জানুয়ারির শেষ কলাম লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে আরো এক জানুয়ারির কথা। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি আর ২০১৮ সালের জানুয়ারি। ব্যবধান ৪৫ বছরের। সময়ের এই ব্যবধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মূলে অনেক পরিবর্তন সত্ত্বেও ওই জানুয়ারির সঙ্গে এই জানুয়ারির জাতীয় মূলধারা রাজনীতির প্রধান দল আওয়ামী লীগের এবং বাম ও কমিউনিস্ট রাজনীতির সম্পর্কের মধ্যে মিল-অমিল সম্পর্কিত আলোচনা খুবই আগ্রহ উদ্দীপক। বিশেষ করে গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচর্যের কার্যালয়ে অনভিপ্রেত ঘটনা ও ঘটনার পর রাজনীতির গতিধারার প্রেক্ষাপটে এ সম্পর্কে আলোচনা অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেয়ার জন্য আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই দিকটি নিয়ে আলোচনার সুবিধার জন্য প্রথমেই সেই জানুয়ারি ও এই জানুয়ারির রাজনীতির মিল-অমিলের দিকটি অতিসংক্ষেপে বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অমিল ও মিলগুলো নি¤œরূপ- ১৯৭৩ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ছিল নবজাত, সদ্য স্বাধীন দেশ। আর ২০১৮ সালে দেশের বয়স ৪৭ বছর। প্রজন্ম বিচারে খুব একটা কম সময় নয়। ওই সময় দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। খাদ্য ঘাটতি ও পরনির্ভর দেশ ছিল আমাদের। চট্টগ্রাম বন্দর তখনো মাইনমুক্ত হয়নি। আর এখন আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। আমেরিকা তখন সবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল আমেরিকা-চীন-পাকিস্তান অক্ষের বিপরীতে ভারত-সোভিয়েত অক্ষে।
তখন দেশের ইতিহাসে প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়েছে এবং সংসদীয় গণতন্ত্রকে জাতীয় পছন্দ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানে গৃহীত জাতীয় চার নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতি তখন ছিল সংকল্পবদ্ধ। আর এখন জাতীয় চার নীতি বাস্তবায়ন তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এজেন্ডায় নেই আর অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যেন ক্রমেই অনেক দূরের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তখন ছিল নিষিদ্ধ আর বিএনপির মতো ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া ও ভাবাদর্শগতভাবে দক্ষিণপন্থি দল তখন ছিল না।
তখন আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায় এবং এখনো ক্ষমতায়। আর বাম ও কমিউনিস্ট দলগুলো তখনো ঐক্যবদ্ধ ছিল না, এখনো নেই। নিয়তির মতো তখন এবং এখনো বহুমুখী মত নিয়ে বহু দলে-গ্রুপে বিভক্ত। একপক্ষ তখনো ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর অপর পক্ষ ছিল বিরোধী পক্ষে। তবে এখানেও মোটা দাগে একটি অমিল রয়েছে, যেমন সিপিবি ছিল পক্ষে। তারা এখন বিপক্ষে আর নাম ভিন্ন হলেও ওয়াকার্স পার্টি ছিল বিপক্ষে আর এখন রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব নিয়ে। আর জাসদ ছিল বিপক্ষে আর এখন জাসদ পক্ষে বিপক্ষে ভাগ হয়ে রয়েছে।
সেই জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ছিল এক মাসেরও কিছু সময় পর ৭ মার্চে আর এবারের জানুয়ারির এক বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই জানুয়ারির কয়েক মাস আগে থেকে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। চালের দাম তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। বস্ত্র সংকট তীব্র হয়। একদিকে নাশকতামূলক কাজ আর অন্যদিকে চোরাচালানি-মজুতদারি, ঘুষ-দুর্নীতির খবর প্রচারিত হতে থাকে। সরকার বিনিয়োগ নীতি ঘোষণা করে এবং ২৫ লাখ টাকা মূল্যের প্রতিষ্ঠান আগামী ১০ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত না করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। সব মিলিয়ে তখন জাতীয় জীবনে সংকট ও অস্থিরতার ভাব পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থায় একদিকে রুশ-ভারতের দালাল হিসেবে সরকারকে কোণঠাসা করার প্রচেষ্টা চলে আর অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সরকার সম্পর্ক স্থাপন করার দিকে যাচ্ছে, পাকিস্তান স্বীকৃতি দেবে, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে, সরকার দক্ষিণে যাচ্ছে প্রভৃতি প্রচারও চলতে থাকে।
এই অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে ডিসেম্বর মাসে সরকারের সমর্থক ন্যাপ (মোজাফফর) বঙ্গবন্ধু সরকারের ‘বিকল্পে ন্যাপের সরকার গঠনের আওয়াজ’ তুলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। অপরদিকে সরকার সমর্থক সিপিবি দুই প্রস্তাবকে সামনে রেখে ‘দুই মতে ভাগ’ হয়ে যায়। প্রথম মত ছিল নির্বাচনে ন্যাপ মোজাফফরকে সমর্থন করা; আর দ্বিতীয় মত ছিল ন্যাপ মোজাফফর ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বাছাই করে ‘রাজনৈতিকভাবে সৎ ও উপযুক্ত প্রার্থীদের সমর্থন’ করা। কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে প্রথম প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরে প্লেনামে (কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা) সামান্য ভোট বেশি পেয়ে দ্বিতীয় মতটি গৃহীত হয়। কিন্তু সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটি প্লেনামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মত বাতিল করে দিয়ে পূর্ব মতই বহাল রাখে। এই যখন রুশপন্থী বাম ও কমিউনিস্টদের আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মতামত তখন চীনপন্থি বাম কমিউনিস্টরা ভাসানী ন্যাপ বা বিভিন্ন দল-গ্রুপে বিভক্ত কেউ সরকারকে উৎখাতের ¯েøাগান তোলে, কেউবা নাশকতামূলক কাজে যোগ দিয়ে থানা ও হাটবাজার লুট করতে থাকে। এদিকে জাসদ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ ¯েøাগান উত্থান করে তীব্র সরকার বিরোধী অবস্থান নিয়ে মাঠে নামে। এই অবস্থায় ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণের তীব্রতার ইস্যু সামনে এনে মূলত ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের আমেরিকা পরিচালিত ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রামে ইউএসআইএস অফিস, ঢাকার বইমেলায় ইউএসআইএস স্টল প্রভৃতি ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি চলতে থাকে।
এই পটভূমিতে সংঘটিত হয় সিপিবি ও ন্যাপ মোজাফফরের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন আহূত ১ জানুয়ারি ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালনের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র মতিউল ও কাদের শহীদ এবং ৬ জন আহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশও দেয়া হয়। সরকারি প্রেস নোটে ছাত্র মিছিলকে এবং মিছিলকারীরা পুলিশ ও সরকারকে দায়ী করতে থাকে। ‘খুনিদের ক্ষমা নাই’ এই ¯েøাগানও উত্থাপিত হয়। কী কারণে গুলি বর্ষিত হয়েছিল, মার্কিন তথ্য কেন্দ্র তথা ন্যাপ অফিসের সামনে মিছিল আসার পর কেন গুলি হয়েছিল, গুলির জন্য পুলিশ বা ছাত্র ইউনিয়ন কে কতটুকু দায়ী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা দূরে থাকুক, রাজনীতির অঙ্গনেও পরবর্তী সময়ে তেমন আলোচনা হয়নি। এই কলামের বিষয় অবশ্য অনুসন্ধান করে তা বের করা নয়। তবে পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনের রাজনৈতিক রিপোর্টের দলিলে বলা হয়, মিছিল মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে আসলে ‘সামান্য গোলযোগের পরেই পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ’ করে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে তৎকালীন ডাকসুর সহসভাপতি ও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং বর্তমানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লেখেন যে, ‘মিছিলের অগ্রভাগ তখনো ইউএসআইএস অতিক্রম করেনি। এমনি সময় শুরু হয়ে গেল পুলিশের গুলিবর্ষণ। এর আগে মিছিল থেকে একটা ঢিলও পড়েনি।’ কেন দলিলে ‘সামান্য গোলযোগ’ লেখা হয়েছিল আর সিপিবি সভাপতি ঘটনার ৩৭ বছর পর কেন বললেন ‘শান্তিপূর্ণ মিছিল যাচ্ছিল’ তা নিঃসন্দেহে হতে পারে অনুসন্ধিৎসার বিষয়।
যাই হোক, তার পরদিন ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ মোজাফফর হরতাল আহ্বান করে এবং সিপিবি হরতাল সমর্থন করে। হরতাল আহূতকারীরা সারা দিন মিছিলে আর বিকেলে পল্টনের জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নেয় এবং বক্তব্য প্রদান করেন। সরকারের পদত্যাগের দাবিও উত্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা উপাধি ও আজীবন সদস্যপদ প্রদানের ডাকসুর প্রস্তাব খাতা থেকে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া হয় এবং উপাধি ও সদস্যপদ প্রত্যাহার করা হয়। জনসভা পরবর্তী মিছিল ইউএসআইএস ভবনে পতাকার দণ্ডে ভিয়েতনামের পতাকা তুলে দেয়া হয়। আগেই সেই ভবনে লেখা হয় ‘মতিউল-কাদের পাঠাগার’।
সরকার সমর্থক বাম কমিউনিস্টরা যখন এসব করে যাচ্ছিল, তখন ‘জাতির পিতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হইতেছে’- এই অভিযোগ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলো থেকে তোলা হয় এবং ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সিপিবি অফিসও আক্রান্ত হয়। প্রায় সব জেলায় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন অফিস এবং কোথাও কোথাও সিপিবি অফিসে অনুরূপ হামলা হয়। ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সম্পর্ক কার্যত শত্রুতার পর্যায়ে চলে যায়। পরে ‘সা¤্রাজ্যবাদ এবং চীনের দালাল জাসদ ভাসানী ন্যাপ প্রভৃতি এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ’ করবে বিবেচনায় মূলত সিপিবির উদ্যোগে বিবদমান দুই পক্ষের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন তখন মাফ চেয়েছিল কি না অথবা সরকার তখন বাধ্য হয়ে পিছু হটেছিল কি না, তা এই কলামের আলোচ্য বিষয় নয়। তবে তখনকার জানুয়ারির ওই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ভাবলে বিস্মিত হতে হবে এই প্রশ্নে যে, এত মিল ও ঐক্যের মধ্যে হঠাৎ এত বিভেদ হলো কেন এবং আবারো মিল ও ঐক্যে চলে যাওয়া হলো কেন?
ওই কেন পেছনে যে রয়েছে নির্বাচন নিয়ে ন্যাপ মোজাফফরের আওয়ামী লীগ বিরোধী সিদ্ধান্ত এবং সিপিবিতে দুই মতের টানাপড়েন, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ ও বাম কমিউনিস্ট দলগুলোর রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার পার্থক্য এখানে বিবেচ্য। আওয়ামী লীগ রাজনীতির গতিপথ পরিক্রমার পথে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ছেড়ে দেয় নেতার কাছে আর বাম ও কমিউনিস্ট দলগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রে দলে সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, জানুয়ারির ওই বিয়োগান্তক ঘটনার পর সিপিবি নির্বাচন নীতি পরিবর্তন করে এবং ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বাছাই করে সমর্থন দানের নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ পরবর্তী সময়ে পঁচাত্তরের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য ও সমঝোতার নীতি কৌশল নিয়েই অগ্রসর হয়। তাই পরবর্তী সময়ে ওই সময় পর্যন্ত আর সেই জানুয়ারির মতো রাজনীতির মাঠে দুই পক্ষের দ্ব›দ্ব-সংঘাত হয়নি। ঘটনাবলি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উল্লিখিত এই পর্যালোচনা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় উদ্ভূত নানা সংকট, সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টানাপড়েনের ফলে ন্যাপ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর সিপিবি সিদ্ধান্ত নিয়ে যেভাবে দোটানায় পড়েছিল, তার প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে সেই জানুয়ারির ঘটনাপ্রবাহ।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, সেই জানুয়ারির পর ১৯৭৩ সালে সিপিবির উল্লিখিত দলিলে যে অনুমান করা হয়েছিল, তা-ই পরবর্তী সময়ে সঠিক হয়। সেই জানুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনা আসলে পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয় বামপন্থি জাসদ ও সরকারবিরোধী চীনপন্থিদের। এসব দল ও গ্রুপগুলো প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে উগ্র বামমুখী কাজ করে দেশকে অরাজকতা ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয়। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর তা আরো জোরালো রূপ ধারণ করে। ক্ষুদ্র এই কলামে ওইসব ঘটনাপ্রবাহে না গিয়ে অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করে একটি কথাই বলতে হয় যে, যুদ্ধে বিধ্বস্ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কবলিত ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের (খাদ্য জাহাজ নিয়ে পর্যন্ত তা হয়েছিল) পটভূমিতে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় নানা সমস্যা-সংকট, সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতা ও জাতীয় আন্তর্জাতিক টানাপড়েনের ফলে উদ্ভূত অবস্থায় বাম দিক থেকে আওয়ামী লীগকে যে অবিবেচনাপ্রসূত ধাক্কাগুলো দেয়া হয় এবং ধাক্কা সামলাতে আওয়ামী লীগ যে দমন ও নির্যাতনমূলক নীতি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে, তার শেষ সুযোগ গ্রহণ করে ডান প্রতিক্রিয়াশীল মহল। বঙ্গবন্ধু কথিত ‘চাটার দলের’ যথার্থ প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় ডান প্রতিক্রিয়াশীল খুনি মোশতাক।
এই কলামের পাতায় তাই রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে, দেশের বিধিলিপি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ধাক্কা দেয় অতি বাম আর ফল খায় ডান ও প্রতিক্রিয়াশীলরা। কলামটা আর বড় করা হলো না, অতীত ও পরবর্তী সময়ের একই ধরনের উদাহরণ টেনে। তবে বর্তমান জানুয়ারি বিবেচনায় নিয়ে বলতেই হয় যে, সিপিবি তথা বাম জোটের যদি সরকারবিরোধী তীব্র রাজনৈতিক লাইন তথা বাম বিকল্প করার সিদ্ধান্ত না থাকত তবে কি এই জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটত? এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে অহেতুক ইস্যু সৃষ্টি যেন আমাদের ললাটের লিখন। আর ইস্যু সৃষ্টি হলে তা নিয়ে আন্দোলন বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠার সম্ভাবনাও থাকবে। প্রশ্ন হলো- বাম ও কমিউনিস্টরা ইস্যু নিয়ে এমন ধাক্কায় কি যাবে, যা দিয়ে লাভবান হবে না বাম কমিউনিস্ট আন্দোলন-সংগঠনের, লাভ হবে ডান প্রতিক্রিয়াশীলদের তথা পরাজিত শত্রুদের? পঁচাত্তরের সেই পটপরিবর্তনের পর একটুও কিন্তু লাভ হয়নি বাম কমিউনিস্টদের। বরং চরম ক্ষতির কারণ হয়েছে। মাসুল যেমন দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তেমনি বেশি দিয়েছে বাম কমিউনিস্টরা।
জনসমর্থন ও ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করার কারণে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় এবং দেশ ও জনগণের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে; কিন্তু অতি বাম আরো জনবিচ্ছিন্ন ও মতে-দলে বিভক্ত হয়েছে। বাম কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আসা এবং একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়ানো আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে অসম্ভব। তাই বাম কমিউনিস্টদের উদ্ভাবিত দুটি শব্দ স্মরণে রেখে এবারের জানুয়ারির শেষ কলামে বলতে হয় যে, ‘সমদূরত্বের নীতি’ নিয়ে নাকি ‘মন্দের ভালোর’ দিক মুখ রেখে চলবে বাম কমিউনিস্টরা, এটাই নির্বাচন সামনে রেখে এখন ঠিক করতে হবে বাম কমিউনিস্টদের। সেই জানুয়ারিতে ছিল না ক্ষমতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে নিঃশ^াস নেয়ার মতো বিএনপি-জামায়াত জোট। তবুও ওরা গেছে ক্ষমতায়। আর এখন ওই জোট নিচ্ছে ঘাড়ের অতি সন্নিকটে নিঃশ^াস। এ কারণে মনে হয় সেই জানুয়ারি এই জানুয়ারিকে বলে দিয়ে যাচ্ছে, পঁচাত্তরের আগের অবস্থা যেন সৃষ্টি না হয়, তা বাম কমিউনিস্ট ও আওয়ামী লীগ- দুয়েরই বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।
শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।