১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাঁর বাসভবনে পরিবারের সদস্যদেরসহ হত্যা করা হয়। একই সময় তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ এবং নিকটাত্মীয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনিসহ উভয় পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডে দৃশ্যত সেনাবাহিনীর কয়েকটি ট্যাংক ও কিছু গুলি-বন্দুক ব্যবহার করা হয়, সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক সাবেক ও তৎকালীন অফিসার অংশ নেয়। সেনাবাহিনীর দুর্বল চেইন অব কমান্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে নীলনকশায় অংশ নেয়া হত্যাকারীরা এগিয়ে গেলেও এর পেছনে ছিল মূল পরিকল্পনাকারীদের বিভিন্ন অংশ- যারা একের পর এক তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করার বিষয়টিও তাদের পূর্ব নির্ধারিত ছিল। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকারের শূন্যতা পূরণ করতে দেয়া হয়নি। সংবিধান ভঙ্গ করে খন্দকার মোশতাককে সরকারপ্রধান তথা রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে যে সরকার গঠিত হয় সেটিও ছিল তাদেরই নীলনকশার, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদেও অচিরেই যে পরিবর্তন আনা হয় সেটিও ছিল একই সুতোয় গাঁথা। জাতীয় চারনেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রথমে গৃহবন্দি পরে জেলে প্রেরণ করাসহ যাবতীয় কার্যক্রম ছিল শতভাগ নেপথ্যের শক্তির পরিকল্পনা মোতাবেক। তখনো বঙ্গবন্ধু সরকার এবং দলের রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই বুঝতে পারেনি- কেন বঙ্গবন্ধুকে আকস্মিকভাবে হত্যা করা হলো, কারা এর নেপথ্যশক্তি, কী তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার খুব বেশি স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। তবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্ম, ভারত এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের নানা কল্পকাহিনীকে দ্রুতই বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হলো। কেউ যেন শক্ত প্রতিরোধ দাঁড় করাতে না পারে সে জন্য সামরিক বাহিনীর ট্যাংক, কামান, বন্দুক ও বাহিনীর শক্তিকে সম্মুখে পরিকল্পিতভাবেই আনা হলো, সেনাবাহিনীর ভেতরের বিষয়গুলো বাইরে খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। বস্তুত ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, অনেকেই সরকার পরিবর্তনের এহেন ঘটনাবলির রহস্য ভেদ করার পর্যায়ে ছিল না। এর কিছু বাস্তবতা তখন স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বোধগম্য হয়।
আসলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার বিষয়টিকে তৎকালীন রাজনৈতিক শক্তিসমূহ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী শক্তিসমূহ খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে উপলব্ধি করে নিজেদের করণীয় দায়িত্ব পালনে তৎপর ছিল- এমনটি বলা যাবে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রকৃত অবস্থা অনেকেই অনুধাবনে সক্ষম ছিল না। সর্বত্রই বাস্তবতা ও আকাক্সক্ষার মধ্যে দূরত্ব যুক্তিহীনভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বৈরী অবস্থাও অনেকের বিবেচনায় ছিল না। নতুন রাষ্ট্র গঠনে যে ধরনের পরিমিত বোধ রাজনৈতিক চিন্তা, ধৈর্য ও প্রত্যাশার রূপান্তর ঘটানোর প্রয়োজন ছিল বাস্তবে ঘটেছিল ভিন্ন কিছু, চাওয়া, পাওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তববোধের চাইতে উগ্র, হঠকারিতা, স্বার্থবাদিতা, দ্রুত উচ্চাসনে ওঠার প্রবণতা, আবেগ অযৌক্তিকভাবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু, সরকার, দল, প্রশাসন, রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতির দায়বদ্ধতার চাইতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ, প্রাপ্তি ও ভাবাবেগের বিষয়সমূহ অনেক বেশি চাঙ্গা ছিল। অথচ এমন যুদ্ধপীড়িত দেশের পক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সব চাহিদা পূরণ করা তখন মোটেও সহজ ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে ধরনের জাতীয় ঐক্য মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গড়ে উঠেছিল, যুদ্ধ শেষে সবার প্রাপ্তির জায়গাসমূহে মুখ্য হয়ে উঠতে থাকায় দূরত্ব তৈরি হতে থাকে, বাস্তবতা বিবর্জিত ধারণাও সর্বত্র বিস্তৃত হতে থাকে যা শত্রুপক্ষের ভালোভাবে জানা ছিল। বিশেষত তখনকার দুনিয়ায় এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়া সদ্য স্বাধীন দেশগুলো কেবলই হাঁটি হাঁটি পা করে এগুচ্ছিল, এদের কারোই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত তখনো সবল হয়ে ওঠেনি, স্বাধীনভাবে নিজ নিজ পছন্দের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়নি। ফলে পরাধীন ও স্বাধীন- এই দুই পর্বের বাস্তবতায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যে মনোজাগতিক উল্লম্ফন তৈরি হয় সেটিকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এবং তাদের দেশীয় দোসরগোষ্ঠী কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠে। এদের হাতেই সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর নতুন নতুন সরকারপ্রধানরা- যারা এক সময় মুক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- তাদের অনেকেই ক্ষমতাচ্যুত হয়, নিহত হয়, দেশ থেকে বিতাড়িতও হয়। সময়টি স্বাধীনতার হলেও চরম অস্থিরতার ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আধুনিক একটি শোষণহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন, কিন্তু সেসব নিয়েও ছিল নানা টানাপড়েন, সমালোচনা, উগ্র হঠকারী গোষ্ঠীর নানা বিভ্রান্তি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা তখন উপস্থাপনের চাইতে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগসমূহকে বিতর্কিত করা ছিল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কতির প্রবণতা, এর ফলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক ধরনের হতাশা তৈরি করা হয়, দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ নিয়েও নানা বিভ্রান্তি এবং সমস্যা ছিল।
আমাদের মতো পশ্চাৎপদ সমাজ চিন্তার দেশে এ ধরনের হতাশা, আশা-নিরাশার দোলাচল ঘটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সে সবের অবসান ঘটার স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে অভিজ্ঞতার পর্ব পার করা, রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। সেটিতে সব মহলের মধ্যে বোঝার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু দ্রুত নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটিয়ে উত্তরণের পদক্ষেপ নিলে শত্রুপক্ষ বুঝতে পারে যে, অচিরেই বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যেতে পারে। সে কারণেই তারা দেরি না করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পথ ও উপায় খুঁজতে থাকে, তারা বুঝতে পারে যে, বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রেখে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তাই তারা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যেই গভীর রাতে তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে, বাড়িতে অবস্থানরত পরিবারের সব সদস্য, সেরনিয়াবাত এবং শেখ মনির পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। এর মধ্য দিয়ে যাতে কেউ ঘুরে দাঁড়াতে সাহস না পায়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা রক্তাক্ত পথকে শুরুতেই সম্মুখে নিয়ে আসে, রাজনৈতিকভাবে খন্দকার মোশতাককে দিয়ে সাময়িক রথযাত্রা প্রদর্শন করে। এই সময়ে জেলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হয়, স্বাধীনতাবিরোধী, হঠকারী চক্র, ভারতবিরোধীদের মাঠে নামিয়ে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করে- যা থেকে উত্তরণের জন্য জনমানসে সামরিক বাহিনীকে আশীর্বাদ হিসেবে সমর্থন করার পাকিস্তানকালীন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়। ১৯৫৮ সালে যেমন নেপথ্যের শক্তির মূল চয়েজ আইয়ুব খানকে সম্মুখে নিয়ে আসা হয়েছিল, ১৫ আগস্ট- উত্তর সামরিক বাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসা হলো। দেশ পুরোপুরি সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ক্ষমতার আসন থেকে ঘোষণা করা হলো রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে দেয়া হবে। এর মর্মার্থ অচিরেই বোঝা গেল। অঘোষিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করা হলো, সংবিধানকে সামরিক ফরমান বলে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে ঢেলে সাজানো হলো, জাতীয়তাবাদ নিয়ে একটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির বীজ বপন করা হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা বিরোধিতা করেছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নামে তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হলো, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং উগ্র, হঠকারী বাম রাজনীতির কিছু পরিচিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এবং ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দান, জয়ী করে আনা এবং সরকার গঠনে প্রাধান্য দেয়া হয়। বাংলাদেশকে এরই মধ্যে পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশসমূহের ‘বন্ধুরাষ্ট্রে’ পরিণত করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ যেসব দেশ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধকালে সহযোগিতা প্রদান করেছিল সেগুলো থেকে দূরে সরিয়ে আনা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বকে জোরদার করা হলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ মার্কিন, চীন, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশসমূহের বলয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
দেশের অভ্যন্তরে বিষয়টিকে নিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রচারণা জাগ্রত করা হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে দ্বিজাতিতাত্তি¡ক ভাবাদর্শের আদলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রচারণাকে গুরুত্ব দেয়া হলো। আমরা বাঙালি, নাকি বাংলাদেশি- এমন প্রচারণা বাঙালিকে ‘হিন্দুত্ব’ এবং ভারত সংশ্লিষ্ট, বাংলাদেশিকে বাংলাদেশের বিশুদ্ধ ‘জাতিসত্তা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ বাঙালি জাতীয়তা ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ অন্যদিকে বাংলাদেশি পরিচয় রাষ্ট্রের নাগরিকতার ধারণাপ্রসূত বিষয়। জাতীয়তা ও নাগরিকতার ধারণাকে নিয়ে দেশে একটি তালগোল পাকিয়ে ফেলার আয়োজন করা হয়- যা ছিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে মানুষকে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্য পরিকল্পনা। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পঠন-পাঠনের উদ্যোগ স্কুল পর্যায়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা হয়, ২৭ মার্চ ১৯৭১ চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দেয়ার লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭৫ থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পাকিস্তানিকরণ সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরেও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে, নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সেনাবাহিনীর ভেতরে একের পর এক সৃষ্টি হয়, বেশ সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন একদিকে সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী, উগ্র হঠকারীদের দৌরাত্ম্যও একচেটিয়া প্রভাব বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের শক্তিসমূহকে নানাভাবে বিভক্ত এবং দুর্বল করার সব ষড়যন্ত্রই একের পর এক অব্যাহত রাখা হয়।
১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য শক্তির স্বরূপ যদিও এ পর্যন্ত উন্মোচন করা হয়নি, তবে সেনা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমানের তেলেজলে মেশানোর প্রতিক্রিয়া থেকেই হয়তো তাকে জীবন দিতে হলো। নেপথ্যের শক্তির হিসাব তখন আরো ডানে প্রবাহিত হয়ে থাকতে পারে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সে রকমই ধারণা প্রদান করে। সাত্তার সাহেব জিয়াউর রহমানের অনুপস্থিতিতে সরকার বা দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। সরকারের ক্ষমতা চলে যায় এরশাদের হাতে, দলের একাংশ এরশাদের পেছনে ছুটে, অন্য অংশ খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়ায়। এরশাদ জিয়া সূচিত রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিই অব্যাহত রেখেছিল। ফলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি পঁচাত্তর-পরবর্তী পাকিস্তানি ধারাতেই ভিত পোক্ত করতে থাকে। এ সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারায় যাতে ফিরে যেতে না পারে সে জন্য নেপথ্যের মুক্তি দাবার ঘুঁটির পরিবর্তন ঘটানোর কাজটি সুকৌশলে করেছে, গণতান্ত্রিক বৈধতা দানের আয়োজন সম্পন্ন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ততদিনেও বুঝতে পারেনি ১৯৭৫-এর ভূত পাকিস্তানি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ১৯৯১ সালে বিতাড়িত হয়নি- কেননা তারা যে আন্দোলন আশির দশকে করেছিল তাতে তেলেজলে মিশে যাওয়ার পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি স্পষ্ট ছিল না, সে কারণে সুফল বিএনপির ঘরে চলে যায়, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিসমূহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ব্যর্থ হলো, পাকিস্তানিকরণের রাজনীতির কাছে কৌশলগতভাবে আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসার পর দ্বিতীয় পাকিস্তান তৈরির সব শক্তি ১৯৯৯ সালে জোট গঠন করে, ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই জোট বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে দ্বিতীয় পাকিস্তান তৈরির এজেন্ডা বাস্তবায়নের গুরুদায়িত্ব হাতে নেয়। ১৯৭৫-পরবর্তী নেপথ্য শক্তির নেপথ্যের রাজনীতি কীভাবে সংহত হয়েছে, কীভাবে তারা জোটবদ্ধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ‘গণতান্ত্রিক’ভাবে দখলের বৈধতা পেয়েছে, শক্তি অর্জন করেছে- তা বাহ্যিকভাবে বিস্ময়কর মনে হলেও পঁচাত্তর-পরবর্তী চার দশকের রাজনীতির উত্থান ও বিকাশের স্বরূপ উন্মোচন করা গেলে এটিই আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কখনই সুসংগঠিতভাবে অগ্রসর করার দায়িত্ব কেউ পালন করেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এলেও বাংলাদেশকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি, অবশ্য বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার সুযোগ কিছুটা সৃষ্টি হয়।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।