লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ওই দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমান। হোটেল লবিতে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যত দ্রুত দেশে ফিরতে চাই। আমার জনগণকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না।’ মহান নেতার এ কথায় অভিভূত হয়ে পড়েন ব্রিটেনের সাংবাদিকরা। প্রায় দশ মাস পাকিস্তানের কারাগারে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান পুরুষ মুক্তি লাভ করে আগে ভাবছেন তার দেশের জনগণের কথা। স্মরণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জনগণের আত্মত্যাগের কথা। বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্য অভিভূত হওয়ার মতো বিশাল ঘটনা তখনো অপেক্ষা করছিল সামনে। দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরার পথে ভারতের জনগণ যে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিল বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে, তাতে মুগ্ধ হয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষ। চমৎকৃত হয়েছিল ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিত্র দেখে। মুক্তিকামী একটি জাতির হৃদয়ের আশা-আকাক্সক্ষার কতটা ধারণা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব হওয়া যায়, সারা বিশ্ব তা উপলব্ধি করেছিল।
২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জন করল বাঙালি। কিন্তু বিজয়ের সে আনন্দ যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল। যে মহামানবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনতে ১৯৬৯-এ বাংলার মানুষ সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড ভাঙার জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠেছিল, যে মহানায়ক ১৯৭১-এর ৭ মার্চ চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়ে জনতাকে উজ্জীবিত করলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলার মানুষ বিজয়ের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছিল না। যুদ্ধকালীন নয় মাস বাংলার ঘরে ঘরে নির্যাতিত মানুষ প্রার্থনা করেছে বঙ্গবন্ধুর জন্য। বিজয় অর্জনের পর ২৫ দিন আশঙ্কার দোলাচলে দুলেছে মানুষ। অবশেষে জানা গেল বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। দেশে আসছেন। সে সংবাদ পাওয়ার পর গোটা দেশে কী পরিমাণ আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।
জানুয়ারির ৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওয়ানা হন। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের ৬৩৫ নং ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’-এ ওঠেন। এখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাঁর প্রতি সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, তিনি কেন ঢাকা না গিয়ে প্রথমে ব্রিটেনে এসেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারের। আমি তাদের বন্দি ছিলাম।’
লন্ডনে অবস্থানকাল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সুনির্দিষ্ট সময় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গবন্ধুর এ কথা প্রচারের কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সন্ধ্যায় তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু তার বন্দি জীবনের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করতে অনুরোধ জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম। অনেক কিছুই আমার জানার উপায় ছিল না। আমি ঢাকায় ফিরে আমার দেশবাসীর কাছে সব জানব।’
ব্রিটিশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৫১ বছর বয়সী সুঠামদেহী শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কৃশকায় দেখাচ্ছিল। দীর্ঘদিনের বন্দি জীবনের ছাপ পড়েছিল তার চেহারায়। তা সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি কথা উচ্চারণ করেছেন। যত দ্রুত দেশে ফেরার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ছেড়ে আর এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না। তারা প্রত্যেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চরম মূল্য দিয়েছে।’ ২০ মিনিট সংবাদ সম্মেলন শেষে বঙ্গবন্ধু জানান তিনি খুব ক্লান্ত। দৃঢ় কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। এ সময় হোটেলের বাইরে সমবেত প্রবাসী বাঙালিরা ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বেশ কিছু সময় নীরবতা অবলম্বন করে। রাত ৩টায় রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা দেয় হয়, ‘শেখ মুজিব’ বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে ‘শেখ মুজিব’কে বিদায় জানিয়েছেন।
এ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার আপামর জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। ৮ তারিখেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভুট্টো যদি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিন।’ তাজউদ্দীন বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করতে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভয় পাই না।’ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা ও চীনের ন্যক্কারজনক ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান।
ওইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের তুলনায় কিছুই নয়। অথচ মহাপরাক্রমশালী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাসার সামনে। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এডওয়ার্ড হিথ যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার হোটেল কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু দিল্লির উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেন।
১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রয়েল এয়ার ফোর্স কমেটে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দৃপ্ত পায়ে বিমান থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার নয়নের মণি। এই সময় তাঁর পরনে ছিল গাঢ় ধূসর রঙের স্যুট এবং কালো ওভারকোট। তিনি বিমান থেকে নামার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি কয়েক মিনিট তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরেন প্রিয় নেতাকে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু নেমে আসেন। ২১ বার তোপধ্বনি করে ভারত অভিবাদন জানায় বাংলাদেশের মহান নেতাকে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্বের ২০টির বেশি রাষ্ট্রের ক‚টনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। তিন বাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। পুরো এলাকা বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় সজ্জিত ছিল। আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বাজছিল যখন বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর স্যালুট গ্রহণ করছিলেন। দিল্লি সেনানিবাসে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভায় ভাষণ দেন। এ সময় এক মাইলের বেশি এলাকাজুড়ে মানুষ গিজ গিজ করছিল, সবাই শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এক নজর দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে এসেছিল। এরপর বঙ্গবন্ধু একটি মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িতে চড়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। পুরোটা পথের দুধারে সুসজ্জিত ব্যানার ছিল। যাতে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের ¯্রষ্টা দীর্ঘজীবী হোক’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক দীর্ঘজীবী হোক।’ শত শত মোটর গাড়ি অনুসরণ করছিল রাষ্ট্রীয় অতিথির গাড়ি বহরকে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করেন।
সকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছিল। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্বে ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানের পাইলটরা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বিমানটিকে নিয়ে ঢাকার আকাশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে প্রাণভরে দেখেন তাঁর সোনার বাংলাকে।
অবশেষে এল সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান নেতা এসে দাঁড়ালেন তার প্রিয় জনগণের মধ্যে। বাংলার মানুষ আন্দাশ্রæ আর ফুলের মালায় বরণ করে নিল প্রিয় নেতাকে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ইজেলে আঁকা স্বাধীনতা নামক অমর চিত্রে তুলির শেষ আঁচড় পড়ল। পূর্ণ হলো স্বাধীনতার আনন্দ। যার বহিঃপ্রকাশ হৃদয়ের গভীরতম অনুভবে চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিল বাংলার পবিত্র মাটিতে। ৩১ বার তোপধ্বনি হয় তেজগাঁও বিমানবন্দরে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এবং মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা স্বাগত জানান প্রিয় নেতাকে। অগণিত ফুলের মালা আর লাখো জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ¯েøাগানের মধ্যে অশ্রæসিক্ত বঙ্গবন্ধু জড়িয়ে ধরেন প্রিয় জনগণকে। তাকে বহনকারী গাড়িটি জনতার ভিড়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে এগুতে থাকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে।
তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বহনকারী ট্রাকটি লাখ লাখ জনতার মধ্য দিয়ে পিঁপড়ার মতো হেঁটে প্রায় দুঘণ্টায় ঐতিহাসিক সেই রমনার ময়দানে পৌঁছে। বঙ্গবন্ধু আবার এসে দাঁড়ালেন, যেখান থেকে তিনি শেষ আহ্বান বাঙালি জাতিকে জানিয়েছিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন : ‘আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি। লাখ লাখ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে…’ তখন এমন কোনো বাঙালি মাঠে ছিল না, যার নিজের চোখেও পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি।
কান্না ছিল সেদিনের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিল লাখো মানুষ। যুগে যুগে অনেক কেঁদেছে বাঙালি, অনেক কান্না বুকের রক্ত হয়ে ঝরেছে। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য অসীম মমতার আবাস যে মহামানবের বুকে, তাঁকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল বাঙালি অঝোরে কেঁদেছে ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি। আর তিনি কাঁদছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রাণাধিক প্রিয় জনতার মাঝে আসতে পেরে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালি অনুভব করেছিল জাতি হিসেবে আবহমান যে সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার তার রয়েছে পাকিস্তান কাঠামোয় সে ঐতিহ্য এবং গৌরবের লালন ও বিকাশ অসম্ভব। আর তাই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় সে সংঘাতের প্রথম স্মারক। এরপর থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতারা এগিয়ে নিয়েছেন বাঙালিকে জাতি হিসেবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে। কিন্তু তাদের কেউই চেতনার ভিত্তিমূলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহী অনুভবে উদ্দীপ্ত করতে পারেননি বাংলার মানুষকে। যা সম্ভব ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। আর তাই ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার পূর্ণ আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর শাসকগোষ্ঠী নানানভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যার রাজত্ব কতদিন চলে? আকাশে যখন সূর্য ওঠে, আঁধার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যা নেমে এলে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো আবারো আঁধার হানা দেয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আঁধার হানা দিয়েছিল বাংলার জনপদে। ২১ বছর বছর পর আবারো মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত সূর্যালোকে। সূর্যের মতো উদিত হয়েছেন জাতির পিতা তাঁর স্ব-মহিমায়। এ সূর্য, এ আলোকিত দিন কখনো হারাবার নয়। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা আঁধাররূপী দানবীয় শক্তির উত্থান যাতে আর কখনো ঘটতে না পারে, সে দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে জানতে হবে। জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪৭তম বার্ষিকীতে সে দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার অঙ্গীকারই করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার জন্য এ প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ থাকবে সত্যের সন্ধ্যানে ব্রতী হওয়ার। শিকড়ের সন্ধান করার। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বাঙালির বিবেককে কীভাবে জাগ্রত করেছেন, বাঙালিকে আত্মপরিচয়ে সম্মানিত করেছেন সে প্রেক্ষাপট জানতে হলে ইতিহাসের চর্চা করতে হবে।
৬ জানুয়ারি, ২০১৮
মোনায়েম সরকার : গবেষক, লেখক।ঁলশ