ক্রীড়াঙ্গনে আজো অনুপ্রেরণা একজন শেখ কামাল


স্বাধীনতার পর যিনি বাংলাদেশের খেলার জগতের মধ্যমণিতে পরিণত হন, তিনি অবশ্যই শেখ কামাল। তিনি স্কুল টিমের ক্রিকেট ও ফুটবল দুই খেলার ছিলেন একজন লিডার। বাস্কেট বলেও পারদর্শী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালক বাস্কেট বল টিমের বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য একজন ক্যাপ্টেন খুঁজছিলেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এসে তিনি টিমের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে ক্যাপ্টেনরূপে শেখ কামালের খেলা ও পারদর্শিতায় তিনি এতই মুগ্ধ হন যে শেখ কামালকে বিশ^বিদ্যালয়ের টিমের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করেন। তখন বাস্কেট বল খেলার জনপ্রিয়তা ছিল না। জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তাই শেখ কামাল জনপ্রিয় খেলা ফুটবলের দিকে একতরফাভাবে দেখতে চেষ্টা করলেন, ফুটবল ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সম্ভবত তাদের পরামর্শে তিনি আবাহনী ফুটবল টিম গঠন করেন। ধানমন্ডি তার বাড়ির পাশেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আবাহনী ফুটবল টিম গঠন করেন। টিমের জন্য ইউরোপ থেকে কোচ নিযুক্ত করেন। তিনি বাংলাদেশ আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে এভাবে পরিচিত হন এবং খেলার মান বৃদ্ধি করেন।

তারই বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের খেলাধুলার মান উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ক্রিকেটে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় খেলায়ও সুযোগ পায়নি। তালিকায় ১৩নং খেলোয়াড় হিসেবে অধিভুক্ত রাখা হতো। যাতে জীবনে ক্রিকেট খেলতে না পারে। সে বাংলাদেশ এখন ক্রিকেটেই শুধু আন্তর্জাতিক মানের খেলাই খেলছেন না, অনেক বিশ^বিখ্যাত টিমের জন্য এখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ এক আন্তর্জাতিক খেলায় পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়ে যে শিক্ষা দিয়েছে তা কোনো দিন ভুলার নয়।

শেখ কামাল শুধু মাঠের খেলা নয় নাট্যকলায় যেভাবে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন তাতে কেবল দেশেই আবদ্ধ ছিল না, ভারতেও নাটকে অভিনয় করার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং সাফল্য ও খ্যাতির সঙ্গে সুনাম অর্জন করে এ দেশের নাট্যকলাকে তুলে ধরেছেন।

তিনি বেঁচে থাকলে আজ দেশে অনেক যুবক রাজনৈতিকভাবে বিপথগামী হয়ে জঙ্গিবাদে লিপ্ত হতো না। আমাদের বিশ্বাস শেখ কামাল জীবিত থাকলে তিনি সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ আজ ভিন্নরূপে উদিত হতো। জঙ্গিবাদ ছাত্রদের মাঝে স্থান পেত না বরং ছাত্রছাত্রীরা নাট্যকলা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হতো। তিনি জানতেন ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে সংস্কৃতিচর্চায় আকৃষ্ট করা যায়। তাই তার সাফল্য নিয়ে আমরা গর্ব করি। সাহিত্য সংস্কৃতি নাট্যচর্চায় কোনো রাজনীতিকে গুরুত্ব দেননি। তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তির ইচ্ছা একাগ্রতা ও পারদর্শিতাকে। তার খেলার মাঠ থেকে টিএসসির বারান্দা পর্যন্ত নাট্যচর্চার স্থান যেখানে আছে সেখান পর্যন্ত শেখ কামালের পদচারণা ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক একটি বিষয় মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল ম্যাচে শেখ কামাল ঠিকই স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকতেন। শেখ কামালকে যতই দেখতাম ততই অবাক হতাম। স্বাধীনতার পরে রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ দেখাননি। যত আগ্রহ ছিল তার খেলার জগতে এবং সংস্কৃতিচর্চায়। যদিও তিনি স্বাধীনতার আগে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক ছিলেন। যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ছিলেন জেনারেল ওসমানীর টুআইসি বা এডিসি। তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। স্বাধীনতার পর সামরিক বাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে আসেন। এক সময় খেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।

সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পেশাদারী নাট্য সংস্থা ‘নাট্যচক্র’ শহীদ শেখ কামালের প্রতিষ্ঠিত আরো একটি সংস্থা। এটা অবশ্য ডাকসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে জন্য ম. হামিদকে এর প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। কারণ ম. হামিদ তখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। শেখ কামাল ও আমি হই যুগ্ম-আহ্বায়ক। শেখ কামাল এ ছাড়াও অধ্যাপক আসকার ইবনে সাইফের একাধিক নাটকে অভিনয় করেন। মনে পড়ে মুস্তফা জব্বারের ‘এক নদী রক্ত’ নাটকে স্বাধীনতার আগে অভিনয় করি। ওই নাটকেই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলা হয় এবং সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দেই। আরো অনেক নাটকে একসঙ্গে অভিনয় করার স্মৃতি আছে। আগামীতে যদি আর কোনো জাতীয় নাট্যমঞ্চ হয় তবে তা যেন শহীদ শেখ কামালের নামে হয়। এটাই এখন আমার স্বপ্ন বা একান্ত আকাক্সক্ষা। নামকরণের যথার্থতা পাবে।

ব্যক্তি শেখ কামাল সব শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কোমল হৃদয়ে ছিলেন। প্রকৃত অর্থে শিল্পীমনা পরিশীলিত, মানবদরদী, ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন শেখ কামাল। আচার-আচরণে অতি সহজ, সরল, সদালাপী, সদা হাসিখুশি মনখোলা প্রাণবন্ত যুবক। সাদামাটা পোশাক পরত কোনো বাহুল্য ছিল না। নিরহঙ্কার দরদী হৃদয়ের সৎ মানুষ ছিলেন শেখ কামাল। যখন তার অতীতের দিকে ফিরে তাকাই আমার বিশ্বাস সাহিত্য নাট্যচর্চার সৃষ্টিকে স্মরণ করেত চাই তখন তাকে স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই।

শেখ কামাল ভালো সেতার বাজাতেন শুনেছি। তিনি ছায়ানটে সেতার শিখতেন। একজন মানুষের মধ্যে এত গুণের সমাহার কীভাবে সম্ভব হয়। তিনি যেমন মাঠের খেলাধুলায় সহায়তা করতেন। সঙ্গীতেও তার সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণ ছিল। তা না হলে তিনি কেন পপসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘স্পন্দন’ স্থাপন করবেন? অর্থাৎ সংস্কৃতিচর্চায় তার নিষ্ঠার কোনো অভাব ছিল না। পপসঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘স্পন্দন’ স্থাপন করেননি তিনি তার হালও ধরেন স্বেচ্ছায়।

পপসঙ্গীত ‘স্পন্দন গোষ্ঠী, ফিরোজ সাঁইয়ের নেতৃত্বে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবে পরের বছর প্রথম দিকনির্দেশনায় তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ফিরোজ সাঁইকে শহীদ শেখ কামাল সভাপতি নিযুক্ত করেন। তা ছাড়াও সামজতত্ত্ব বিভাগের নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে শেখ কামাল বিভাগের সাংস্কৃতিক সপ্তাহের আয়োজন করেন। শুধু সঙ্গীত নয়। নাটক, আবৃত্তি ও উপস্থিত বক্তৃতার আসরও করেন। তার সহায়তা ছাড়া এবং উপাচার্য মহোদয়ের বিশেষ উৎসাহ ছাড়া সাংস্কৃতিক সপ্তাহের আয়োজন মোটেও সম্ভব ছিল না। আমার বিশ^াস তখনকার ছাত্রছাত্রীরা গৌরব অনুভব করেছেন নিজ বিভাগে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ উদযাপন করে। জন্মদিনে শেখ কামালের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

প্রফেসর ড. মো. আসলাম ভূঁইয়া : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1670-1.jpg