মার্চ আমাদের ইতিহাসের অগ্নিঝরা মাস। ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে নতুন করে জেগে ওঠে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বাঙালির রক্তে দাবানল ছড়িয়ে দেয়। আর এ দাবানলেই ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা, আত্মমর্যাদাবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার আকাক্সক্ষার জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের। পাশাপাশি, প্রয়োজন হয় দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপযোগী নেতৃত্বের। ১৯৭১-এ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রত্যয় আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বই নিয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি বেসামরিক ও সামরিক নাগরিকের ওপর অপারেশন সার্চলাইট চালায়। এতে কম করে হলেও একলাখ মানুষ শহীদ হয়েছে। অপারেশন সার্চলাইটের গুপ্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহ সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এ আশঙ্কায় নানা অজুহাতে মার্চের শুরু থেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা প্রচারিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা দেশজুড়ে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে সাধারণ জনতাকে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি সেনাসদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বের ভূমিকা রয়েছে। মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এ ডিভিশনের ব্রিগেডসমূহের অধীনে ৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিল। বাঙালি সেনারা যদি ওই সময় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতেন তবে স্বাধীন বাংলার ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। বাঙালি সেনাদের এ বিদ্রোহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেমের তাগিদে। আর এ তাগিদেই তারা দেশের আপামর জনতাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। নিজেদের প্রশিক্ষণ ও কঠোর মনোবলকে তারা ছড়িয়ে দেন স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে।
আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উচ্চ মনোবল ও তীব্র দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার সীমান্তসংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোয় বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সেদিন থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোকে ‘মুক্তিবাহিনী’ নামে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার কর্তৃক ১২ এপ্রিল কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী পিএসসিকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার-ইন-চিফ (কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ১০ থেকে ১৭ জুলাই কলকাতায় অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলনে বাংলাদেশের সব যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রতিটি সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য আবার প্রতিটি সেক্টরকে ভাগ করা হয় কয়েকটি সাব-সেক্টরে এবং প্রতিটি সাব-সেক্টরেই একজন করে কমান্ডার নিয়োজিত হন। ১০ম সেক্টরটি সর্বাধিনায়কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এ সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ-কমান্ডো বাহিনী এবং সর্বাধিনায়কের বিশেষ বাহিনী। বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে এই ১১টি সেক্টরের মাধ্যমে ৪ ডিসেম্বরে যৌথবাহিনী গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কার্যকরভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল এবং ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে অপারেশনাল নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়। সেনাসদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যুদ্ধের প্রথম দিকে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাঙালি ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বাঙালি বীর বিক্রমে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে পরাস্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানি শোষক বাহিনীকে। তরতাজা ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনতাকে একত্রিত করে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনীতে রূপান্তরিত করে এবং যুদ্ধকালীন নির্দেশনা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাঙালি সেনাবাহিনী।
সাইদুর রহমান