি ছিল নি¤œরূপ :
‘আমি মেজর জিয়া মহান জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। দেশের সর্বত্র পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রিয় দেশবাসী, আপনারাও যে যেখানে আছেন, হাতের কাছে যা কিছু পান- তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ইনশাল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। সেই সাথে আমরা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী দেশ থেকে আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছি। জয় বাংলা।’
এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় দিকে দিকে। নতুন প্রাণের জোয়ারে সংগঠিত হয়ে উঠে দেশ। প্রবল উচ্ছ¡াসে দেশের মানুষ অস্ত্র হাতে নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে এসময় ইপিআর জোয়ানগণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হল ও এএফ রহমান হলে এসে আশ্রয় নেয়। কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক সিআরবির টিলায় অবস্থান করেন।
রাতের মধ্যে বিশ্ব গণমাধ্যমের সহায়তায় ঢাকার কার্ফ্যু ও গণহত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসির এই দিনের প্রচার বাঙালিদের কাছে বিপ্লবের দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান বললেন : শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন দেশদ্রোহিতার সামিল। তিনি এবং তার দল দেশের আইনগত কর্তৃত্বকে অবমাননা করে আসছেন। তারা পাকিস্তানের পতাকার অবমাননা করেছে। এবং জাতির পিতার ফটো পুুড়িয়েছে। তার ইচ্ছা পূরণের জন্য একের পর এক অন্যায়, অত্যাচার ও বেআইনি কাজকর্ম সহ্য করে গেছি। মুজিবকে স্বমতে রাজি করাতে আমি ও নেতৃবৃন্দ চেষ্টার কোনো ত্রুটি করি নাই। …আওয়ামী লীগকে একেবারেই বেআইনি ঘোষণা করছি। আমি সংবাদপত্রের উপর কড়া নজর দেবার আদেশ দিয়েছি।
২৮ মার্চ টিক্কা খাঁ ১৫ দফা নির্দেশ জারি করলেন ঢাকায় : ১.পূর্ব পাকিস্তানের সব রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে। ২.সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া খবরের কাগজে, বেতারে, টিভিতে, প্রচারপত্রে পুস্তিকায় কোনে কিছু প্রকাশ করা যাবে না। ৩.আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না। ৪.সকল কর্মচারীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজে যোগদান করতে হবে। অমান্যকারীদের সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। ৫. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাববে। ৬. কোনো নাগরিক আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে না। নিকটতম থানায় জমা দিতে হবে। ৭. সমস্ত ব্যাংক বন্ধ থাকবে। ৮. সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৎপরতা চলবে না। ৯. দেশী অস্ত্র-শস্ত্র কেউ রাখতে পারবে না। ১০.আগামী ৭২ ঘণ্টায় কোনো পাঁচজন একত্র হতে পারবে না। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য সামরিক শাসকের অনুমতি লাগবে। ১১. ধর্মঘট লকআপ চলবে না। ১২. সামরিক প্রশাসন যে কোনো স্থানে তল্লাশি চালাতে পারবে। ১৩. লুট, ঘেরাও, অগ্নিসংযোগ বরদাস্ত করা হবে না। ১৪. কোন বিদেশী কাউকে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না। ১৫. সমস্ত সাইক্লোস্টাইল বা রিপ্রোডাকশন মেশিন সামরিক শাসকের হাতে জমা দিতে হবে।
খুনি ইয়াহিয়ার এই ফরমান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কিন্তু যে বাঙালি জেগেছে তা ঠেকাবার এত অস্ত্র পাকিস্তানিদের কোথায়। বাঙালি এবার মরতে প্রস্তুত। আর পেছনে হটা নয় এবার সম্মুখপানে চলার সময়। সারা বাংলাদেশে প্রতিরোধ এভাবে শুরু হয়ে যায়। কোথাও সম্মিলিতভাবে কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে। তবে প্রতিরোধ থেমে নেই। ২৯ মার্চ সোমবার ১৯৭১, চুয়াডাঙ্গায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর, আনসার, ছাত্র জনতার সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে কুষ্টিয়ার পাকবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিফৌজ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে পাকবাহিনীর। পাকিসেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। একজন মুক্তিসৈনিক শহীদ হন। সন্ধ্যায় পাকসেনার রেকিদল মুক্তিসেনার অ্যামবুশে অফিসারসহ সকলেই নিহত হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ নিয়ন্ত্রণাধীন ৪র্থ বেঙ্গল ও অন্যান্য দল ভৈরব বাজার এবং নরসিংদীর মধ্যকার রেল লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ দিন থেকে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করা হয়। পাকবাহিনী ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি বিমানের আক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। সেখানে সুবেদার ছাবেদ আলী তার প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দ সৈনিকগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে যায় মুক্তাঞ্চাল রামগড়ে। সেখান থেকে আগরতলা। উল্লেখ্য এই বেতার কেন্দ্রটির সকল অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযোদ্ধা-এবং সকল দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে প্রবল আশা জাগিয়ে তুলেছিল।
৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে রাজশাহীর গোপালপুর রেলক্রসিং-এ মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। এই লড়াইয়ে ৬ ট্রাক একটি জিপসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর সৈন্যদল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় জনতার হাতে। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর সৈন্যদলের অধিনায়ক মেজর রাজা আসলাম নিহত হয়। মৃত্যুকে উপেক্ষা করে উত্তরবঙ্গ চিনিকলের অফিসার কর্মচারীগণ এই প্রতিরোধ যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এ ছাড়াও নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল পরিচালিত প্রতিরোধ বাহিনী বেলুনিয়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ৪০ জন পাকসেনাকে বন্দি করে ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। পরে এসব অস্ত্র¿ শুভপুরের যুদ্ধে কাজে লাগে। মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পাকবাহিনী দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহের পথে পালাতে থাকে। এ যুদ্ধে ২৫৬ জন পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। চট্টগ্রাম থেকে সর্বজনাব এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান এবং আবদুল্লাহ আল হারুন সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলা শচীন সেনগুপ্তের কাছে আওয়ামী লীগ নেতাগণ অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তার আবেদন জানান। মুখ্যমন্ত্রী শচীন সেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং জনাব এম আর সিদ্দিকীকে দিল্লি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
৩০ মার্চ আর একটি দুঃসাহসিক ঘটনা, যা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। এ দিন ফ্রান্সের বন্দরে নোঙ্গর করা পাকিস্তানি জাহাজ থেকে সাবেক পাকিস্তান নৌবাহিনীর আটজন দুর্জয় সাহসী বাঙালি নাবিক পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এভাবে দিকে দিকে বাংলার সন্তানগণ অস্ত্রহাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকে। মুজিবনগর সরকার গঠন প্রসঙ্গে
মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৭
গতকালের পর
ভারতের লোকসভা ও রাজ্য সভায় ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ দিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। লোকসভায় এক সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাতকোটি জনতার সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা ও সহায়তা দানের ঐক্যমত প্রকাশ করা হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় রেজুলেশন উত্থাপন করেন এবং ঘোষণা করলেন :
“This House expresses its deep anguish and grave concern at the recent developments in East Bengal. A massive attack by armed forces, dispatched from West Pakistan has been unleashed against the entire people of East Bengal with a view to suppressing their urges and aspirations. Instead of respecting the will of the people so unmistakably expressed through the election in Pakistan in December 1970, the Government of Pakistan has chosen to flout the mandate of the people. The Government of Pakistan has not only refused to transfer power to legally elected representatives but has arbitrarily prevented the National Assembly from assuming its rightful and sovereign role. The people of East Bengal are being sought to be suppressed by the naked use of force, by bayonets, machine-guns, tanks, artillery and aircraft. The Government and people of India have always desired and worked for peaceful, normal and fraternal relations with Pakistan. However situated as India is and bound as the peoples of the subcontinent are by centuries old ties of history, culture and tradition, this House cannot remain indifferent to the macabre tragedy being enacted so close to our border. Throughout the length and breadth of our land one people have condemned in unmistakable terms, the atrocities now being perpetrated on an unprecedented scale upon an unarmed and innocent people. This House expresses its profound sympathy for and solidarity with the people of East Bengal in their struggle for a democratic way of life Bearing in mind the permanent interest which India has in peace, and committed as we are to uphold and defend human right, this House demands immediate cessation of the use of force and the massacre of defenseless people. This House calls upon all peoples and Governments of the world to take urgent and constructive steps to prevail upon the Government of Pakistan to put an end immediately to the systematic decimation of people which amounts to genocide.
This House records its profound conviction that historic upsurge of the 75 million of people of East Bengal will triumph. The House wishes to assure them that their straggle and sacrifices will receive the wholehearted sympathy and support of the people of India.”
৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিনের সঙ্গে বিএসএফ কর্মকর্তার যোগাযোগ হয়। তাকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার আবেদন জানায় বিএসএফ প্রধান। এদিন তেলিয়া পাড়ায় মুুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী, মেজর শফিউল্লাহ, লে. কর্নেল রবকে নিয়ে একটা বৈঠক হয়। এই বৈঠকে যুদ্ধজয়ের জন্য বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তার একান্ত প্রয়োজন মর্মে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়।
এদিন দুপুর বেলা বাঙালি ছাত্রদের উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্কে একটি জনসমাবেশ এবং বিকেল বেলা ট্র্যাফালগার স্কয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ট্র্যাফালগার স্কয়ারে প্রায় দশ হাজার লোকের এ জনসভায় অন্যান্যদের মধ্যে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি শেখ আবদুল মান্নান, সুলতান শরীফ, আবদুল মতিন, সাখাওয়াত হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু বক্তৃতা করেন। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় কার্য পরিচালনা করেন বিএইচ তালুকদার।
সোমবার, ৫ এপ্রিল ১৯৭১, অবরুদ্ধ ঢাকায় নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ১২ জন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রেস রিলিজ অনুসারে ঐ দলে ছিলেন ফরিদ আহমদ, গোলাম আজম, খাজা খয়েরউদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান প্রমুখ। ৬ এপ্রিল আরো কয়েকজন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে যারা পৃথক পৃথক ভাবে দেখা করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী, জামাতে ইসলামীর সভাপতি গোলাম আজম, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি পীর মোহসেনউদ্দিন ও এডভোকেট এ.কে. সাদী, আবদুস সবুর খান। টিক্কা খানের সঙ্গে যোগাযোগের পর তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়। ৫ এপ্রিলের মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজইউক’ সংখ্যার দুপৃষ্ঠাব্যাপী রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। এই রিপোর্টে দৃঢ়চেতা ও সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে উল্লেখ করা হয়।
Even when you are talking alone with him,” says a diplomat, “he talks like he’s addressing 60,000 people.” Eloquent in Urdu, Bengali and English, three languages of Pakistan. Mujib does not pretend to be an original thinker. He is a poet of politics, not an engineer, but the Bengalis tend to be more artistic than technical, anyhow, and so his style may be just what was needed to unite all the classes and ideologies of the region. (Newsweek, 5 April 1971)
এইদিন বিশ্ববিখ্যাত আর্যুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠান ‘সাধনা ঔষধালয়ের’ প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষকে পাক হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল দিল্লিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা পিএন হাকসারের একান্ত বিশেষ বৈঠক হয়। আলোচনায় সর্ববিধ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। বুধবার, ৭ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একান্ত আলোচনা করেন। সঙ্গে ব্যারিস্টার রহমতউল্লা (আমিরুল ইসলাম) ছিলেন। দুদফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীমতি গান্ধী ও জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এই বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় ও অবাধ রাজনৈতিক কার্যপরিচালনার সুযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্ববিধ সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়।
১২ এপ্রিল গাউস খানের নেতৃত্বে ‘কাউন্সিল ফর দি পিলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর সমর্থক কয়েকশ বাঙালি লন্ডস্থ চীনা দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার আবেদন জানায়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দূতাবাসের কর্মচারীদের হাতে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাঙালিরা অতীতে তাদের সংগ্রামে চীনকে সমর্থক বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্তমান নীতির ফলে জনসাধারণ চীনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেছে। গাউস খানের নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিরা চীনা দূতাবাসে যাওয়ার আগে হাইড পার্ক থেকে মিছিল সহকারে ডাইনিং স্ট্রিটের পাশ দিয়ে হোয়াইট হল হয়ে ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে এক সভায় যোগ দেন। ঢাকায় খাজা খায়ের উদ্দিন ও জামাত নেতা গোলাম আজম জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে শান্তিকমিটির মিছিল বের করে। পাক সেনাবাহিনীর সাফল্যের জন্য মোনাজাত পরিচালনা করেন জামাতের আমীর গোলাম আজম। তিনি ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মোকাবিলা করতে জেহাদের জিগির দেন।
১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল। বেলা ১১টা। এই দিন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুক্তাঞ্চল ভবের পাড়ায়, বৈদ্যনাথ তলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল ওসমানী ও অন্যান্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় মঞ্চে এলেন। আশপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারগুলোর একটাও পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনটার হাতল নেই, কোনটার বা পা নেই। ক্যাপ্টেন মাহবুব আর জনাব তওফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়নে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য আনসার বাহিনী প্রস্তুত। ক্যাপ্টেন মাহবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে। প্রায় হাজার দুই লোক এসেছিল অনুষ্ঠানদর্শক হিসেবে। শতাধিক বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান এসেছেন। গার্ড অব অনার ও জাতীয় সঙ্গীতের পর নেতৃবৃন্দ মঞ্চে বসলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা সনদের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তার মন্ত্রিসভা-সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি ভাষণে বলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম লগ্নের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশ শত সহ¯্র মৃত্যু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। কেউই নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক, দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রই এই নতুন জাতিকে গ্রহণ করবে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন, তা আমরা চিরকৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেটব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছে অনুরূপ সমর্থন আশা করি। তা পেলে তাদের অভিনন্দন জানাবো।
এই সভায়ই কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে অন্যান্য মন্ত্রীরা ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য জনাব এম. মনসুর আলী ও জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামান। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমাধীন ভবেরপাড়া গ্রাম সেই গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় এক ছায়াঘেরা আম্রকাননে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই স্থানের নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান এমএনএ (টাঙ্গাইল)। মুজিব নগরে শপথ অনুষ্ঠানে দেশী, ভারতীয় ও বিদেশী একশ সাতাশ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও সোহরাব হোসেনসহ যশোর খুলনার বহু গণপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
গগনবিদারী ¯েøাগান বিপুল করতালির মাঝে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদটি পাঠ করলেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে ২৬ মার্চ জাতির জনক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা সাংগঠনিক রূপ নেয়।
মোনায়েম সরকার : গবেষক, লেখক।
মোনায়েম সরকার : কলাম লেখক।