তাজউদ্দীন আহমদ : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর যে নামটি অনিবার্যভাবে এসে যায় সেই নামটি হলো বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে ও উত্তরকালের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন এই তাজউদ্দীন আহমদ। স্কুল জীবন থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। শান্ত, সংযমী, মিতভাষী, দায়িত্বশীল ও ¯েœহপরায়ণ এক অনন্য গুণাবলি সম্পন্ন হিসেবে শৈশব-কৈশোরে বেড়ে ওঠেন তাজউদ্দীন আহমদ।

খ্যাতিমান এই রাজনীতিবিদ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সদস্যও ছিলেন তিনি। মাত্র ২৮ বছর বয়সে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬ দফা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাজউদ্দীনের। ৬ দফা আন্দোলনে তাজউদ্দীন ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব যেদিন পূর্ব পকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন সেদিনই তাজউদ্দীন হন সাধারণ সম্পাদক। শুরু হয় বাংলার রাজনৈতিক আকাশে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন জুটির ঘনিষ্ঠভাবে পথ চলা। আর এই রাজনৈতিক জুটির ঘনিষ্ঠতা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। তাই পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তখন থেকেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাজউদ্দীনকে ভয় পেত। ভয় পেত তার প্রখর মেধা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি এবং কৌশলকে। তাই তাকে ঢাকা জেল থেকে ময়মনসিংহ জেলে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি কেননা তাজউদ্দীনের মেধা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি শেখ মুজিবের ছিল প্রগাঢ় আস্থা।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে পার্লামেন্টারি বোর্ড সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর সদস্য সচিব ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ওই সময় প্রার্থী নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও অবদান মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সফল যোগাযোগের মাধ্যমে একদিকে ভারতের সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন আদায়, অন্যদিকে মুজিবনগর সরকার গঠন। ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে গঠিত হয় সরকার। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ এই সরকারের নামকরণ করেন ‘মুজিব নগর সরকার’। শপথ গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আজ থেকে আমাদের শপথ গ্রহণের এই মেহেরপুরের নাম হবে বাঙালি জাতির সর্বশেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে ‘মুজিবনগর’ এবং এই মুজিবনগর আজ থেকে হবে বাংলাদেশের রাজধানী”। এই মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর সর্ব শ্রদ্ধার আসনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ তীব্রভাবে বঙ্গবন্ধুর অভাববোধ করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঊষালগ্ন থেকে একেবারে চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গতাজ ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক সত্তা। তাঁদের দুজনের সম্মিলিত প্রয়াসই অনিবার্য করে তুলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। অথচ অগ্নি সংগ্রামের মূল ৯ মাস বঙ্গবন্ধুবিহীন তাজউদ্দীনকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছিল। একদিকে ঘরের শত্রু মোস্তাক গং অন্যদিকে পাকিস্তানসহ বহির্বিশ্ব। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে সব সময় স্মরণ এবং সামনে রেখে দৃপ্ত প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী জনতাকে সর্বদা সজাগ রাখতে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। তিনি তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতেন, বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক, নয়নের মণি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মাঝে আমরা ফিরিয়ে আনবোই। তাঁর সেই আত্মবিশ্বাস বৃথা যায়নি, এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন সেদিন তাজউদ্দীন আহমদকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে যেন বাংলার স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছিল এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাজউদ্দীন মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, আর বঙ্গবন্ধু তা গ্রহণ করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম ছিল তাজউদ্দীনের প্রতিজ্ঞা, স্বপ্ন এবং সাধনা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা বসে ছিল না। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। চক্রান্তকারীরা এটা ভালো করে বুঝেছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন একত্রে থাকলে তাদের স্বপ্ন কোনো দিন পূরণ হবে না। তাই তারা প্রথমে চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুকে ভুল বুঝিয়ে তাজউদ্দীনকে দূরে সরিয়ে দিতে। ষড়যন্ত্রকারীদের এই চেষ্টা সফল হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাকশাল প্রশ্নে এবং অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় নিয়ে তাজউদ্দীনের দূরত্ব তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বুক ভরা অভিমান নিয়ে তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে দূরে সরে আসেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই দূরে সরে যাওয়া বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বিরাট ক্ষতি।

নির্মোহ, নির্লোভ এবং নিরহঙ্কার এক অনন্য রাজনীতিক ছিলেন তাজউদ্দীন। তাজউদ্দীনের জীবদ্দশায় তাঁর সবচেয়ে বড় দুঃখ ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ বঙ্গবন্ধুকে শোনাতে না পারা। আর বঙ্গবন্ধু নিজেও কোনোদিন কোনো কথা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাননি। তাজউদ্দীনের এই বলতে না পারা এবং বঙ্গবন্ধুর জানতে না চাওয়া ছিল যেন ভুল। যে ভুলের সদ্ব্যবহার করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের কথা যদি বঙ্গবন্ধু নিজ কানে তাজউদ্দীনের মুখ থেকে শুনতেন তাহলে হয়তো কোনো দিনই তাঁদের সম্পর্কে ষড়যন্ত্রকারীরা ফাটল ধরাতে পারত না, ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু হতেন সচেতন, হতো না ভুল বোঝাবুঝি, সৃষ্টি হতো না দূরত্ব, বন্ধন হতো তাঁদের আরো সুদৃঢ়। আর এর ফলে বাঙালি জীবনে হয়তো নেমে আসত না ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের মতো নির্মম করুণ দিন। আজকের এই বাংলাদেশ হতে পারত অন্য এক বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাজউদ্দীন আহমদ বড় আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, আজ আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম তাহলে কেউ বঙ্গবন্ধুর গায়ের লোম পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারত না। তিনি আরো বলেছিলেন, মুজিব ভাই জেনে যেতে পারলেন না কারা তাঁর বন্ধু ছিল আর কারা তাঁর শত্রু ছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২ মাস ১৮ দিনের মাথায় সংঘটিত হয় বাঙালির ইতিহাসের আরেক নির্মমতার করুণ কাহিনী ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড। নির্মমভাবে শহীদ হন কীর্তিমান এই মহান পুরুষ বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। আমাদের জন্য পশ্চাতে রেখে যান তাঁর সমগ্র জীবনের মহান সাধনা, আত্মত্যাগ ও শ্রেষ্ঠ অর্জন লাল সবুজের এই বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির জন্য তিনি রেখে গেছেন অনন্য নজির- যা তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে। জন্মবার্ষিকীতে কীর্তিমান এই মহান নেতার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জি এম তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1668-1.jpg