মুজিবনগর দিবস ও প্রাসঙ্গিক কথা বলতে গিয়ে আমি মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে কী হতো তা বলতে গিয়ে আমি বলেছিলাম-
১. অনেকগুলো সরকার হতো, একটা সেনা সরকারও হতে পারত, যার ফলে স্বাধীনতা কোনো দিন অর্জিত হতো না। ২. ভারতের কাছ থেকে তেমন কোনো সাহায্য-সহায়তাও মিলত না। অনেকগুলো সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুদ্ধটাই ভেস্তে যেত। ৩. শরণার্থীরা আশ্রয় পেত না এবং পেলেও শরণার্থী, এমনকি মুক্তির জন্য জিম্মি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ক্রমশ পাকিপক্ষ সমর্থন করত। ৪. যুদ্ধের জন্য আশ্রয়, ট্রেনিং ও অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যেত। কেননা ভারতের সর্বজনীন সমর্থনটা বিভক্ত হয়ে পড়ত। ভারত সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তি অকল্পনীয় হতো। ৫. উগ্র-বামদের উত্থান হতো এবং তাদের নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় একটা দাস-প্রভু সমাধান হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারত আমাদের যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নিত না। ৬. দালালের সংখ্যা অধৈর্য বাঙালিদের মধ্যে বেড়ে যেত। কোনো গেরিলা অপারেশন চালানো যেত না। ৭. শেষমেশ কিছু দালাইলামা ভারতে থেকে যেত যারা কোনো দিনও দেশে ফিরতে পারত না। ৮. স্বীকৃতির প্রশ্ন আসলেও কাকে স্বীকৃতি দেয়া হবে তা নির্ধারণ কঠিন ব্যাপার হতো। ৯. গণপ্রশাসন অসম্ভব হতো। বড় কথা হলো যে ঐতিহাসিক অভূতপূর্ব ঐক্যের কারণে বঙ্গবন্ধু অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল তা ভেঙে যেত। ফলাফল শুধু কল্পনাই করা যায়। ১০. সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটোর পর ভেটো দিতে পারত না। ১১. সপ্তম নৌবহর ক্রিয়াশীল হতো। ১২. অনেক সরকারের মধ্যে বেশিরভাগের সম্মতিতে বড়জোর একটা কনফেডারেশনের রূপ হতো। ১৩. ক্রমাগত জৈবিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানিকরণ সইতে না পেরে সাধারণ মানুষ ক্রমশ দলে দলে আত্মসমর্থন করত।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে না আসলে কী হতো, তারও একটি দৃশ্যপট অন্যত্র দিয়েছি যার সারাংশ নি¤œরূপ-
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসলে দেশে কী হতো? সংক্ষেপে বলা যায় বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হতো। সে পরিস্থিতি ঠেকাতে ভারতীয় মিত্ররা স্থায়ীভাবে এ দেশে থেকে যেতেন। গুটিকয়েক দেশ ছাড়া কেউ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিত না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো জোট বেঁধে পাকিস্তানের সমর্থনে নেমে পড়ত। এখানে একটা নতুন লেবানন সৃষ্টি হতো। উন্নয়নের জন্য অর্থ পাওয়া যেত না। শাসকদলের অভ্যন্তরীণ দ্ব›েদ্ব সব কিছু শেষ না হলেও শেষ হওয়ার উপক্রম হতো। তারপরও অকৃতজ্ঞদের একাংশ তাকে সপরিবারে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। সেদিন হাতে গোনা কিছু মানুষ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নামল। যারা রাস্তায় নামল তারা আকার-আকৃতিতে ছোট ছিল। বড় আকারের বড় সুবিধাভোগীরা তখন অনেকেই সেদিন আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার হুমকিও দিয়েছিল। কেউ কেউ আবার উল্লাসে মেতেছিল এবং ‘এসব একনায়কদের পরিণতি এমন হয়’ বলে মন্তব্য করেছিল। তারপরও কিছু নিঃস্বার্থ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার টানে ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সুরক্ষায় রাস্তায় নেমেছিল।
শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর দেশে ফিরে আসেন ১৭ মে ১৯৮১ সালে। অবশ্য তিনি আবারো ২০০৭ সালের ৭ মে স্বল্প সময়ের বিদেশ বাসের পর বহু বাধা-বিঘ্ন ঠেলে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে বাংলাদেশে অনেক কিছুই কেউ জানত না বা অনেক কিছু অপ্রাসঙ্গিক হতো।
সেদিন যদি তিনি দেশে ফিরে না আসতেন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম লীগের মতো হয়তো টিম টিম করে বেঁচে থাকত যার ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হারিয়ে যেত। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কনফেডারেশন সম্ভব না হলেও দেশটি একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতো। ‘সকালে উঠিয়ে আমি মনে মনে বলি’র পরিবর্তে, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি’ বলতে হতো। দেশটি কম করে হলেও ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হতো আর রাজাকাররা চিরস্থায়ী রাজা হয়ে সবার শিরে চেপে বসত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হতো, মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তিব্বতের দালাইলামা সম ও তার অনুসারী কাঞ্চা ও কাঞ্চিতে রূপান্তরিত হতো। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে খুন করা হতো, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না অর্থাৎ আমাদের দীর্ঘমেয়াদি মুক্তির যুদ্ধটা স্থগিত হয়ে যেত। ধনী আরো ধনী হতো, দরিদ্র আরো দরিদ্র হতো। ক্রমশ প্রতিটি মানুষ ইসলামাবাদের গোলামে পরিণত হতো, ধর্মের ধ্বজাধারীরা দেশটাকে চষে বেড়াত, বাংলাভাষা ও জাতি বিলুপ্তির পথে যেত। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যগুলো মূর্তি আখ্যায়িত করে বিলুপ্ত করা হতো। শহীদ মিনারগুলো সব উঠে যেত। বাঙালির সংস্কৃতি তলিয়ে যেত।
দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সবটা সময় তো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ওপর এতটা চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে দেশটাকে ইসলামি রিপাবলিকে ঠেলে দিতে পারেনি। তিনি ফিরে না এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের গহŸরে হারিয়ে যেত। আমাদের দেশটা হতো একান্তই সাম্প্রদায়িক দেশ।
শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান শান্তিটুকুও প্রতিষ্ঠিত হতো না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ছিল অকল্পনীয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হতো দা-কুড়ালের। আজকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি, সেসব মোটেই সম্ভব হতো না। বিশ্বের বুকে একটা মর্যাদাবান জাতি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি কিংবা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের পথ ধরছি, তখন স্বপ্ন দেখারও কেউ থাকত কিনা সন্দেহ।
আবারো বলছি শেখ হাসিনা দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য হতো মুসলিম লীগের ভাগ্য। আর অন্যান্য সব কিছুর আকর হতো এই ক্ষমতাহীনতা। বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করছি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। সেই আগস্টে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনে প্রয়াস নেয়া হয় এবং সঙ্গে শুরু হয় দলীয় উচ্চাসন নিয়ে কামড়া কামড়ি। দলের শীর্ষনেতাদের প্রায় সবাই জেলে। সে সময় প্রয়োজন ছিল ঐক্যের কিন্তু তখনই দলের শীর্ষ পদ দখলের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়। মোল্লা জালাল ও মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি আপসকামিতা ও তৃণমূলে অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ১৯৭৭ সালের ৩ এপ্রিলের কাউন্সিল অধিবেশনে তদ্রƒপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলেও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে একটা দায়সারা গোছের কমিটি করা হয়। তিনি এক বছরও নেতৃত্বে থাকতে পারেননি। ১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ আগের মতো নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় কাউন্সিলে পূর্ববত অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারো যখন জোড়াতালি দিয়ে কমিটি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে ও দল ছিন্নভিন্ন হওয়ার উপক্রম হয় তখন সাধারণ কর্মীরা শেখ হাসিনার নামে ¯েøাগান দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে। সেদিন তাকে সভাপতি নির্বাচিত না করলে দল বহুধাবিভক্ত হতো, কেউ মিজান আওয়ামী লীগ, কেউ বাকশাল কিংবা কেউ বা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে ও তার উত্তরাধিকারী দাবি করে বহু নামের আওয়ামী লীগ গঠন করে দালালি বলবত রেখে আত্মতরক্কি করতে পারত। সেনা আশ্রিত দলে পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে আশ্রয় নিতে নিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি নিঃশেষ হয়ে যেত। দেশটাতে এমনকি সেনা শাসন চিরায়ত হয়ে যেত। আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত এ দুরবস্থার জন্য যত গণবিরোধী শক্তি ছিল, তারা সবাই অবদান রেখেছিল।
শেখ হাসিনা দেশে আসার কারণে তার দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিন তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে উল্লসিত হয়েছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার হয়েছে, ব্যাংক-বীমার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে। আরো কত কী? ব্যক্তির পর্যায় ছাড়িয়ে সামষ্টিক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরেছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারি নবমর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে, এমনকি সামাজিক উন্নয়ন সূচক দিয়ে আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি। অর্থনীতিতে ক্রমাগত ৬ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটতে ঘটতে এখন তা ৭.২৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে আর্থিক ব্যবসায় ধস নামলেও বাংলাদেশ ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১৬০২ ডলার। পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির মাত্রা কাক্সিক্ষত পর্যায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছে, শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অকল্পনীয় সম্প্রসারণ ঘটেছে। মহাকাশের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করলে এবং জীবন বাজি রেখে সামনে এগিয়ে না গেলে তার কিছুই সম্ভব হতো না। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা যাবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমাদের বহু ক্ষেত্রে উল্লস্ফন ঘটেছে ও জাতির মুখোজ্জ্বল হয়েছে, তার জীবন সংকটময় হয়েছে।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।