শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন


১৯৮১ সালের ১৭ মে রবিবার ঢাকায় তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। ওই ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে গ্রাম-গঞ্জ-শহর নগর-বন্দর থেকে অধিকারবঞ্চিত মুক্তিপাগল লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিল ঢাকার রাজপথে ও তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। জড়ো হয়েছিল ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে। লাখো জনতার সঙ্গে সেদিন স্বৈরশাসক জিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা তৎকালীন বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও উপস্থিত হলাম কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে। সবার মুখে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ আর অশ্রæসিক্ত কণ্ঠে ছিল ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’ স্লোগান, হাতে বঙ্গবন্ধুর আর দলীয় প্রতীক নৌকার প্রতিকৃতি। কী অদ্ভুত দৃশ্য। জাতির পিতা এবং তাঁর কন্যার প্রতি মানুষের এত গভীর ভালোবাসা দেখে আবেগে অশ্রæ গড়িয়ে পড়েছিল। তার দুহাত তোলা মোনাজাতের ভঙ্গি, ক্লিষ্ট ক্ষীণ দুর্বল দেহ, যেন কাঙ্গালিনী- আজো সে দৃশ্যের কথা মনে হলে- আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম ¯েøাগানের মাধ্যমে নেত্রীকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জনতার কণ্ঠে সেদিন ঘোষিত হচ্ছিল হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেব ¯েøাগানটি। আরো ছিল- ‘শেখ হাসিনা আসছে, জিয়ার গদি কাঁপছে, গদি ধরে দিব টান জিয়া হবে খান খান।’ আনন্দ আর বিষাদের অশ্রæ দিয়ে মুক্তি পাগল বাংলার জনগণ বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নেয়। আজ সেই ১৭ মে, বঙ্গবন্ধুর কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যে কতটা সঠিক ছিল, গত ৩৬ বছরের ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। শেখ হাসিনা কেবল নেতৃত্বের শূন্যতাই পূরণ করেননি, নির্মাণ করেছেন এবং করে চলেছেন নতুন এক বাংলাদেশ।

১৯৮১ সালে এ দিনে ৩৪ বছর বয়সের পিতৃ-মাতৃহারা তরুণী শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই যখন বাংলার মাটিতে পা রাখলেন, তখন তার আপন রক্তের ‘কোথাও কেউ নেই’। কী নির্মম, নিষ্ঠুর কাহিনী। আমার জানা নেই, বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এমন ট্র্যাজেডির শিকার কোনো রাজনৈতিক পরিবার হয়েছে কিনা? তাইতো স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে ওই দিন শেরেবাংলা নগরের সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আমি ঘর-সংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই।’ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে প্রথম দিন তিনি জনগণকে যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, আজো প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে দেশকে আত্মনির্ভরশীল, সুখী-সমৃদ্ধ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সম্পন্ন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

দেশে ফেরার আগেই ১৯৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে শক্ত হাতে দলের হাল ও গণতন্ত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে রেখে সহস্র বাধা অতিক্রম করেন। তিনি জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশে ফেরার ১৫ বছরের মাথায় আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন।

১৯৯৬ সালের ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, বহির্বিশ্বে দেশের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি জাতির জনকের হত্যাকারীদের রক্ষাকবচ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন, সর্বোচ্চ পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখেন। মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি তার সুযোগ্য নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবজনক মর্যাদা পেয়েছে। এছাড়া ২০০১ সালে কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান, কৃষিবিদ সমীর চন্দ, কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুনসহ অনেকের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ২০১৫ সালে ‘ডক্টর অব দি ইউনিভার্সিটি’ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার অবিসংবাদিত রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকময় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ২০০১-এর নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। পুনরায় ২০০৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভের পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের আর কোনো দেশ উন্নতির এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেনি, যেমন পেরেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ। একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে, নিম্ন মধ্য আয়ের পথ পেরিয়ে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলার কাণ্ডারি, দেশরতœ শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি সবই পারে, আমরাও পারি। এই সেতুটি নির্মাণ করতে গিয়েও সরকারকে অনেক দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে। ইতোমধ্যে সেতুর ৪৩ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্রই পাল্টে গেছে। ঢাকায় প্রবেশের ক্ষেত্রে সব মহাসড়কই চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। পিছিয়ে নেই অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। ইন্টারনেট ব্যবহারে সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য, দুর্যোগ মোকাবেলা, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। শুধু কী তাই, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ও বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে করে তোলে অপরিসীম গৌরবান্বিত। ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। আজ তারই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে সমাদৃত। এখানে পৌঁছতে তাকে অনেক চ্যালেঞ্জ আর বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে থেকেছেন। ২৪ বার তার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যাতে নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারিয়েছেন আর আহত হলেন শত শত। তাদের মধ্যে কৃষিবিদদের অহঙ্কার কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এমপি, মশিউর রহমান হুমায়ুনও সেদিন মারাত্মকভাবে আহত হন। আজো তারা সেই গ্রেনেডের স্পিøন্টার শরীরে বহন করে এক দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু আমাদের দেশ বা আমাদের এই অঞ্চলেরই নন, গোটা বিশ্বেরই একজন বিশিষ্ট রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। লি কুয়ান ইউ ধারাবাহিকভাবে তিন দশক সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে উন্নতির শীর্ষে তার দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যও শেখ হাসিনার ধারাবাহিকভাবে আরো কয়েক মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা প্রয়োজন। সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সমগ্র জাতির কাছেই তিনি শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং অভিনন্দিত।

পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ : ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1705-1.jpg