মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ


২৬ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী আনুষ্ঠানিকভাবে পঠিত হয়। বিপ্লবী বেতার সূত্র উদ্ধৃত করে স্বাধীনতার ঘোষণার উল্লেখ করে। উল্লেখ্য, প্রথম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষণার বাণী পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা প্রচারে সহায়তা করেন মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান খান কায়সার ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রমুখ এমপিরা।

পর্যায়ক্রমে বেতার, টেলিপ্রিন্টার ও লিফলেটের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় দিকে দিকে। নতুন প্রাণের জোয়ারে সংগঠিত হয়ে উঠে দেশ। প্রবল উচ্ছ¡াসে দেশের মানুষ অস্ত্র হাতে নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং উত্তর চট্টগ্রাম থেকে এ সময় ইপিআর জোয়ানরা চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের আলাওল হল ও এএফ রহমান হলে এসে আশ্রয় নেয়। কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক সিআরবির টিলায় অবস্থান করেন। বিশ্ব গণমাধ্যমের সহায়তায় ঢাকার কার্ফ্যু ও গণহত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বিবিসির এই দিনের প্রচার বাঙালিদের কাছে বিপ্লবের দিকচিহ্ন হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান বললেন : ‘শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন দেশদ্রোহিতার শামিল। তিনি এবং তার দল দেশের আইনগত কর্তৃত্বকে অবমাননা করে আসছেন। তারা পাকিস্তানের পতাকার অবমাননা করেছে। এবং জাতির পিতার ফটো পুুড়িয়েছে। তার ইচ্ছা পূরণের জন্য একের পর এক অন্যায়, অত্যাচার ও বেআইনি কাজকর্ম সহ্য করে গেছি। মুজিবকে স্বমতে রাজি করাতে আমি ও নেতারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করি নাই। …আওয়ামী লীগকে একেবারেই বেআইনি ঘোষণা করছি। আমি সংবাদপত্রের ওপর কড়া নজর দেবার আদেশ দিয়েছি।’

২৯ মার্চ সোমবার ১৯৭১, চুয়াডাঙ্গায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর, আনসার, ছাত্র-জনতার সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে কুষ্টিয়ার পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিফৌজ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে পাকবাহিনীর। পাকসেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। একজন মুক্তিসৈনিক শহীদ হন। সন্ধ্যায় পাকসেনার রেকিদল মুক্তিসেনার এ্যামবুশে অফিসারসহ সবাই নিহত হয়। মেজর খালেদ মোশাররফ নিয়ন্ত্রণাধীন চতুর্থ বেঙ্গল ও অন্যান্য দল ভৈরব বাজার এবং নরসিংদীর মধ্যকার রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ দিন থেকে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করা হয়। পাকবাহিনী ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারটি বিমানের আক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। সেখানে সুবেদার ছাবেদ আলী তাঁর প্লাটুন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। উপায়ন্তর না দেখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বীর শব্দ সৈনিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় একটি ক্ষুদ্র এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার বয়ে নিয়ে যায় মুক্তাঞ্চাল রামগড়ে। সেখান থেকে আগরতলা। উল্লেখ্য, এই বেতার কেন্দ্রটির সব অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযোদ্ধা এবং সব দেশপ্রেমিক মানুষের মধ্যে প্রবল আশা জাগিয়ে তুলেছিল।

৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে রাজশাহীর গোপালপুর রেলক্রসিংয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা। এই লড়াইয়ে ৬ ট্রাক একটি জিপসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর সৈন্যদল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় জনতার হাতে। এ ছাড়াও নোয়াখালীর আব্দুল মালেক উকিল পরিচালিত প্রতিরোধ বাহিনী বেলুনিয়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ৪০ জন পাকসেনাকে বন্দি করে ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। পরে এসব অস্ত্র¿ শুভপুরের যুদ্ধে কাজে লাগে। মেজর আবু ওসমানের নেতৃত্বাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পাকবাহিনী দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, ঝিনাইদহের পথে পালাতে থাকে। এ যুদ্ধে ২৫৬ জন পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। চট্টগ্রাম থেকে সর্বজনাব এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার এবং আবদুল্লাহ আল হারুন সীমান্ত দিয়ে আগরতলা পৌঁছান। আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের কাছে আওয়ামী লীগ নেতারা অস্ত্রশস্ত্রের সহায়তার আবেদন জানান। মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং জনাব এম আর সিদ্দিকীকে দিল্লি যাওয়ার পরামর্শ দেন।

৩০ মার্চ আর একটি দুঃসাহসিক ঘটনা, যা বিশ^কে চমকে দিয়েছিল। এ দিন ফ্রান্সের বন্দরে নোঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ থেকে সাবেক পাকিস্তান নৌবাহিনীর আটজন দুর্জয় সাহসী বাঙালি নাবিক পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এভাবে দিকে দিকে বাংলার সন্তানরা অস্ত্র হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ভারতের লোকসভা ও রাজ্য সভায় ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ যৌথ সভায় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ দিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। লোকসভায় এক সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনতার সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা ও সহায়তাদানের ঐকমত্য প্রকাশ করা হয়।

৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীনের সঙ্গে বিএসএফ কর্মকর্তার যোগাযোগ হয়। তাঁকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার আবেদন জানায় বিএসএফ প্রধান। এদিন তেলিয়া পাড়ায় মুুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী, মেজর শফিউল্লাহ, লে. কর্নেল রবকে নিয়ে একটা বৈঠক হয়। এই বৈঠকে যুদ্ধজয়ের জন্য বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তার একান্ত প্রয়োজন মর্মে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়। ।

সোমবার, ৫ এপ্রিল ১৯৭১, অবরুদ্ধ ঢাকায় নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ১২ জন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রেস রিলিজ অনুসারে ওই দলে ছিলেন ফরিদ আহমদ, গোলাম আজম, খাজা খয়েরউদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান প্রমুখ। ৬ এপ্রিল আরো কয়েকজন রাজনীতিক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্ণ সহযোগিতার আশ^াস দেন। ৫ এপ্রিলের মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজইউক’ সংখ্যার দুপৃষ্ঠাব্যাপী রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর মার্চের ৭ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতার উদ্ধৃতি দেয়া হয়। এই রিপোর্টে দৃঢ়চেতা ও সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বলে উল্লেখ করা হয়। এইদিন বিশ^বিখ্যাত আর্যুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠান ‘সাধনা ঔষধালয়ের’ প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষকে পাক হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল দিল্লিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা পিএন হাকসারের একান্ত বিশেষ বৈঠক হয়। আলোচনায় সর্ববিধ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। বুধবার, ৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত আলোচনা করেন। সঙ্গে ব্যারিস্টার রহমতউল্লা (আমীর-উল ইসলাম) ছিলেন। দুদফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীমতি গান্ধী ও জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে এই বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় ও অবাধ রাজনৈতিক কার্যপরিচালনার সুযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্ববিধ সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ^াস দেয়া হয়। ১২ এপ্রিল গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের সমর্থক কয়েকশ বাঙালি লন্ডনের চীনা দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার আবেদন জানায়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দূতাবাসের কর্মচারীদের হাতে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাঙালিরা অতীতে তাদের সংগ্রামে চীনকে সমর্থক বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্তমান নীতির ফলে জনসাধারণ চীনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেছে। গাউস খানের নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিরা চীনা দূতাবাসে যাওয়ার আগে হাইড পার্ক থেকে মিছিল সহকারে ডাইনিং স্ট্রিটের পাশ দিয়ে হোয়াইট হল হয়ে ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে এক সভায় যোগ দেন। ঢাকায় খাজা খায়ের উদ্দিন ও জামায়াত নেতা গোলাম আযম জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে শান্তি কমিটির মিছিল বের করে। পাক সেনাবাহিনীর সাফল্যের জন্য মোনাজাত পরিচালনা করেন জামায়াতের আমির গোলাম আযম। তিনি ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মোকাবেলা করতে জেহাদের জিগির দেন।

১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল। বেলা ১১টা। এই দিন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুক্তাঞ্চল ভবের পাড়ায়, বৈদ্যনাথ তলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্নেল ওসমানী ও অন্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় মঞ্চে এলেন। আশপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারগুলোর একটাও পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনোটার হাতল নেই, কোনোটারবা পা নেই। ক্যাপ্টেন মাহবুব আর জনাব তওফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়নে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য আনসার বাহিনী প্রস্তুত। ক্যাপ্টেন মাহবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে। প্রায় হাজার দুই লোক এসেছিল অনুষ্ঠান দর্শক হিসেবে। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান এসেছেন। গার্ড অব অনার ও জাতীয় সঙ্গীতের পর নেতারা মঞ্চে বসলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা সনদের সপক্ষে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তার মন্ত্রিসভা-সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন।

মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানে দেশি, ভারতীয় ও বিদেশি একশ সাতাশ জন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও সোহরাব হোসেনসহ যশোর-খুলনার বহু গণপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। গগনবিদারী ¯েøাগান ও বিপুল করতালির মাঝে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদটি পাঠ করলেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ জাতির জনক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা সাংগঠনিক রূপ নেয়।

মোনায়েম সরকার : কলাম লেখক।

SUMMARY

1674-1.png