বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ


উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন সংগঠন আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। গত ২৩ জুন সংগঠনটি ৬৯ বছরে পদার্পণ করল। বাংলাদেশের যত বড় বড় সংগ্রাম ও অর্জন হয়েছে বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগ বলতে বোঝায় শেখ মুজিবকে। একটা দলকে একচ্ছত্রভাবে নেতৃত্ব দিয়ে সেই দলের মাধ্যমে একটা দেশ ও জাতিকে জন্ম দিয়ে শেখ মুজিব নিজেকে জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যে অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, তা বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শেখ মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাকিস্তান একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছে কিন্তু পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এমনভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য মূলত তারাই দায়ী। তাদের লক্ষ্য ছিল, পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা ও পূর্ব বাংলার সম্পদ দিয়ে পাকিস্তান গড়ে তোলা। এই প্রক্রিয়া এতই নিষ্ঠুর ছিল যে, বাংলার জনগণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিবই যথার্থভাবে বোঝাতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই।

ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানেও বাঙালিদের কোনো মর্যাদা ছিল না। হিন্দুরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ও ভারতীয় চর বলা হতো। এই ধরনের মন ও মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম। আর সেই পাকিস্তানের শাসন পদ্ধতি ছিল সামরিক বা আধা-সামরিক। পূর্ব বাংলাকে শোষণ করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করতে না পারে এই কারণেই জেনারেল আইয়ুব খান দশ বছর সামরিক শাসন চালান। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন হলে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসেন। শেখ মুজিবকে এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হয়েছে। ৬ দফা ছিল তার মহা অস্ত্র। পাকিস্তানের শাসকদের ভোট দিতে বাধ্য করে তিনি ৬ দফাকে নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ৬ দফার দাবিভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের দাবি করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তা প্রত্যাখ্যান করে। শেখ মুজিব তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আর এই দলের জন্মদাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যান্য দলও সঙ্গে ছিলেন, তাদের ভূমিকা ছিল একেবারেই গৌণ। আওয়ামী লীগের কথা বলতে গেলে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ আরো অনেককে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অনেকেই ছিলেন, তবে অনেকেই এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। চরম দুর্যোগে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে জনগণের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করেছেন ও বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৭৫-এর প্রতিবিপ্লবের পর বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের ধারায় সামরিক শাসনের জাঁতাকলে আবদ্ধ হয়। এর মাত্র ছয় বছর পর জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান মনোনীত হয়ে সেই থেকে আজ পর্যন্ত দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার শ্রদ্ধেয় পিতা জাতির জনক আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন আর ১৯৭৫-এর প্রতিবিপ্লবের পর দলের দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা প্রতিবিপ্লবের ধারায় পরিচালিত বাংলাদেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন, স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিয়ে জেনারেল জিয়া যখন পাকিস্তানমুখী তখনই রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ঘটে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে (প্রায় স্বাধীনতার সপক্ষের সব রাজনৈতিককে শক্তি) নিয়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করেছেন। এই কাজটি কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না বলেই শেখ হাসিনা বিদেশের মাটিতে থাকাকালে তার দলের সাধারণ কর্মীরা বিশেষ অধিবেশনের মাধ্যমে দলীয় প্রধান হিসেবে তাকে বরণ করে নেয়। দেশে ফিরে তিনি তার গুরুদায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এই দায়িত্ব পালনকালে তাকে ২১ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। জীবনকে বাজি রেখে তিনি বাংলার জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন না হলে দেশ আজ কোথায় যেত, তা ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জেল হত্যার বিচার, ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না এলে কখনো সম্ভব হতো না। তাই বলা যায়, আদর্শিক মহা সংকট থেকে শেখ হাসিনা দেশের জনগণকে রক্ষা করেছেন। আর উন্নয়নের কথা যদি বলা যায় এই মহা দেশদরদি নেত্রী সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি যা বলেছেন তা দেশদরদি কোনো মানুষের বুকে শিহরণ না জাগিয়ে পারে না। একবার ভেবে দেখুন ভিক্ষার ঝুড়ি নিয়ে যে দেশের জন্ম সেই বাংলাদেশের ২০৪১ সালে অর্থনীতি হবে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ও মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ডলার। শেখ হাসিনার জন্য এটা স্বপ্ন নয়। তিনি যা বলেন, আল্লাহর রহমতে তিনি তাই করে থাকেন। একজন সৎ, ধর্মপ্রাণ ও সুদক্ষ শাসনকর্তা হিসেবে তিনি নিজেকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন উন্নয়নের এক মহাসড়কে।

একটা রাজনৈতিক দলের উত্থান-পতন, পরিবর্তন, পরিবর্জন বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকেই ঘটে থাকে। আওয়ামী লীগের বেলায়ও তাই ঘটেছিল। এক সময় আওয়ামী লীগ করতেন, তারাই দুর্দিনে দল ছেড়ে সামরিক শাসকের সহযোগিতায় বিত্তবান হয়ে আওয়ামী লীগের দোষারোপে মেতে উঠেছে। দুর্দিনে দলত্যাগীর সংখ্যা কম নয়। আর একদল দলে থেকে, সরকারে থেকে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে দূরে। এদের কারণে আজ দেশে দুর্নীতি কমছে না। সততার সঙ্গে এসব নেতাদের কারণে শেখ হাসিনা রাষ্ট্র চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এদের অবস্থান দলে কম শক্তিশালী নয়। তাই ভবিষ্যতে তারাই দল ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ করলে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজের কথা বলেছিলেন। ন্যায়বিচারের কথাও তিনি বলেছিলেন। শেখ হাসিনাও একই কথা বলছেন। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে বর্তমান বিশ্বে একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র পরিচালনা বেশ কঠিন। বিশ্ব অর্থনীতির ধারা পরিবর্তন হয়েছে, সমাজেও পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রযুক্তি বিশ্ব ব্যবস্থাকে একেবারেই পাল্টে দিয়েছে। বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যারা নেতৃত্ব দিত সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো আজ পশ্চিমা সামরিক শক্তির অংশীদার।

ব্রিটেন আজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন একজন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছে, ক্ষমতায় বসেই মার্কিন পলিসি সম্পর্কে যার বক্তব্য হচ্ছে- ‘আমেরিকা ফর আমেরিকান’। যে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ক্ষমতাধর অবস্থানে ছিল, বিশ্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে তার অবস্থানে থাকতে চাচ্ছে না। নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখছে। তাই জলবায়ু সম্মেলন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। প্রতিবেশী বৃহৎ বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। সরকার পদ্ধতি যাই হোক না কেন, পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে শত প্রচেষ্টা চালিয়েও সমঝোতা করা যাচ্ছে না। মহাচীন শুধু এশিয়া নয় বিশ্বে আজ এক অর্থনৈতিক মহাশক্তি। এসব বিবেচনায় নিয়েই প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন। অনেকের কাছে অনেক সময় অনেক কিছু অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হলেও শেখ হাসিনা দেশ ও জাতীয় স্বার্থকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন, তার ক্রিয়াকর্মের অবশ্যই মূল্যায়ন করা দরকার। বিশ্বে যে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল- এটা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই সম্ভব হয়েছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থেই জনগণের উচিত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। অন্তত আরেকবার আর একটা মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে দেশ ও জাতিকে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেবেন তার থেকে অন্য কেউ দেশকে পিছিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।

এই ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আজ পর্যন্ত যারা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের এবং শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন সমাজে বাস্তবায়িত হোক এবং দেশ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাক সেই প্রত্যাশাই করি।

ডা. এস এ মালেক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

SUMMARY

1703-1.png