ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
স্বা ধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫ খ্রি.) বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামের মর্মবাণী বিশ্বশান্তি, সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ক্ষমা, উদারতা, মহানুভবতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও মানবতার চিরশাশ্বত নীতি-নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের শিক্ষা জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসারের জন্য বহু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক দরবেশ শেখ আউয়ালের সপ্তম অধঃস্তন বংশধর; ইসলামী ঐতিহ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী বঙ্গবন্ধু পরম উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে ইসলামের যথাযথ প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।
ইসলামের চিরন্তন মানব কল্যাণকামী বৈশিষ্ট্য ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন ভাষণে মহানবী (স)-এর ইসলামের সুমহান শিক্ষা, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপোষহীন অবস্থান, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ও মোনাফেকির বিরুদ্ধে ধর্মের শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার বাস্তবায়নের নিরলস প্রচেষ্টার কথা ব্যক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর রমনার তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। ...এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উত্স ছিল রাসূলুল্লাহ (স) প্রবর্তিত মদীনা সনদের সেই মহান অতুলনীয় শিক্ষা, যেখানে উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল- ‘মদীনায় ইহুদি-খ্রিস্টান, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে তিনি স্বভাবসুলভ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্ম চর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, ...হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, ...বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। ...ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গৃহীত ধর্মীয় উদ্দীপনামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী প্রচার ও প্রসারের স্থপতি হিসেবে যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ তিনি এক অধ্যাদেশ বলে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে ও অর্থায়নে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহত্তর ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে জননন্দিত ও বিপুল সমাদৃত।
ইসলামের সঠিক রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম দেশের হাক্কানী আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে ঢাকায় ‘সীরাত মজলিশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। যার উদ্যোগে তার দিক-নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় বৃহত্তর আঙ্গিকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স) মাহফিল উদযাপিত হয়। তখন সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে সীরাত মাহফিলের শুভ উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য সহকারে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স) মাহফিল উদযাপন করে আসছে।
ইসলামী আকিদা ভিত্তিক মানুষের আদর্শ জীবন গঠন এবং আরবি ও ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। তিনিই প্রথম মাদ্রসা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, তরজমা ও তাফসীর প্রচার শুরু হয়। ফলে বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সকালের শুভ সূচনা ও দিবসের কর্মসূচি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত এ ব্যবস্থাই জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে চালু রয়েছে।
ইসলামের ধর্মীয় উত্সব, পর্ব ও দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স), ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে মিরাজ, শবে বরাত, শবে কদর প্রভৃতি উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। ধর্মীয় দিবসসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনিই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে ইসলামের নির্দেশনা মোতাবেক শাস্তির বিধান জারি করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তত্কালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঘোড় দৌড়, জুয়া-হাউজি ও বাজিধরা প্রতিযোগিতা চিরতরে বন্ধ করেন এবং অনৈসলামিক কর্মকান্ডের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে সাদকায়ে জারিয়া স্বরূপ অজস্র বৃক্ষরোপণ করে সেই স্থানের নামকরণ করেন ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’ অনুষ্ঠানের জন্য টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। কাকরাইলে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলিগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রশান্ত ও সুবিশাল স্থান স্থায়ীরূপে বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়। বর্তমান রাশিয়া তথা পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনিই প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের মুসলমানদের পক্ষ সমর্থন করেন এবং এ যুদ্ধে তার নির্দেশে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করা হয়। মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ‘ওআইসি’র অধিবেশনে যোগদান করেন। সম্মেলনে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন, এতে আরব বিশ্বসহ মুসলিম জাহানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত হয় এবং ইসলামী বিশেষজ্ঞ নেতৃবৃন্দের সাথে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনিভাবে বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে বিপুল অবদান রেখে গেছেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
লেখক: চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি, ঢাকা।