বঙ্গবন্ধুর লীগ ও আজকের লীগ


স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু সরকার সিদ্ধান্ত নেন একাত্তরের ঘরশত্রু বিভীষণদের গণক্ষমা করে দেবেন। তার একটা তালিকা বা হিসাবও ছিল। কারা সে আওতায় পড়বে আর কারা পড়বে না। তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী পাকিমিত্র দেশীয় দালাল রাজাকারেরা একটা সভা করেছিল। সে সভায় খান এ সবুরের মতো ডাকসাইটে মুসলিম লীগারও ছিলেন। তারা বলেছিল, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে পাওয়া জীবনের কারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে তাদের দ্বিতীয় পিতা মানেন। তাদের জন্মদাতা পিতার দেয়া জীবন যখন খতম হবার পথে তখন তাদের নতুন জীবন ফিরিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। জাতির জনক হিসেবে যিনি এই কাজ করতেই পারেন। কিন্তু তারা কি তাদের কথা রেখেছিল? এই মানুষগুলো জেল থেকে ছাড়া পাবার পর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে সরানোর নোংরা কাজে ব্যস্ত ছিল।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে দুটো ধারা স্বাধীনতার পর থেকে একদিনের জন্য ও থামেনি। একটি মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি পাকিপ্রেমের। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য পাকিস্তানপ্রীতির ধারাটি দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল । যার পেছনে মদদ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের দল। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে বাংলাদেশ চলছিল উদ্ভট উটের পিঠে। কেউ ভাবেনি এমন সময় আসবে বা এমন একদিন আসবে যেদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জেগে উঠবে তার আপন শক্তিতে। আদর্শ যদি না থাকতো, যদি না থাকতো চেতনা, জাহানারা ইমামের ডাকে কি গণআদালত সারাদেশ নাড়িয়ে দিতে পারতো? সে বীজ থেকে জন্ম নেয়া গাছের ফল আমরা পেয়েছি শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায়। আদর্শ আর ভালোবাসায় গড়ে ওঠা গণজাগরণের ফলাফলে মানুষের বিশ্বাসের বলে বলীয়ান দেশ দেখলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি।

সে ইতিহাস মাত্র সেদিনের। যারা সরকারে থাকায় আমরা এই বিচার পেয়ে ইতিহাসকে শুদ্ধ ভাবলাম, সে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, রাজাকারের সন্তানেরাও নাকি তাদের দল করতে পারবে। কোন দল কে করবে কেন করবে সেটা যার যার পছন্দের ব্যাপার। দুনিয়া অনেক দেশে এককালে ভুল পথে যাওয়া মানুষেরা সঠিক পথে ফিরে এসেছেন। গৃহযুদ্ধে বিপ্লবের নামে নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করা পলপটের দেশে দেখেছি সে দেশের রাজাকারেরা মাফ চেয়ে জনতার কাছে ফিরে আসতে চেয়েছে। তাদের সেই চিঠিগুলো তাদের ভুলের বর্ণনা আর লজ্জার দলিল। তাদের মাফ চাওয়া ছিল জাতির কাছে ফিরে যাওয়ার সদিচ্ছা। আচ্ছা আমাদের দেশে কোনোদিন এমন একটি ঘটনাও দেখেছেন? বরং দলে দলে মুক্তিযুদ্ধের লোকেরা তরী ভিড়িয়েছেন রাজাকারদের বন্দরে।

সেই সমাজে আজো আমরা বহুধাবিভক্ত। যিনি রাজাকার সন্তানদের দলে আসতে আপত্তি নাই বলছেন তিনি এও বলছেন বিলেতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। ম্যাডাম জিয়া গেছেন ছেলের কাছে, চিকিৎসার জন্য। অথচ উনারা বলছেন তিনি গেছেন নীল নকশা আঁটতে। তাহলে এই নকশা বাস্তবায়ন করবে কারা? তাদের নকশা সফল হলে দেশে তার ঝাণ্ডা উড়াবে কারা? মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা? না রাজাকারদের ছানাপোনারা? সে সত্য জানার পরও এই ধরণের বিভ্রান্তি ও তর্কের কথা আসলে কাদের শক্তিশালী করবে কাদের সাহেব?

কেউ যদি দাসখত দিয়ে মন মগজ বিবেক সাফ করে আসতে চায় তার কথা আলাদা। আর যারা সরকারে আছে বলে আওয়ামী লীগে ঢুকে কাজকর্ম উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় তারা কি এক?

বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুরর মাস আগস্ট। আমরা বলি শোকের মাস। এমন মাসে এমন একটি বিষয় যে কারণে সামনে এলো তার পেছনে আসলে কী আছে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ করতে হলে জন্ম থকে করতে হবে এমন একটা ফালতু কথাও এখন সামাজিক মিডিয়ায় ভাসছে। সেটা যেমন ঠিক না, তেমনি রাজাকারের সন্তানেরা ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে ঢুকে দেশ ও জাতির সর্বনাশের পথ খুলে দিতে পারবে সেটাও মানা যায় না। রাজনীতি যদি এখনই এর বিহিত না করে, দেরি হয়ে গেলে জটিলতার গিঁট খোলা সহজ হবে না।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

SUMMARY

1690-1.png