জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন শেখ কামাল


জীবনে আছে নানা বাঁক, আছে নানা চোরাস্রোত। সেসব মোকাবেলার সাহস ও শক্তি যিনি যুগিয়েছিলেন তিনি আমাদের কামাল ভাই। নদীর জলতরঙ্গ যেমনিভাবে বয়ে চলে আদি-অনন্ত,অনবরত, ঠিক তেমনিই এখনও প্রতিটি মুর্হুতেই টের পাই তাঁর অস্তিত্ব, তাঁর ভালোবাসা-¯েœহের বন্ধন। যখনই কোনো দুর্বিপাকের মুখোমুখি হই, তখনই তার কণ্ঠস্বর যেন শুনতে পাই। তাঁর সেই মায়ায় মেশানো কণ্ঠস্বরে তিনি আমায় তখন ভরসা দেন, স্বান্ত¡না দেন, সমস্যাকে জয় করার উপায় বাতলে দেন, ঠিক যেমনি দিতেন তাঁর সান্নিধ্যে থাকাকালীন সময়ে। কামাল ভাই আমাদের কাছে ছিলেন এমনই একজন আর্দশিক মানুষ যাঁর কাছে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ বাস্তবায়নে তুচ্ছ ছিল নিজের জীবন। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশর; যেখানে থাকবে না শোষণ, থাকবে না অন্যায়-অবিচার। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতির গর্বিত অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার নিত্য প্রয়াসে তিনি ছিলেন সদা জাগরুক। ধর্মের আবরণে অধর্মের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল যারা, তাদের বিরুদ্ধে তারুণ্যের দীপশিখা জ্বালিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি; আসমুদ্রহিমাচল পরিমাণ দীপ্তি নিয়ে তারুণ্যের গান গেয়ে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশিত অর্ন্তভেদে ছড়িয়ে পড়া কুজ্বঝটিকাকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সেই সময় আমরাও তাঁর সঙ্গে একাতœতা পোষণ করে হয়েছিলাম তাঁর সঙ্গী। তিনি ছিলেন আমাদের আশার দিশারী, আমাদের পথপ্রদর্শক। তারুণ্যের উদ্দামতায় পথবিচ্যুত উচ্ছৃংখলতাময় জীবনের পরিবর্তে সুন্দর শ্বাশত জীবন পাথেয় তিনি দেখিয়েছিলেন আমাদের। অনুপ্রাণিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সৈনিক হয়ে দেশের তরে কাজ করে যেতে। সেই চেতনা অদ্যাবধি বহমান, থাকবে অনির্বাণ।

পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আগ্রাসনের মতো যখন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও শুরু করেছিল, তখন কামাল ভাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানী ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার এমনই ঘটানোর চেষ্টা করেছিল যে এদেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান কবিতাকে হিন্দুয়ানীর তকমা লাগিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কামাল ভাই এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। যাঁর রক্তের মাঝে আছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেই তিনি কিভাবে এরকম সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তকে মেনে নেবেন? তিনিও নেননি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিস্তার ঘটানোর জন্য তিনি শিল্পীদের নিয়ে আন্দোলনে নেমে ছিলেন। যতই পাকিস্তানীপন্থীরা এদেশ থেকে রবীন্দ্রনাথকে এদেশের মন থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে রবীন্দ্রসঙ্গীত ততই মানুষের মননে আরো গভীরভাবে প্রোথিত করা হয়েছিল, বাঙালি মানসে অসাম্প্রদায়িকতার সূর্যরশ্মিকে আরো জোরালোভাবে বিচ্ছুরিত করা হয়েছিল।

কামাল ভাই ছিলেন দেশপ্রেমিক এক যোদ্ধা। একাত্তর পূর্ব সময়ে সারাদেশজুড়ে যে উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, তিনি সেই আন্দোলনের সঙ্গে একাতœতা পোষণ করেই ক্ষান্ত হননি, আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সাতই মার্চের ভাষণের সময় স্টেডিয়াম থেকে হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে এসেছিলেন রেসর্কোস ময়দানে। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। অসংবাধিত নেতার সন্তান তিনি, তাঁর পক্ষে গা বাঁচিয়ে চলা ছিল অসম্ভব। তারুণ্যের উদ্দামতা নিয়ে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান রেখে গেছেন। পাকিস্তানি হানাদাররা যখন এদেশে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে নির্বিচারে মানুষ হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল, জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তিনি চুপচাপ নিরাপদ জীবনের আশ্রয়ে যাননি। তিনি বঙ্গবন্ধুর সন্তান। তাঁরই মতো দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রু হননের কাজে, দেশ মাতৃকার পবিত্রভূমিকে পবিত্র রাখবেন বলে। তিনি বীরদর্পে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করে দেশকে হানাদার মুক্ত করতে অবদান রেখেছিলেন।

নয় মাসের দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে বিজয়ীর বেশে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে কামাল ভাই ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর সেই প্রিয় ক্যাম্পাসে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে লেখাপড়া করার পাশাপাশি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুর্র্নগঠনের কাজে পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসামান্য মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে কামাল ভাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কামাল ভাই ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন তিনি। একজন কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনি সবসময় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের দিক নির্দেশনা দিতেন। ক্যাম্পাস এলাকায় অন্যায় করে কেউ তাঁর হাত থেকে পার পেত না। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে দু একজন ছাত্র নেতা কেন্টিনে ফাও খাওয়ার চেষ্টা করছে জানতে পারলে তিনি তাদের ডেকে সেই ঘৃণ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন। ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্রীর প্রতি কেউ কোনো অশালীন আচরণ করলে তিনি সেটার প্রতিবাদ করতেন আর আমাদেরকে সবসময় এই বিষয়ে সর্তক থাকার নির্দেশ দিতেন। তিনি শুধু ক্যাম্পাস নিয়েই নয়, সমগ্র দেশ নিয়েই ভাবতেন।

রাজনীতির মাঠে, খেলার মাঠে, গানের আসরে, নাটকের মঞ্চে, সেতারের সুরে, মানবতায়-মহানুভবতায় তিনি এক কথায় ছিলেন অনন্য অসাধারণ। এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতিতে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর চেষ্টার ফলেই বদলে গিয়েছিল ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলাধূলা। তিনি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ফাস্ট বোলার ছিলেন তিনি। আবার এসএমহল বাস্কেটবল টিমেরও ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। আবহানী ক্রীড়াচক্র তাঁরই হাতে গড়া। শুধু কী খেলাধূলা, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলা গানের নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশে পপ সঙ্গীতের সূচনা হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। কামাল ভাই গানে, কবিতায়, বির্তকে,ভাষণে সবক্ষেত্রেই লালন করতেন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা, ছড়িয়ে দিতেন সেই অসাম্প্রদায়িকতার বাণী। ‘নাট্যচক্র’ নামের একটি মঞ্চ নাটকের সংগঠনের তিনি ছিলেন যুগ্ম আহবায়ক। তিনি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন কলকাতাতেও। এরকম আরো নানা ক্ষেত্রে বিচরণ ছিল কামাল ভাইয়ের। সামাজিক মূল্যবোধ চেতনা তাঁর অন্তরে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। তাই তিনি কখনও ভুল পথে নিজেকে পরিচালিত করেননি। সাংস্কৃতিক উগ্রতা নয়, সাংস্কৃতিক সৌম্যতার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথকে প্রশস্ত করে তুলেছিলেন কামাল ভাই।

সব্যসাচী কামাল ভাইয়ের অসামান্য দক্ষতার প্রদর্শন দেখে সত্যিই অবাক হয়ে ভাবতাম, একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে সব বিষয়ে এতটা পারদর্শী হওয়া সম্ভব? তিনি নিজে যেমন এসবের মাঝে যুক্ত ছিলেন, তেমনি আমাদেরকেও এসবের মাঝে জড়িয়ে ছিলেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মানুষকে মানবিক করে তোলে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় রিদ্ধ করে। অথচ কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল কামাল ভাইয়ের নামে গোয়েবলসীয় মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাঁর কর্ম,গুণ, আর্দশকে ধূলিসাৎ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে আমরা যারা তাঁর সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা জানি আমাদের কামাল ভাই, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল কেমন ছিলেন, কী করেছিলেন। আমাদের সত্য প্রকাশ করতে হয়নি, ইতিহাস নিজের দায়িত্বেই সব সত্য উদঘাটন করেছে। সকল অপপ্রচার খন্ডন করে দেশপ্রেমিক ও মানবিক হৃদয়ের অধিকারী কামাল ভাইকে বসিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। আজকের তরুণ প্রজš§ জানে বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল কেবল সেই সময়েই তরুণদের জন্যই অনুপ্রেরণার ছিলেন না, তিনি সর্বকালের সকল তরুণপ্রজšে§র জন্যই অনুসরণীয় অনুকরণীয় এক মহান পুরুষ।

বাহালুল মজনুন চুন্নু : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

SUMMARY

1698-1.jpg