মহানায়ক বঙ্গবন্ধু

তোয়াব খান
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা প্রথমেই আমার হয়েছে, সেটা হচ্ছে— তিনি শুধুমাত্র জাতির জনক, দেশের প্রতিষ্ঠাতা— এগুলোই ছিলেন না— সত্যিকার অর্থে একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিটি পদক্ষেপেই ছাপ রেখেছেন। প্রথমত ভয়াবহ রকম যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে আবার দাঁড় করানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো প্রয়োজন হয়— তা একে একে সবই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সড়ক, রেল ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা— যুদ্ধে অচল হয়ে যাওয়া বন্দরগুলোকে চালু করা, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্যের সংস্থান, প্রশাসনিক কাঠামোকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলা— বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনিক দূরদর্শিতারই পরিচায়ক।
 
মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি বিধ্বস্ত দেশের প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে একটি স্বাধীন জাতির উপযোগী করে গড়ে তোলা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। এ কথা সবাই জানেন, পাকিস্তানের এ অংশে কোনো সময়ই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় তথা স্টেট ব্যাংকের কার্যক্রম এসবের কোনো কিছুই ছিল না। এ জন্য বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই এ অবকাঠামোগুলো গড়ে তোলার দিকে নজর দেন। এবং জাতি কিছুকালের মধ্যেই এ পদক্ষেপের সুফলটা প্রত্যক্ষ করে।
 
দ্বিতীয়ত আজীবন জনগণের জন্য সংগ্রামের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক জীবন বঙ্গবন্ধুকে রূপান্তরিত করেছিল সত্যিকারের জননায়কে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বঙ্গবন্ধুকে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রনায়ক বা জাতির জনক হিসেবেই দেখিনি, দেখেছি বাঙালির মহানায়ক হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার মতো অন্য যারাও কাজ করতেন তারাও শুধুমাত্র প্রশাসনিক কর্তব্য সম্পাদনে নিয়োজিত ছিলেন বলেই আমার মনে হয়নি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু সাধারণভাবে কথাটি সত্যি।
 
জননায়ক ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংবেদনশীল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে— রাজনীতি তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যে কোনো ব্যক্তি অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারতেন তাঁর কাছে। এমনও হয়েছে গুরুতর অভিযোগে আটক কোনো ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয় বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে যে মুহূর্তে আবেদন জানিয়েছেন সুবিচারের জন্য— তাদের কোনো সময়ই বিমুখ হতে হয়নি। এমনও দেখা গেছে, এক শহীদের সন্তান গুরুতর একটি অভিযোগে আটক হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে গোপনে সশস্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। তার আটকের পর তার মা বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদন জানান। বঙ্গবন্ধু মা ও ছেলে দুজনকেই তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বলেন। মা ও সন্তানের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে কী ঘটেছিল তা আমি জানি না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম মা ও ছেলে একসঙ্গে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। পরে অবশ্য শুনেছি, ছেলেটি বঙ্গবন্ধুর সামনে এসে কিছু সময় কথাবার্তার পর বঙ্গবন্ধুকে গভীর আবেগে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এবং নিজেকে সঠিক পথে নিয়ে আসার ওয়াদা করে। এমনই ছিল বঙ্গবন্ধুর সংবেদনশীল হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রমই নয়, ব্যক্তিগত আচার ব্যবহার এবং সহৃদয়তার ফলে জাতি বহুভাবেই উপকৃত হয়েছে।
 
কূটনীতি ও রাষ্ট্রাচারের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও সহনশীল আচরণের প্রতিফলন দেখা যায়। বাংলাদেশ প্রথম কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান করে অটোয়ায়। কমনওয়েলথ সম্মেলন শুরুর আগের দিন কমনওয়েলথ মহাসচিব গণমাধ্যমের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন। এই সংবর্ধনায় রাষ্ট্র-সরকার প্রধানরাও অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু এই সংবর্ধনায় উপস্থিত হলেন। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে।
 
বঙ্গবন্ধু-শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করছিলেন। 
 
আলাপের মাঝখানে যোগ দিলেন শ্রীমাভো কন্যা যিনি পরবর্তীকালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক কত গভীর ও সুপ্রাচীন। এটা বোঝানোর জন্য তিনি একটি কবিতার পঙিক্ত উল্লেখ করেন, ‘বাংলার ছেলে বিজয় সিংহ, হেলায় করিলো লঙ্কা জয়’। বঙ্গবন্ধু বোঝাতে চেয়েছিলেন বিজয় সিংহের সময় থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
 
চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা ওই সময়ই বললেন, আপনি কী বিজয় সিংহের মতো শ্রীলঙ্কা জয় তথা দখল করতে চান? বঙ্গবন্ধু ক্ষণিক চুপ করে থেকে বললেন, নিশ্চয়ই জয় করতে চাই। তবে তোমাদের দেশ নয়। তোমাদের হৃদয়কে জয় করতে চাই। এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রাচারের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অনন্য উদাহরণ।
 
এই অনুষ্ঠানে নাইজেরিয়ার তত্কালীন রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াকুবু গাওয়ান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে কিছু চাইলেন, যা তিনি দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্মারক হিসেবে রক্ষা করবেন। বঙ্গবন্ধু তত্ক্ষণাৎ তাঁর গায়ের শালটি ইয়াকুবু গাওয়ানের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন আমার এই ক্ষুদ্র উপহারটি আমাদের দু’দেশের সম্পর্ক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করবে।
 
ইয়াকুবু গাওয়ান বিস্ময় ও আপ্লুত আবেগে হতবাক।
 
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বরেণ্য সাংবাদিক

SUMMARY

169-1.jpg