ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে স্বাধীনতা ঘোষণার অনেক পরে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। জেনারেল জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলেও নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি। বরং বিচিত্রা পত্রিকায় এক নিবন্ধে তিনি লিখে গেছেন যে, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা অর্থাৎ ৭ই মার্চের বক্তব্য শোনার পর পরই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।
বয়োবৃদ্ধ বিএনপির যেসব বুদ্ধিজীবী বেগম জিয়ার শাসন আমলে, বেগম জিয়ার সরকারকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াকে গ্রহণ করার দাবি জানান সেই সব জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীদের ধারণা ছিল যে, ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপের মুখে জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকেই স্বাধীনতার মূল ঘোষণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে বিএনপি নেতা জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। আর মেজর জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের গুরুত্ব কমতে থাকবে। সেই সুবাদে তারা তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল হিসেবে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হবে। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়, বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য, ষড়যন্ত্রমূলক কোনো অভিসন্ধি তার বিকল্প হতে পারে না। এটা ওদের কাছে এখনো বোধগম্য হয়নি। তা না হলে উদ্ভট পরিকল্পনা তাদের মাথায় আসবে কেন।
তেইশ বছরের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, ১৯৬৬ সালে আগরতলা মামলায় একজন সেনা কর্মকর্তা হয়েও তিনি সংশ্লিষ্ট হতে পারেননি, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরও যিনি সোয়াত জাহাজ থেকে হানাদার বাহিনীর জন্য অস্ত্র খালাস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পর যিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ একে একে ধ্বংস করেছেন, তিনি কি করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন, তা ভাবতে অবাক লাগে। জ্ঞানপাপীরা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ তো আর কখনো ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাই ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিএনপি যা বলবে জনগণ তাই বিশ্বাস করবে। বাস্তবতা হচ্ছে- সাড়ে তিন দশক এই মিথ্যাচার করেও তারা সত্য বাস্তবতাকে জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য করতে পারেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্ধারিত অবস্থানেই রয়েছেন। ২৭ মার্চ জিয়া সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে কেন যান, তা সহজেই অনুমেয়।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলেও জিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি যে, কোন পক্ষ তিনি অবলম্বন করবেন। পাকিস্তানের একজন অনুগত সৈন্য ছিলেন বলেই তিনি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হয় তার মূল বিতর্কটা কি? আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতা কালুরঘাটের ওই বেতার থেকে জিয়ার ঘোষণার আগেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা বারবার বলতে থাকেন। পার্শ¦বর্তী এলাকায় জিয়ার অবস্থানের কথা জানতে পেরে তারা জেনারেল জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব করেন। জিয়া কিন্তু প্রথমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। আর তিনি চাপের মুখে প্রথমবার সরকার ও সেনাবাহিনীপ্রধান হিসেবে সে ঘোষণা দিলে সবাই বিস্মিত হন এবং এদের চাপের মুখেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা তাকে দিতে হয়। আসলে সেদিন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা মেজর জিয়াকে দিয়ে বেতার মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে, তাদের এই ধারণা ছিল অবিবেচনা প্রসূত, অনাকাক্সিক্ষত।
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপরেও কি স্বাধীনতার ঘোষণার আর কোনো প্রয়োজন ছিল? এরপর ২৬ মার্চ হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালানোর পরেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণা দেন ও যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলেন তার চেয়ে বড় বিষয় সেদিন কে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার অধিকার অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো পক্ষে কি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া সম্ভব ছিল?
১৯৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন। তারপর পাকিস্তানিরা তার সেই অবস্থান মেনে না নিয়ে সংসদ অধিবেশন বাতিল করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করল। তখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি তো এক মাস বাংলাদেশ শাসন করেছেন। মূলত তার নেতৃত্বে প্রশাসন ব্যবস্থা পূর্ব বাংলায় প্রচলিত ছিল। তাকেই সরকারপ্রধান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তখন স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল কিছু সময়ের ব্যাপার। এর কোথাও কি কখনো মেজর জিয়া নামক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা ছিল। আকাশ থেকে পড়েই ইচ্ছা করলে কি একজন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারতেন। এই জালিয়াতি, ধাপ্পাবাজি, মুনাফেকির কি শেষ হবে না? সময় ও সুযোগ পেলেই তারা জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়ে বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল না করলে জিয়ার অবস্থান কী হতো তা কি তার অনুসারীরা একবার ভেবে দেখে না। আর তিনিই যদি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন তার উচিত ছিল শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বলা আমি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি, আমাকে সাহায্য করেন। কিন্তু তিনি কেন মুজিবনগর সরকারের অধীনে চাকরি করতে গেলেন, জেড ফোর্সের দায়িত্ব পালন করলেন, দেশ স্বাধীন হলে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকরি নিলেন।
আসলে কে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কার স্বাধীনতার ঘোষণার অধিকার ছিল। মওলানা ভাসানীর মতো নেতা সম্ভবত ৯ মার্চ কুষ্টিয়ার এক জনসভা থেকে আহ্বান করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। শ্রদ্ধেয় ভাসানীও জানতেন এই অধিকার জনগণ বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল। আর কারো পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের এই সাধারণ উপলব্ধি বুঝবার ক্ষমতা কি লোপ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিকল্প হিসেবে যারা জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, তাদের দৃষ্টিতে একটা বালুর ঢিবিকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করতে। অসত্যের এই অপপ্রচার এদেশের রাজনীতিতে আর কতকাল চলবে। বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা একটু নিরাসক্ত হয়ে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, বঙ্গবন্ধুর বিকল্প হিসেবে জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র অনাকাক্সিক্ষত, অযুক্তিসঙ্গত।
ডা. এস এ মালেক : বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কলামিস্ট।