বাঙালির স্বাধীনতায় রাজনৈতিক বাস্তবতা ও নেতৃত্বের প্রজ্ঞা


বাঙালির স্বাধীনতায় তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রজ্ঞার অন্তর্দৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণ খুবই অর্থবহ। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শাসনব্যবস্থা অধ্যয়নে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নাগরিক রাজনৈতিক সচেতনতা বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অঞ্চলের এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের দলীয় আইন সভার সদস্যদের কনভেনশনে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নীতিবহির্ভূতভাবে লাহোর প্রস্তাব সংশোধনের মাধ্যমে একটি মাত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম হবে বলে ঘোষণা করেন। সংশোধিত প্রস্তাবেও পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি বহাল ছিল। বাস্তবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তো দূরের কথা, একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান।

জিন্নাহর আচরণে ক্রমেই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বাংলা ভাষায় কথা বললেও পাকিস্তানের মন্ত্রিসভায় ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙালি প্রতিনিধিত্ব ছিল খুবই কম। উল্টো পূর্বপাকিস্তানে প্রায় শতভাগ লোকের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সেখানেও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দিতে বারবার অনীহা প্রকাশ করা হয়। অন্যায়ভাবে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন বাতিল করা হয় এবং ১৯৫৮ সাল থেকে প্রকাশ্য সামরিক শাসন জারি করা হয়, যা অব্যাহত থাকে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের পূর্ব পর্যন্ত। পাকিস্তান জন্মের পর থেকে বাঙালির স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ২৪ বছরব্যাপী চলতে থাকে অপরিমেয় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি এবং বাঙালির প্রতি বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে রাজনৈতিক অনাচার ও বৈষম্য ছিল সীমাহীন।

এ পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বাঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমাগতভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেন। তার ধৈর্য ছিল পাহাড় সমান। তিনি ছিলেন স্থির, অবিচলিত, দৃঢ় এবং অসাধারণ পরিশ্রমী, ত্যাগী ও সাহসী। নীতিতে ছিলেন অনড়। আদর্শের প্রশ্নে তিনি কোনোদিন আপস করেননি। মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল অপরিমেয়। এমনকি চরম শত্রুকেও বিশ্বাসভঙ্গ বা চুক্তির লঙ্ঘন না করা পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন।

তার দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বে ১৯৫৮-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ও ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন থেকে ১৯৬৯ সালে বিশাল গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভ হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল এসেম্বলিতে সর্বমোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৬২টিতে প্রার্থী দিয়ে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান এসেম্বলির ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। ফলে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকার গঠন করবে, এটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু পাকিস্তান সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে যে পন্থা বেছে নিল, তা ছিল সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতা ও জঘন্য। কেননা আওয়ামী লীগের নীতি দেশের সংহতির জন্য হুমকি ছিল না। আওয়ামী লীগ যে অব্যাহত গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেছে তাতে ছিল শত-লক্ষ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। অ্যান্টনি মাসকারেনহাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘এ ধরনের আশঙ্কা করারও কোনো ভিত্তি ছিল না যে, পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য বিস্তার বা অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করবে।’

স্বাভাবিকভাবে এটা মনে করা হতো যে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর চক্রান্তে ইয়াহিয়া খান পুরো পাকিস্তানের ক্ষমতা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে হস্তান্তর না করলেও একটা কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে অথবা অন্তত নির্বাচনী ফলাফলকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভোট হিসেবে মেনে নিয়ে সংবিধানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের স্পৃহা ও লাহোর প্রস্তাবনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন জারি করবে। কিন্তু এটা কোনো সিভিল নাগরিকের পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না যে ১৫ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকার গভর্নমেন্ট ভবনে মঞ্চস্থ রাজনৈতিক নাটক ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম অধ্যায় রচনা করবে।

নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করা পূর্ব বাংলার জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তারা ভেতর থেকে মুক্তির তাড়না অনুভব করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার প্রতীক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলার মানুষের আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। তার বলিষ্ঠ ও সম্মোহনী নেতৃত্বে মানুষ এতটাই অনুপ্রাণিত ছিল যে তিনি চাইলে লাখ লাখ মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন মুলতবি হয়ে যাওয়ার পর বাঙালিদের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আসার পরিবর্তে সামরিক বাহিনীর লোক ও অস্ত্রশস্ত্র বহন করার কাজে পাকিস্তান বিমানগুলোর নিয়োজিত থাকা নিয়ে সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এর পরপরই বাঙালি সেনারা কয়েকবার শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে মুক্তির সংগ্রামের নির্দেশ চেয়েছেন। সামরিক বিশ্লেকদের মধ্যে যারা ৩ মার্চ বা ৭ মার্চই স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা না দেয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেন, তারাও স্বীকার করেন শেখ মুজিবুর রহমান এতটাই মানুষের আস্থাভাজন নেতা ছিলেন যে তিনি ৭ মার্চ উপস্থিত রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রকে নির্দেশ দিলে হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে হলেও ঢাকা সেনানিবাস দখল করা সম্ভব হতো। এর বাইরে যারা সমালোচনা করেন তারা হীন, মূর্খ, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী ইতিহাস বিকৃতিকারী গোষ্ঠী।

বাংলার মানুষের অগাধ আস্থা বঙ্গবন্ধুকে আরো দায়িত্বশীল করে তোলেন। যদিও কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও প্রাজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, সব সামরিক বিশ্লেষকের পক্ষে এটা বুঝা সম্ভব নয় যে তিনি বিচ্ছন্নতাবাদী নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন গণমানুষের এবং বাংলার মুক্তির অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা। পাকিস্তানের শেকল ভাঙতেই ছিল তার সারা জীবনের সংগ্রাম। তবে অনিবার্য না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেটা করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। একই সঙ্গে তিনি রাজনৈতিকভাবে মুক্তির শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করেন এবং বাংলার জনগণকে বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দেন ও বিপর্যয় অনিবার্য হলে মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলেন।

তার ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাঙালির মুক্তির ও স্বাধীনতার সনদ। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং কালজয়ী রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। ‘… আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায় … প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা-আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায়, ৭ মার্চের অনুপ্রেরণায় এবং তার মহান নেতৃত্বে বাঙালি হেঁটে গেছে স্বাধীনতার তোরণে সূর্য দীঘল পথে।

এতদবিষয়ে উপর্যুক্ত সাধারণ আলোচনার বাইরে তার নেতৃত্বের প্রাজ্ঞতার কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ টানা যাক। প্রথমত, ডেভিড ফসটার ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর একটি অন্তর্দৃষ্টিমূলক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ফসটার জানতে চান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) যখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয় সেটা এড়াতে তিনি চেষ্টা করলেন না কেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, গ্রেপ্তার হলে আর ফিরে আসবেন এটা তিনি ভাবেননি, কিন্তু গ্রেপ্তারকেই শ্রেয় মনে করেছেন এই কারণে যে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে বাঙালি জাতির অসম্মান জড়িত ছিল। তা ছাড়া পালিয়ে গেলেও এই ঝুঁকি ছিল যে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা তাকে খোঁজে বের করে হত্যা করত এবং এর কালিমা বাঙালি জাতির ওপর চাপিয়ে দিত এই বলে যে, প্রতিবিপ্লবী বাঙালিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছে।

দ্বিতীয়ত, তিনি লক্ষ্যমুখীন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন ও ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অবহিত থাকতেন। বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের স্বার্থে শত্রুর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। যেমন : ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান আবদুল ওয়ালি খান সকালে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করেন, কী তার সর্বশেষ অবস্থা? ইয়াহিয়া বলেন, ‘আমি যেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেছি, সেখান থেকে বেরোতে হলে, আই হ্যাভ টু শুট মাই ওয়ে থ্রু।’ তিনি খবরটা শেখ সাহেবকে দেয়া দরকার মনে করে যান শেখ মুজিবের কাছে এবং তাকে বলেন, ‘জানেন, ইয়াহিয়া কী করতে পারে?’ জবাবে শেখ সাহেব বললেন, ‘হি উইল হ্যাভ টু শুট হিজ ওয়ে থ্রু।’

তৃতীয়ত, নেতৃত্বের প্রাজ্ঞতার আর একটি উদাহরণ হলো যে বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বাঙালি জাতিকে তাড়িত করেননি। উত্থাল মার্চে আশঙ্কাজনক পর্যাপ্ত তথ্য ও গতিপ্রবাহ থাকা সত্ত্বেও, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করেছেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বা চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন শেষ মুহূর্তে গ্রেপ্তারের প্রাক্কালে (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে)। তবে তিনি আগে থেকেই বাঙালি জাতিকে এবং এর সব সশস্ত্র বাহিনীকে মনের ভেতর থেকে অনুপ্রাণিত করে রেখেছিলেন যে, যুদ্ধ যখন অনিবার্য জীবন দিয়ে হলেও তার মোকাবেলা করার জন্য। যা অন্তর্নিহিত আছে বাঙালির হৃদয়ে তার প্রতি অগাধ আস্থা প্রতিষ্ঠার মাঝে এবং স্পষ্টভাবে বিবৃত আছে ৭ মার্চের মুক্তির সনদে- তার কালজয়ী সম্মোহনি ভাষণে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। বাংলার মহান স্বাধীনতা অমর হোক। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার : গবেষক, লেখক।

SUMMARY

1710-1.png