বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া


ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মহিতুল ইসলাম আদালতে বলেছেন, আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না, সেই ধারণাতেই আমি রাসেলকে বলি, ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’

বাদী আদালতে বলেন, গেটে অবস্থানরত মেজর বজলুল হুদাকে মেজর ফারুক (ফারুক রহমান) কী যেন জিজ্ঞাসা করেন, তখন মেজর বজলুল হুদা বলেন, ‘All are finished.’ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ নির্ভীকতার সঙ্গে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ খুনিদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনিদের বলেছেন, ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে এভাবে—বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করেন, ফলে খুনিরা সুরক্ষা পান। খুনিদের বিচারে সোপর্দ না করে পুরস্কৃত করেন, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেন ও খুনিরা দম্ভভরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার কথা স্বীকার করে সাক্ষাত্কার প্রদান করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল আদালতে সাক্ষ্য দেন, ১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ৬টায় মেজর রশিদ তাকে বলে, ‘We have captured state power under Khandakar Mustaque, Sheikh is killed, do not try to take any action against us.’ এ কথা শুনে শাফায়াত জামিল হতচকিত হন। দ্রুত ইউনিফর্ম পরে হেড কোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যান এবং তাকে শেভরত অবস্থায় পান, জিয়াউর রহমান শাফায়াত জামিলকে বলেন, ‘So what president is killed...’ খুনি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ‘... এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই..., আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তোমরা করতে পারলে কিছু কর।’ পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলেন, ‘এ বিষয় নিয়া তোমাকে চিন্তা করতে হবে না... আমি deal করব।’ রশিদ পরে জিয়া ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি জিয়াউর রহমান।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর সংসদে আইন পাস করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করা হয়—যাত্রা শুরু হয় কলঙ্ক মোচনের। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটির বিচার সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত ১৯৯৭ সালের ৩ মার্চ মামলার নথিপ্রাপ্ত হন। দায়রা মামলা নং-৩১৯/১৯৯৭ শিরোনাম ‘রাষ্ট্র বনাম লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.) এবং অন্য ১৯ জন’। তদন্তকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ দণ্ডবিধির ১২০-বি/৩০২/১৪৯/৩২৪/৩৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১০৯ ধারায় নিম্নলিখিত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র নং-০৭, তাং- ১৫.০১.১৯৯৭ আদালতে দাখিল করেন।

আসামিদের নাম

লে. কর্নেল ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার, মিসেস জোবায়দা রশিদ (১-৬নং আসামিরা গ্রেফতারকৃত ও জেলহাজতে রয়েছে), লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর মো. বজলুল হুদা (আর্টিলারি),  লে. কর্নেল এসএইচএসবি নূর চৌধুরী ইবি, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম বিইউ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল মো. আবদুল আজিজ পাশা বিএ, লে. কর্নেল এমএ রাশেদ চৌধুরী, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিন ওরফে হীরণ খান ওরফে মোসলেমউদ্দিন খান ওরফে রফিকুল ইসলাম খান, মেজর আহাম্মদ শরীফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, দফাদার মারফত আলী, এলডি মো. আবুল হোসেন মৃধা (পলাতক)। ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ উল্লিখিত ২০ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি) এবং দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা এবং দণ্ডবিধির ২০১ ধারা মোতাবেক ৩-দফা বিশিষ্ট অভিযোগ গঠন করা হয়। মৃত (১) খন্দকার মোশতাক আহমেদ (২) মাহবুবুল আলম চাষী (৩) বিজেও ১৮১০ রিসালদার সৈয়দ ছরোয়ার হোসেন (৪) ক্যাপ্টেন এম মোস্তফা আহম্মদের নাম চার্জ গঠন থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ৬১ সাক্ষী বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।

আলামত ও জব্দ তালিকা যেদিন আদালতে প্রদর্শন করা হয়, চোখের পানি ধরে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর পরনের সাদা পাঞ্জাবিতে ১৫টি, চেক লুঙ্গিতে ১৮টি, বেগম মুজিবের ব্লাউজের পিছনে ১৩টি বুলেটের ছিদ্র দেখে মনে হচ্ছিল আমার আত্মাটাই বুঝি অসংখ্য ছিদ্র হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ঘাতকের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি কবি নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’, যার ভিতর ঝুলে আছে ঘাতকের বুলেট। কবি নজরুল এটি দেখলে কী বলতেন জানতে ইচ্ছে করে! শিশু রাসেলের রক্তমাখা নীল শার্ট, বেগম মুজিবের পরনের লাল পাড়ের সাদা রক্তমাখা শাড়িটি প্রায়ই চোখে ভাসে।

মামলাটিকে প্রলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য আসামিপক্ষ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। বিচারিক আদালত সকল প্রকার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।

আসামি—১. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, ২. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, ৩. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ৪. পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ, ৫. পলাতক আসামি মেজর বজলুল হুদা, ৬. পলাতক আসামি লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, ৭. পলাতক আসামি মেজর শরিফুল হোসেন ওরফে শরফুল হোসেন, ৮. পলাতক আসামি লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী, ৯. পলাতক আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), ১০. পলাতক আসামি লে. কর্নেল এসএইচএসবি নূর চৌধুরী, ১১. পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা, ১২. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাসেম, ১৩. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, ১৪. পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, ১৫. পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে মোসলেমউদ্দিনকে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে খালেদা জিয়া তার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু সুরক্ষা বা পুরস্কৃতই করেনি, আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন হরতাল পালন করেছে। যা সত্যিই দুঃখজনক। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের সাহসী পদক্ষেপে আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিদের সাজা কার্যকর করা হয়। জাতি কলঙ্ক থেকে আংশিকভাবে মুক্ত হয়।

SUMMARY

167-1.jpg