১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত ২৩ মার্চ উদযাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে। এ দিন পাকিস্তানের পতাকায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট সব। যেদিকে তাকাতাম, চাঁদ-তারা আর চাঁদ-তারা। মনে হতো যেন রাত ঘনিয়ে এসেছে চতুর্দিকে। এই বছরই, সম্ভবত মার্চ মাসের ১৮/১৯ তারিখ জনাব আবদুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে, অর্থাৎ তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আর নয় এবার পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উঠবে। প্রতিটি যানবাহনে, ভবনে, সব কার্যালয়ে, উচ্চ আদালতে উত্তোলিত হবে ওই পতাকা। আবদুর রাজ্জাক নিজেও তার স্মৃতিচারণে এই কথা বলেছিলেন। এই নির্দেশনার আলোকে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পূর্বঘোষিত ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পতাকা উত্তোলন দিবস পালনের ঘোষণা করা হয়। এটা প্রদীপ্ত সূর্যের মতো সত্য যে, শুধু পল্টনেই নয়, সমগ্র দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও মহকুমা শহরেও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকে একযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয় এ দিন। এমনকি ঢাকার প্রতিটি দূতাবাসেও পাকিস্তানের চাঁদতারাঅলা পতাকার পরিবর্তে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের পতাকা।
আরো উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো- জুলফিকার আলী ভুট্টো অবস্থান করা অবস্থায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পর্যন্ত উত্তোলন করা হয় লাল-সবুজ বাংলাদেশের পতাকা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু বাংলাদেশের পতাকা। আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি ঘর যেন এক একটি দুর্গের ভূমিকা পালনে তৈরি। এমনিতেই ৭ মার্চের ভাষণের পর বীর বাঙালি উদ্যত রাইফেলের মতো উত্তেজিত অবস্থায় ছিল, সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। আমাদের মনে হলো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার যে আহ্বান বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, শত্রুর মোকাবিলা করার যে নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশ পালন শুরু হয়ে গিয়েছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার শানিত চেতনাকে আরো উদ্দীপ্ত করে পতপত করে উড়তে থাকে পতাকা। সত্য কথা বলতে গেলে ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের খণ্ডিত অবাঙালি অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা ছাড়া সব জায়গা থেকে পাকিস্তানের শেষ চিহ্নটি অবলুপ্ত করে দেয়া হয়। মূলত ২৩ মার্চ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান দিবসের কফিনে মেরে দেয়া হয় শেষ পেরেকটি।
স্পষ্ট মনে আছে আমার, বিউগল বাজিয়ে ড্রামের মাধ্যমে সুরের মূর্ছনায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। মৃদুমেঘমূর্ছনায় ব্যান্ড বাজছিল। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের সুললিত সুর পল্টনে উপস্থিত সব মানুষের চিত্তকে উদ্বেলিত করছিল। সত্যিকারের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আস্বাদন পাচ্ছিল বাংলার দুর্জয় ও অকুতোভয় জনতা। মোস্তফা মহসিন মন্টু, খসরু, হাসানুল হক ইনু, মহানগর ছাত্রলীগের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সম্মিলিতভাবে আস্তে আস্তে পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। এ সময় সামরিক কায়দায় মঞ্চে দণ্ডায়মান স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে অভিবাদন প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি হিসেবে অথবা চার খলিফা হিসেবে আমরা অভিবাদন গ্রহণ করি। আমরা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃচতুষ্টয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকগুলো ব্রিগেড সাজানো হয়েছিল একের পর এক। একটা ব্রিগেড অভিবাদন জানিয়ে মঞ্চ অতিক্রম করে পাশে অবস্থান নিচ্ছে, আরেকটি ব্রিগেড মঞ্চের দিকে মাথা বাঁকিয়ে অভিবাদন দিয়ে প্যারেড করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের দৃপ্ত পদভারে মনে হচ্ছিল তারা যেন দীর্ঘ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিংহশার্দুল বাহিনীর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এটি সম্ভব হয়েছিল প্রত্যয় ও প্রতীতি থেকে উৎসারিত স্বাধীনতার শাশ্বত আকাক্সক্ষা থেকে। শেষ ব্রিগেডটি অভিবাদন জানানোর পর আমরা মঞ্চ থেকে নেমে এসে পল্টনের গেটে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সেখান থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে বিউগলে জাতীয় সঙ্গীতের সুর তুলে মিছিল করে দৃপ্ত পদভারে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে চললাম। দুদিকে অযুত মানুষের ঢল। কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগান। বক্ষে স্বাধীনতার প্রতীতি। প্যারেডের পেছনে এসে মিছিলের অবয়বে তারা সবাই অংশ নিতে লাগলেন। ধানমন্ডির দিকে আমরা যতই এগোচ্ছি মিছিলের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই। বজ্রনির্ঘোষে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। ‘এ পতাকার শেষ কথা, বাংলা মায়ের স্বাধীনতা।’ শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, পৃথিবীর সব সংগ্রামী জাতির মধ্যে এটি একটি অনন্য সাধারণ ও অবিস্মরণীয় মার্চপাস্ট এবং তার সঙ্গে লাখো মানুষের পদচারণা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পুরো কর্মসূচিটি আবর্তিত ছিল। বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে প্রস্তুত ছিলেন পতাকা মিছিলটি সাদরে বরণ করার উদ্দীপ্ত আকাক্সক্ষায়।
আমরা যখন ৩২ নম্বরের গেটে উপস্থিত হলাম, তখন মিছিলের শেষ প্রান্তটি কোথায় ছিল, সেটি আমরা বর্ণনা করতে পারব না। বঙ্গবন্ধু নেমে আসলেন। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে গৌরবদীপ্ত হৃদয়ে তার হাতে পতাকাটি অর্পণ করলাম। স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ¯েøাগান উঠল ‘জয় বাংলা’। সেটাই প্রতিধ্বনিত হলো লাখ কণ্ঠে। ইথারের মধ্যে ছড়িয়ে গেল সেই আওয়াজ। জনসমুদ্রের ঊর্মিমালার মতো ঢেউ খেতে খেতে ৩২ নম্বরের সামনে থেকে মিছিলের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সে দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিক, অনন্য সাধারণ, অবিশ্বাস্য। তখনো যদি কারো মনে বিন্দুমাত্র দুরাশা থাকত যে পাকিস্তান টিকলেও টিকে যেতে পারে, সেই দুরাশা চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গেল মুহূর্তে। মৃত পাকিস্তানে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির অগ্নিকণায় দগ্ধ হয়ে নিঃশেষিত হলো ২৩ বছরের শোষণ আর ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। সেদিন পল্টনের পতাকা উত্তোলনের সভায় আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রাজ্জাক, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকী, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, এমএলএ ড. আবু হেনাসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন। এখানে অত্যন্ত স্পষ্ট করে নতুন প্রজন্মকে অবগতি এবং তাদের চেতনাকে সংশয়বিমুক্ত করার জন্য বাস্তবের নিরিখে অন্তর্নিহিত এই বিশ্লেষণটি উদ্ধৃত করতে চাই। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ যে কর্মসূচি পালন করেছে সেটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়। এর বাইরে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অথবা স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কোনো কর্মকাণ্ডই ইতিহাসের বিশ্লেষণে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দাবি রাখে না। ২৩ মার্চে যদি পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস পালিত হতো, তাহলে রাষ্ট্রপতি কিংবা তার অবর্তমানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করতেন। তাদের গানস্যালুট প্রদান করা হতো। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ওই দিনটি আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন ও পতাকা দিবস হিসেবে পালন করার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তটি আমরা লাভ করি। এখানেও বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারী এবং কৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই পতাকা উত্তোলনে পল্টনের ঐতিহাসিক ময়দানে তিনি উপস্থিত হলে এবং আমরা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের চার সদস্য পতাকা উত্তোলন করে তাকে গানস্যালুট প্রদান করলে নিঃসন্দেহে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তার ওপর পড়ত। এটি বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদই শুধু নয়, সামরিক জান্তার চক্রান্তের চোরাবালিতে পা রাখার মতো বোকামি হতো। তাই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রলীগের পতাকাটি উত্তোলিত হওয়ার সময় সংগ্রাম পরিষদের চার নেতাকে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন প্রদান করা হয়। সূ² নির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছিল বলে ২৩ মার্চই পতাকা দিবস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বছর বছর প্রতিপালিত হচ্ছে। পত্রপত্রিকা ছাড়াও পতাকা দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের তৎকালীন প্রায় সব নেতার বক্তৃতা ও স্মৃতিচারণে আমার এই কথার স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকী বলেন, ‘২৩ মার্চ পতাকা উত্তোলনের পরে তদানীন্তন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর হাতে সে পতাকা তুলে দেন। এটি ইতিহাস স্বীকৃত আনুষ্ঠানিক ঘটনা।’ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘২৩ মার্চ পতাকা দিবস, আর এটাই সঠিক ইতিহাস। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদদের পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এই পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। ঘরে ঘরে পতাকা ওড়ানো হয়েছিল এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে নূরে আলম সিদ্দিকী ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি অর্পণ করেন।’ আমির হোসেন আমু বলেন, ‘২৩ মার্চই পতাকা দিবস এবং এটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় উত্তোলিত হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি বন্ধুবর নূরে আলম সিদ্দিকী সেটি ৩২ নম্বরের বাসায় বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করেন।’ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘২৩ মার্চকে পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করা হয়, কারণ এ দিন বাংলার ঘরে ঘরে পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। সেদিন পাকিস্তানের চিহ্ন কোথাও ছিল না, ক্যান্টনমেন্ট এবং গভর্নর হাউস ছাড়া।’ জনাব আবদুর রউফ বলেন, ‘২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পতাকা দিবস ঘোষিত হয়। ২৩ মার্চ পল্টনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত পতাকাসহ পল্টন থেকে কুচকাওয়াজ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর হাতে সেটি তুলে দেন।’ খালেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পতাকাটি উত্তোলিত হল। ছোট্ট মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতারা অভিবাদন গ্রহণ করলেন। সারা পল্টন ফেটে পড়ল জয়ধ্বনিতে। জয় বাংলা ¯েøাগানে, বঙ্গবন্ধুর নামে ¯েøাগানে আমরা তখন শিহরিত হয়ে উঠলাম। পরে কুচকাওয়াজের মাধ্যমে ৩২ নম্বরে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে পতাকাটি তুলে দিলেন।’ ঐতিহাসিক বাস্তবতার আঙ্গিকে উপসংহারে প্রাসঙ্গিক কারণেই তরুণ প্রজন্মকে জানাতে চাই, ছয় দফার মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের আন্দোলনের অন্তর্নিহিত মূল সত্তাটি ছিল স্বাধীনতা। অনেক নির্যাতন, নিগ্রহ, কারাভোগ এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ করে প্রত্যয়দীপ্ত বাংলার জাগ্রত জনতা, তার অগ্রভাগে ছাত্রসমাজ এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর চেতনার উত্তরসূরি ছাত্রলীগ প্রজ¦লিত মশাল জ্বেলে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে ও সগর্বে উদ্ধার করেছিল। এটি জাতীয় রাজনীতিতে শুধু একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ই নয়, একটি শাণিত চেতনার সৃষ্টি এবং রাজনীতিতে একটি নতুন মোড় এনে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ছাড়াও এগারো দফা আন্দোলনে বিজয়ের আরো একটি গৌরবোজ্জ্বল অংশ ছিল ১৯৭০ সালে পকিস্তানের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে নয় বরং জনসংখ্যার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠানে বাধ্য করা। জনাব আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদসহ ১১ দফা আন্দোলনের অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বের সমভিব্যাহারে এই বিজয়ের সিংহদ্বারটি উন্মুক্ত হয়েছিল। সেটাই পরবর্তীকালে ১৯৭০-এর নির্বাচনে স্বাধিকারের অন্তরালে স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পক্ষে সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট এনে দেয়।
নতুন প্রজন্মের কাছে, আজ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হোক, সেদিন আমাদের কাছে যে রাইফেল ছিল তার অধিকাংশই ছিল ডামি। কিন্তু সেই উদ্যত, উদ্যত ডামি রাইফেলই পাকিস্তানকে জানিয়ে দিল ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিধ্বনি করে, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।’ আমরা প্রতিটি মুহূর্তে এই অমোঘ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তিল তিল করে মানুষের মননশীলতাকে শাণিত করেছি। হয়তো অনেক রক্ত দান করতে হয়েছে, হয়তো অনেক বোনকে সতীত্ব হারানোর যন্ত্রণায় ডুকরে কাঁদতে হয়েছে, হয়তো অনেক তরুণের বুকনিঃসৃত তাজা তপ্ত রক্ত আর মায়ের চোখনিঃসৃত নোনা অশ্রæতে বাংলার মাটির প্রত্যন্ত অঞ্চল সিক্ত হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতাকে আমরা ছিনিয়ে আনতে পেরেছি। এই প্রতীতি ও প্রত্যয় তৈরির জন্য আমরা তৈরি করেছি একেকটি আন্দোলনের সোপান। বাংলার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতীতির সঙ্গে সব মানুষের চেতনার একটা রাখিবন্ধন অতি সুদৃঢ়ভাবে বাঁধতে পেরেছিলাম বলেই ষড়যন্ত্র, অর্থ ও অস্ত্র শেষ পর্যন্ত পরাজয়বরণ করতে বাধ্য হয়েছে। আমি বারবার বলেছিলাম, বলছি এবং বলব, বঙ্গবন্ধু আমাদের চেতনার প্রতীক, ছাত্রলীগ ও স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপকার। ইতিহাসের এই অমোঘ সত্যটি যতই দিন যাবে ততই গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বাংশে।
নূরে আলম সিদ্দিকী : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা।