আসিফুর রহমান সাগর
রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার না করায় প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছিল মানুষের মনে। যুদ্ধের ময়দানে নামার প্রচণ্ড তাড়নাও ছিল ছাত্র-যুবকের হূদয়ে। সেই তাড়না থেকেই সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে রেডিও অফিসে বোমা হামলা চালায় কয়েকজন তরুণ যুবক। তাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক হারুন হাবীব। তিনি তার ‘জনযুদ্ধের উপাখ্যান’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রেসকোর্সের বিশাল বিক্ষুব্ধ জনারণ্য থেকে বাসায় ফিরে চিন্তা শুরু করলাম, কী করা যায়। ... কিছুটা পর পাশের বাড়ির মুরাদ এলো সমবয়সি কিছু বন্ধু নিয়ে। সামান্য কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। তারপর হঠাত্ ওদের আনা একটি ‘ভক্সওয়াগন’ গাড়ীতে করে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ী চালাতে চালাতে মুরাদ বললো, ‘হারুন ভাই, আজ আমরা রেডিওতে বোমা মারবো। আপনি রাজি তো? আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। ভিতরটা আনন্দে কেঁপে উঠছিলো। ওর প্রস্তাবে যেনো প্রাণ ফিরে পেলাম। বললাম, রাজি না মানে? বোমা আছে তো? চল। ..আমরা রেডিও অফিসের আশপাশ দিয়ে বার কয়েক গাড়ী নিয়ে ঘুরলাম। ...আমাদের গতিবিধি যে সৈন্যদের নজরে পড়েছিলো তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। ..হঠাত্ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শব্দ কানে এলো। গাড়ীর স্টিয়ারিং ধরে ঘটনার আকস্মিকতায় মুরাদ লফিয়ে উঠলো। পর পর ছোঁড়া হলো কয়েকটা হাতবোমা। প্রচণ্ড শব্দে সেগুলো ফাটলো।.. বুলেটবিদ্ধ হলো গাড়ীটা।
৭ মার্চের ভাষণ এভাবেই তরুণ প্রজন্মকে ঘর থেকে টেনে এনেছিল বাইরে, লড়াইয়ে। পর দিন ৮ মার্চ সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। প্রদেশের অন্যান্য বেতার কেন্দ্র থেকেও তা প্রচার করা হয়। এদিকে, ক্ষুব্ধ শিল্পীরা বেতার-টেলিভিশনে শর্ত দিলেন, আমরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবো, তবে সব অনুষ্ঠান আন্দোলনের অনুকূল হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিল্পীদের এ শর্ত মানতে বাধ্য হয়।
এ ঐতিহাসিক ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত গোটা পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ৮ই মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাসহ সকল শহর-গঞ্জে, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। এমনকি সরকারের পুলিশবাহিনী ও ইপিআর বাঙালি সদস্যদের অনেকেই পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার প্রতি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, বাংলা ন্যাশনাল লীগের অলি আহাদ, পিডিবি’র নূরুল আমিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পূর্ণ সমর্থন দেন।