১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা মনে হলে এখনো বুকটা কেঁপে ওঠে, চোখ ভিজে আসে। ওই দিনটি আমাদের জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তথা ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য হওয়ার কথা ছিল অত্যন্ত আনন্দ-উচ্ছ¡াসময়, স্মরণীয় একটি দিন। রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তাঁকে স্বাগত জানাতে, বরণ করতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিল। বেশ কদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে চলছিল সাজগোজ, আয়োজন, প্রস্তুতি।
আমরা যারা ছাত্রকর্মী, যারা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নানা প্রস্তুতিকাজে যুক্ত ছিলাম, আমাদের মধ্যে চলছিল দারুণ উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার খুব কাছ থেকে দেখতে পাব, শুনতে পাব তাঁর জাদুকরী কণ্ঠস্বর। সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য তাঁর নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনার কথা তিনি তুলে ধরবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে, যে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতের আঁধার কেটে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কানে এলো সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। ঘাতক মেজর ডালিমের নির্দয় কণ্ঠ ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই নিষ্ঠুর শব্দগুলো- ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে!’ বলে কী? এ-ও হতে পারে!
পাকিস্তানি জালেমরা অনেক ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করে যাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চেয়ে সফল হতে পারেনি, তাঁর বক্ষ ভেদ করেছে, তাঁরই সৃজিত স্বাধীন বাংলাদেশের কতিপয় কুলাঙ্গার বাঙালি সৈনিকের ছোড়া বুলেট! না না, এ হতে পারে না। এ মিথ্যা। এ অপপ্রচার। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রুরা, পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা নিশ্চয়ই কোনো গোপন বেতার থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। হ্যাঁ, প্রথম যখন শুনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা, তখন প্রাথমিকভাবে আমার মতো অনেকের এ রকমই মনে হয়েছিল। কারণ এ খবর ছিল অবিশ্বাস্য। আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়তে পারে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কীভাবে সম্ভব!
বেশ কয়েক দিন ধরেই সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলছিল পরিচ্ছন্নতা অভিযান। শিল্পীরা তৈরি করছিলেন দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও অন্যান্য উপকরণ। এর মধ্যেই ১৪ আগস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এলাকা, কার্জন হল ও অ্যানেক্স ভবনে একযোগে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভোরের দিকে জগন্নাথ হলের উত্তর গেটের (শামসুন্নাহার হলের উল্টো দিকে) দেয়ালে সাঁটা পাওয়া গিয়েছিল কাগজে তৈরি একটি ছোট্ট পাকিস্তানি পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগের দিনের এ ঘটনাগুলো সে সময় বিচ্ছিন্ন বলেই আমাদের কাছে মনে হয়েছিল। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘স্বাধীনতা’ দিবস, তাই হয়তো পাকিস্তানপন্থীরা এসব করে নিজেদের হারানো মনোবল ফিরে পাওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু পরে বোঝা গেছে, এগুলো ছিল তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।
তখন দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল। নাশকতা-অন্তর্ঘাতের মাত্রা বাড়ছিল। দুর্ভিক্ষের কবলেও পড়েছিল দেশ। সদ্য স্বাধীন দেশের সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল করার নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৭৫ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন দেশে সক্রিয় এবং ইচ্ছুক সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে বাকশাল।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তনে একদলীয় ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বৈকি। বাকশাল নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সন্দেহ-সংশয়। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে সমান আগ্রহ ছিল না। আবার বাকশাল এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা অর্থাৎ পদ-পদবি পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও ছিল অসন্তোষ-ক্ষোভ। পদবঞ্চিতরা ছিলেন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আবার যারা পদ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যেও বাকশাল ব্যবস্থার সাফল্য বা অগ্রযাত্রা নিয়ে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ছিল।
আওয়ামী লীগের মধ্যে অসন্তোষ ছিল ‘ক্ষমতার’ ভাগ যৎসামান্য হলেও অন্যদের হাতে চলে যাওয়ায়। আবার অন্যরা, বিশেষত বাকশাল নিয়ে অতিউৎসাহী বলে মনে হওয়া সিপিবি-ন্যাপও শেষ পর্যন্ত খুশি হতে পারেনি বাকশালের কমিটিতে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না থাকায়।
বাকশালের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে ন্যাপ-সিপিবির কেউ ঠাঁই পাননি। ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ অন্তত ওই কমিটিতে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। আবার আওয়ামী লীগের যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ছিল, যাদের নিয়ে বিতর্ক ছিল তাদের ঠিকই জায়গা হয়েছিল ওই কমিটিতে।
বাকশালের কমিটি গঠনের পর ন্যাপ-সিপিবির কর্মীরা অনেকটাই চুপসে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ন্যাপের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নামও ছিল না। আবার ন্যাপ যাকে পছন্দ করত না সেই সৈয়দ আলতাফ হোসেন কেবল বাকশালের কমিটিতে নয়, মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পেয়েছিলেন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ ছাড়া আর কোনো নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিংহ জাতীয় কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, মূল বাকশালে ছিলেন না।
২৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র ৫ জন। আবার ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ‘বহিষ্কৃত’ ডা. শাহাদৎ হোসেন ঠিকই ওই ২৩ জনের মধ্যে ছিলেন। ডা. শাহাদাৎ আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টুর ছোট ভাই। তখন অনেকেই ভেবেছিল, ছাত্র ইউনিয়নকে ‘জব্দ’ করার জন্যই শাহাদৎ হোসেনকে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছিল।
মোট কথা, বাকশাল গঠনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন গতিবেগ প্রতিষ্ঠার যে আশা ছিল, বাস্তব সে রকম ছিল না। বরং এক ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপরও ধরে নেয়া হচ্ছিল যে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাবে, কিছুটা সময় পেলে বঙ্গবন্ধু সবকিছু সামাল দিতে পারবেন। তখন সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই। মানুষের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশাই ছিল তাঁকে ঘিরে। এমনকি বাকশালে যেসব রাজনৈতিক দল ও নেতারা যোগ দিয়েছিলেন, সবাই তাঁর মুখ চেয়েই তা করেছিলেন।
আমার মনে আছে, ছাত্রকর্মীদের বাকশাল সম্পর্কে উৎসাহিত করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একটি সভায় পার্টির একজন প্রবীণ নেতা বলেছিলেন- ‘আশঙ্কার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি সমাজতন্ত্রের পথেই চলবেন।’
একজন ছাত্রকর্মী অকস্মাৎ প্রশ্ন করল- ‘বঙ্গবন্ধুর যদি কিছু হয়।’
ছাত্রকর্মী কথা শেষ করতে না করতেই আকাশে রাশিয়ার তৈরি একটি মিগ বিমান ওড়ার তীব্র শব্দ শোনা গেল। মিগের শব্দ শুনে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন- ‘দেখছ না, ঢাকার আকাশে রাশিয়ার মিগ উড়ছে। বঙ্গবন্ধুর কিছু হওয়া খুব সহজ নয়।’
বাকশাল গঠনের পর আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানা ¯্রােত বইছিল। আওয়ামী লীগে যারা রক্ষণশীল বা ডানপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, খন্দকার মোশতাক গং, তারা কিন্তু ‘ষড়যন্ত্র’ থেকে পিছু হটেনি। তারা চাপ দিয়ে বাকশাল এবং বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে যেমন জায়গা করে নিয়েছিল, তেমনি কমিটিতে ঢুকেও বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ব্যর্থ করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকেনি।
বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় আগমন আয়োজনের সমালোচনা করে একটি লিফলেট ছাপতে দেয়া হয়েছিল নবাবপুরের ভেতরের দিকে একটি ছাপাখানায়। ওই ছাপাখানার মালিক ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. মুশাররফ হোসেনের ভাই। লিফলেট ছাপার খবরটি যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, আগেভগে জেনে গিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এবং সে সময় জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কাজী আকরাম হোসেন। আকরাম ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওই প্রেসে গিয়ে ছাপা লিফলেটগুলো বিলি হওয়ার আগেই নষ্ট করে দিয়েছিলেন। ওই লিফলেট ছাপার পেছনে ছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগেরই একজন সদস্য, যিনি ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
আবার আসা যাক, সেই ভয়াবহ ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে। পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। প্রথমে তিনি জগন্নাথ হলে গণকবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে তারপর টিএসসিতে গিয়ে ভাষণ দেবেন। সে জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিক দিয়ে, অর্থাৎ জগন্নাথ হলের দক্ষিণ গেট দিয়ে ঢুকে উত্তরবাড়ির সামনে নির্মিত স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে হলের উত্তর গেট অর্থাৎ শামসুন্নাহার হলের সামনে দিয়ে বেরিয়ে টিএসসিতে যাবেন। যেহেতু তিনি জগন্নাথ হলে প্রথম আসবেন, সেহেতু হলের ছাত্র হিসেবে আমাদের ওপর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব ছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বানানো হয়েছিল বিশেষ ক্যাপ (টুপি) এবং স্কার্ফ। জগন্নাথ হলের উত্তরবাড়ির নিচতলায় একটি রুমে এসব টুপি ও স্কার্ফ রাখা ছিল, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণের জন্য।
১৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত আমরা ব্যস্ত ছিলাম। খুব অল্প সময় হয়তো ঘুমিয়েছিলাম। কারণ খুব ভোরে ওঠার গরজ ছিল। শেষরাতে ঘুম চোখেই গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে নানা আশঙ্কা তৈরি হলেও আমাদের এক ‘দাদা’ আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে কোনো হলের ছাত্ররা হয়তো বাজি ফুটিয়ে উল্লাস করছে।
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে প্রস্তুত হয়ে সকাল ৬টার মধ্যেই হলের উত্তরবাড়ির ক্যান্টিনে নাশতা করতে যাই। নাশতা শেষে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পান-সিগারেটের ছোট দোকানের সামনে আসতেই দোকানি কাঁপতে কাঁপতে ছোট একটি রেডিও আমার সামনে এগিয়ে ধরে বলেন- ‘বাবু, রেডিওতে এসব কী বলছে!’
আমি স্পষ্ট শুনতে পাই রেডিওর ঘোষণা- ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ আমারও হাত-পা কাঁপতে থাকে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। মুখ দিয়ে কোনো কথাও বের হয় না। পা অবশ হয়ে আসে। সামনে এগিয়ে কাউকে যে কিছু বলব তাও পারি না।
কয়েক মুহূর্ত এ রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকার পর চোখ যায় হলের স্মৃতিসৌধের দিকে। দেখি নিরাপত্তাকর্মীরা কী এক যন্ত্র দিয়ে মাঠ পরীক্ষা করছে। বঙ্গবন্ধু এখানে নামবেন এবং সৌধে ফুল দেবেন বলেই এই ব্যবস্থা। ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে রেডিওর ঘোষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে, তারা ধমক দিয়ে বলে ওঠেন- ‘কী গাঁজাখুরি কথা বলছেন? ওটা নিশ্চয়ই পাকিস্তানি রেডিওর কাজ।’
আহা, ধারণাটা যদি সত্যি হতো!
এর মধ্যেই লক্ষ করি হলের ছাত্ররা একে একে রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। সবার চোখেমুখেই আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ রেডিওতে ঘোষণা ক্রমাগত চলতে থাকায় বিহŸলতাও কাটছে না। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশ নিশ্চয়ই এখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ফেটে পড়বে।
জগন্নাথ হলে জাতীয় ছাত্রলীগের তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা থাকেন। তারা কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু বলতে পারলেন না। খবরাখবর জানার জন্য তারা দ্রুত হল থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। সত্যি কি বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই? কী হবে এখন তাহলে?
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে চেপে জগন্নাথ হলে আসেন জাতীয় ছাত্রলীগের প্রভাবশালী দুই নেতা, ইসমত কাদির গামা এবং কাজী আকরাম হোসেন। তারা জানান, ঘটনা সত্য। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসায় ঢুকে ঘাতকরা পরিবারের অন্য সদস্যসহ হত্যা করেছে।
এখন আমরা কী করব?
তারা বললেন- ‘আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাচ্ছি।’
তারা চলে গেলেন। হলের ছাত্ররা সবাই একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়ল। এতক্ষণ যে আশা-নিরাশার দ্ব›দ্ব চলছিল, এখন আর তা নেই। সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু আর নেই। সব শেষ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা যে উল্টো পথে যাত্রা শুরু করছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৫ আগস্ট প্রভাতেই বাংলাদেশ বেতারের নাম পাকিস্তানের স্টাইলে রেডিও বাংলাদেশ বলার মধ্য দিয়ে।
সবাই যখন কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছে কিন্তু হতবিহŸলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না, তখন আমার হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখেই আসি না কী ঘটেছে বা ঘটছে। এক বড় ভাইকে বলতেই তিনিও আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের উদ্দেশে।
জগন্নাথ হল থেকে বেরিয়ে দেখতে পাই শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হলের ভেতরে ছাত্রীরা ভয়ে-আতঙ্কে ছোটাছুটি করছেন। কেউ কেউ কান্নাকাটিও করছেন। চিৎকার করে জানতে চাইছেন, তারা কী করবেন সে কথা। কিন্তু কে তাদের করণীয় জানাবে? সবাই তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়-বিমূঢ়। বঙ্গবন্ধুকে কেউ মেরে ফেলতে পারে সেটা যেমন ছিল ভাবনার বাইরে, তেমনি তাকে হত্যা করলে কী করণীয় সেটাও যেন কারো ভাবনার মধ্যে নেই।
শামসুন্নাহার হলের সামনে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল- ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হোক জয়।’ তোরণ পার হওয়ার সময় লক্ষ করলাম, কেউ একজন কাঁচা হাতে এক কোণায় লিখে রেখেছে ‘দেশকে যারা গোষ্ঠীচক্রের হাত থেকে রক্ষা করল তাদের সালাম।’
আমার বিস্ময়ের শেষ থাকে না। মাত্র ঘণ্টা তিন-চারেকের মধ্যেই কে এই নতুন ¯েøাগান লিখল? সে কি খুব দূরের কেউ? নাকি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত-স্তাবকদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল?
আমি আর সেই বড় ভাই রোকেয়া হলের দিকে মোড় নেয়ার আগেই দেখতে পাই শাহবাগের দিক থেকে একটি ট্যাংক টিএসসির দিকে এগিয়ে আসছে। ট্যাংক আসতে দেখে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকে। আমরা নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি অতিক্রমের সময় দেখি ফাঁড়ির পুলিশরাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছাত্রদের কাছে তাদের কিছু করার আছে কিনা জানতে চাইছে। কিন্তু নির্দেশনা দেয়ার মতো কাউকেই যে পাওয়া যায়নি।
আমরা নিউ মার্কেট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডির দিকে এগোতে থাকি। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। দুয়েক জায়গায় ছোট জটলা। কেউ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছে না। কলাবাগান মাঠের কাছে গিয়ে দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কালো পোশাক পরা সামরিক লোকজন। রাস্তা ফাঁকা। আমার মনে হয়েছিল, অসংখ্য মানুষ হয়তো ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে ছুটে গেছে। কিন্তু তেমন কিছু না দেখে যারপরনাই হতাশ ও ব্যথিত হলাম।
মাত্র পাঁচ মাস আগে, ১৭ মার্চের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ৩২ নম্বরে নেমেছিল মানুষের ঢল। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে। দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে বঙ্গবন্ধু সমাগত জনতার প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, ছাত্রদের মিছিল পৌঁছানোর পর তিনি নিচে নেমে আসেন। নিরাপত্তার কথা না ভেবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে মিশে যান। এমন একজন হৃদয়বান দেশঅন্তঃপ্রাণ নেতাকে আজ সপরিবারে হত্যা করল যারা, তারা কেমন মানুষ? আদৌ কি তারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে?
আমি আর সেই বড় ভাই ঘুরপথে ভেতর দিয়ে ৩২ নম্বরের কাছাকাছি সড়কে উপস্থিত হই। কিন্তু মূল সড়কে যেতে আমাদের বাধা দেয়া হয়। এখানেও ওই কালো পোশাকধারীদেরই অস্ত্র হাতে পাহারা দিতে দেখি। একজন সৈনিকের কাছে আমি ঘটনা জানতে চাইলে ওই সৈনিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বলে- ‘মুজিবের গুষ্টি শেষ!’ আমি জানতে চাই- ‘সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে? আপনারা কারা? আপনাদের নেতা কে?’
আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ওই সৈনিক ‘ভাগ ভাগ’ বলতে থাকে। আমরা একটু সরে যাই, কিন্তু চলে যাই না। আবারো আগের প্রশ্ন করি। এবার সৈনিকটি চোখ পাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখিয়ে বলে- ‘ওর ভেতরে কেউ আর জীবিত নেই!’
আমাদের আর কিছু জানতে ইচ্ছে হয় না। হাত-পা আবার অবশ হয়ে আসে। মাথায় কোনো চিন্তা আসে না। কোথায় কী হচ্ছে জানার ইচ্ছা হয় না। আমরাই বা কী করব বুঝে উঠতে পারি না। কোথায় যাব, কী করা উচিত কিছুই ঠিক করতে না পেরে ৩২ নম্বরের উল্টো দিকের এক গলিপথে বসে পড়ি। মনে হতে থাকে, ওখান থেকে আর বোধহয় উঠতে পারব না।
সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজ পড়ার জন্য দলে দলে মানুষকে মসজিদের দিকে যেতে দেখি। এর আগে ঢাকা শহরে এত নামাজি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হঠাৎ আমার ভেতর একটি ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ভালো হবে যদি নামাজ শেষে এই মানুষেরা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে। আমিও ওই মিছিলে শামিল হবো। কিন্তু নামাজ শেষে কাউকে মিছিল করতে দেখি না। কারো মুখে ¯েøাগান নেই। সবাই চুপচাপ। যার যার গন্তব্যে সবাই হাঁটতে থাকে। এ কি অধিক শোকে পাথর, নাকি অন্য কিছু? মানুষের এই প্রতিক্রিয়া আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। বঙ্গবন্ধু এত বড় নেতা। এত তাঁর ভক্ত। অথচ তাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মানুষের এই নীরবতার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়। আমরা বসে থাকি কলাবাগানের এক গলির মধ্যে। হলে ফিরব কি না, ফিরলে কী হবে সেসব যখন ভাবছি, তখন সঙ্গী বড় ভাই প্রস্তাব দেন কলাবাগানে তার এক বোন-ভগ্নিপতির বাসায় যাওয়ার। খুব কিছু না ভেবেই সন্ধ্যার দিকে ওই বাসায় গিয়ে উঠি আমরা দুজন। আমাদের দেখে বোন-ভগ্নিপতি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আমরাও অশ্রæ সংবরণ করতে পারি না। এভাবে কতক্ষণ অশ্রæপাতের পর যেন কিছুটা হালকা বোধ করলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্য আর কিছু না হোক কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলার সান্ত¡না নিয়েই কেটে যায় ঘোর দুঃস্বপ্নের ১৫ আগস্ট দিনটি।
আমাদের পেটে সারাদিন আর দানাপানি পড়েনি। যে বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম সে বাসায়ও সারাদিন চুলায় হাঁড়ি চড়েনি। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সেদিন এটাই আমার কাছে এক ধরনের প্রতিবাদ বলে মনে হয়েছিল।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক, কলাম লেখক।