১৫ আগস্ট ও পাবনা


বছর ঘুরে যখনই আগস্ট মাসটি ফিরে আসে, বাঙালি জাতির চিত্ত হয়ে ওঠে শোকাতুর। ১৯৭৫ সালের এই মাসে, ১৫ আগস্টের ভোররাতে বাংলাদেশের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত দেশি-বিদেশি শত্রুদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান, দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনীর একাংশের গুলিতে, ৩২নং ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে নির্মমভাবে নিহত হন। নিহত হন সপরিবারে। এমন ভয়াবহ হত্যালীলা, যা কল্পনা করতেও শিউরে উঠতে হয়। বাঙালি জাতি অতীতে কদাপি এমন ভয়াবহ হত্যালীলা দেখেনি। দেখেনি গোটা বিশ্বের অপর কোনো জাতিও। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীও অতর্কিতে নিহত হন আততায়ীর হাতে, তবে তা রাতের গভীরে নিদ্রামগ্ন নগরীতে নয়, নিজ বাসভবনেও নয়- একটি সান্ধ্য সমাবেশে প্রকাশ্যে পিস্তলের গুলিতে। তাঁর পরিবার-পরিজন আক্রান্ত হননি। শ্রীমতি ইন্দ্রিরা গান্ধীও নির্মমভাবে নিহত হন নয়াদিল্লিতে তাঁর বাসভবনের সন্নিকটেই, পরিবারের অন্য কেউ নন। অনুরূপ হত্যালীলা ঘটেছিল পরবর্তীতে তাঁর পুত্র ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ক্ষেত্রেও। এ ক্ষেত্রেও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অক্ষত থেকেছেন।

পরবর্তী দশকের শেষে নিহত হলেন বাংলাদেশের তদানীন্তন সামরিক শাসক এবং স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিদ্রামগ্ন থাকাবস্থায় গভীর রাতে। এ হত্যালীলা সংঘটিত হয় তাঁরই সামরিক বিভাগের ক্ষমতার প্রতিদ্ব›দ্বী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একাংশের দ্বারা। এ ঘটনার বিস্তারিক তথ্য আজো অপ্রকাশিত কারণ জিয়া হত্যার বিচার আজো হয়নি। কোনো এক অজানা কারণে তাঁর সহধর্মিণী খালেদা জিয়া তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও এই ঘটনার বিচারের ন্যূনতম উদ্যোগও গ্রহণ করেননি। দেশবাসীর কোনো অংশের মধ্যেই এই বেআইনি পন্থায় ক্ষমতা দখলকারী তথাকথিত রাষ্ট্রপতি হত্যার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি- আজো তা হয় না। এটা স্বাভাবিকও। কারণ তাঁর ক্ষমতাসীন হওয়া কারো কাম্য ছিল না- জনপ্রিয়তাও ছিল না। টেলিভিশনে যা দেখানো হতো তার সিংহভাগই কৃত্রিম। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও যেভাবে সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হলো ইতিহাসে তা বিশ্বের সর্বাধিক মর্মান্তিক হত্যালীলা বলে বিবেচিত।

বাঙালি জাতি সে দিন কেঁদেছে, গ্রামবাংলায় অনেক মহিলাই খবর পেয়ে রোজা রেখেছেন, সর্বত্র যুবসমাজ অপেক্ষায় থেকেছে ঘটনার প্রতিবাদ প্রতিরোধে নেতৃত্বের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পাওয়ার। কিন্তু না, কোনো কর্মসূচিই ঘোষিত হলো না। তাঁর নিজ দলের বিশ্বস্ত নেতারাও স্থবির হয়ে বসে থাকলেন। সাহস পেলেনই না কোনো কর্মসূচি ঘোষণার। আস্থা রাখতে ব্যর্থ হলেন জনগণের ওপর- যে জনগণ পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বিশেষ করে তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অক্লেশে হাজারে হাজারে জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, হাজারো নির্যাতন সহ্য করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। সেই মানুষেরা ওই দিন ভোররাতে রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার দাবিকৃত ঘোষণাকে বিশ্বাসই করতে পারেননি। অস্থির চিত্তে ছুঁটেছেন এ নেতা-সে নেতার বাড়ি। কিন্তু না, নেতারা এগুলেন না। সে দৃশ্য আজো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ করেছিল জীবন বাজি রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আরো কিছু কিছু জেলায় তাৎক্ষণিকভাবে। কিশোরগঞ্জে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ মিছিল থেকে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে- মামলা হয়, কারাদণ্ডও দেয় আদালত। কিন্তু তা কি যথেষ্ট ছিল? আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলো নেতৃত্বের কাপুরুষতায়। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের এক অংশ না এগুলেও বৃহৎ অংশ চেষ্টা করে বাকশালের নামে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে। সফলও হয় কোথাও কোথাও। পাবনাতে বাকশালের মৌখিক নির্দেশ আসে অনেক বিলম্বে। বিলম্বিত নির্দেশে জানা গেল ৬ নভেম্বর দেশজুড়ে প্রতিবাদ দিবস।

পাবনার ছাত্র ইউনিয়ন গোপনে দিবসটি পালনে প্রস্তুতি নিতে থাকে। হঠাৎ একদিন আমার চেম্বারে (তখন ওকালতি করতাম) কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা সন্ধ্যাবেলায় এসে তাদের কি করণীয় তা জানতে চাইল। বললাম তোমরা আওয়ামী লীগ নেতাদের নামাও। জবারে তারা জানালো, সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা ছুটে এসেছে ন্যাপের অন্যতম নেতা হিসেবে আমার কাছে। জবাবে তাদের গোপনে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্বস্ত এক নেতার নাম বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে যৌথভাবে প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিলাম। তাদের আওয়ামী লীগের কারো সঙ্গে (বিশ্বস্ততা বুঝে) সম্পর্ক রাখতেও বলে দিলাম। ওরা বলল চেষ্টা করব এবং সফল হলে জানাবো। শেষ পর্যন্ত কোনো খবর না পেয়ে নির্ধারিত তারিখের আগের দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে পৌঁছে গেলাম আওয়ামী লীগের এক নেতার বাসায়। সঙ্গে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড প্রসাদ রায় (প্রয়াত)। সেখানে ওই নেতা তো আমাদের দুজনকে দেখে অনেকটা শঙ্কিত বোধ করলেন। জিজ্ঞেস করলাম ঢাকা থেকে বাকশালে কোনো খবর পেয়েছেন কিনা। তিনি পাননি বলে জানালেন। বললাম, আমরা পেয়েছি। অতঃপর বিস্তারিত বলতেই জিজ্ঞেস করলেন, আগামীকাল? তাহলে আরো একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে ডাকি। ডাকার পরপরই তিনি এসে হাজির। কর্মসূচি পুনরুক্তি করতেই তিনি বলে উঠলেন, মার্শাল ল’ জারি আছে জানেন তো? বললাম, ১৯৭১-এ তো সশস্ত্র লড়াই-ই করতে হয়েছিল। এখন ওসব আইন না ভাঙলে চলবে কেন? এরপর দীর্ঘ সময় আলাপ করেও যখন ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত পেলাম না তখন আমরা বললাম প্রোগ্রামটা কিন্তু হবেই এবং তা হলো আগামীকাল সকাল ১০টায় এডওয়ার্ড কলেজ ময়দানে সমাবেশ ও পরে মিছিল। আপনারা যদি যোগ দেন ভালো হয়- বলে দ্রুত আমরা বেরিয়ে এলাম। পরদিন ঠিক সময়মতো এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে পৌঁছে দেখি বিশাল সমাবেশ। ওখানে পৌঁছি এক গোপন পথে ঘুরে ফিরে। সমাবেশে ৫/৭ জন মাত্র আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত হলেন কিন্তু কোনো বক্তব্য না দিয়ে সে দায়িত্ব আমাকে দিলেন এককভাবে। আমি একজন ছাত্র ইউনিয়ন ও একজন ছাত্রলীগ নেতাকে সংক্ষেপে কিছু বলতে বললাম। তাদের বক্তব্য শেষের দিকে যখন একজন ছুটে এসে বলল সামনের গেট আমরা তালাবদ্ধ করে রেখেছিলাম কিন্তু পুলিশ তালা ভেঙে ঢুকতে চাইছে। বক্তাদের বক্তব্য অব্যাহত রাখতে বলে ছুটলাম গেটের কাছে। গিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বললাম, ‘খবরদার গেটের তালা ভাঙার আগে আমাদের বুকে গুলি ছুড়তে হবে।’ পুলিশ রাইফেল তাক করতেই একজন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ছুটে এসে বললেন, ‘দাদা, আমরা বাইরে থাকি। আপনারা ভেতরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে কর্মসূচি সমাপ্ত করুন। মিছিলের প্রোগ্রাম বাতিল ঘোষণা করুন’। বললাম, ‘সমাবেশও হবে, মিছিলও হবে তবে পুলিশ যদি শান্ত থাকে মিছিল হবে শান্তিপূর্ণভাবেই।’ ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘এই ১৪৪ ধারাও জারি করেছেন এসডিও সাহেব।’ বললাম, ‘ঠিক আছে। আমরা ৪ জন ৪ জন করে লাইন করে চলে যাব- পুলিশকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন, আমরা মিছিল নিয়ন্ত্রণ করব। পুলিশ যেন বিন্দুমাত্র উসকানি না দেয়।’ কথাগুলো বলেই সমাবেশ স্থলে ফিরে এসে গেটে আলোচনার বিষয় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং শান্তিপূর্ণভাবে শোক ও প্রতিবাদ মিছিলে লাইন দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা ও দলীয় নেতাকর্মীরা রাস্তার দু’ধারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সবার সামনে এক বন্ধু বঙ্গবন্ধুর বিরাট একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি মাথায় নিয়ে দাঁড়ালেন। ম্যাজিস্ট্রেট ওই ছবিটা নামিয়ে নিতে বললে তা না মেনে সবাই মিছিল শুরু করল। কমপক্ষে দেড় মাইল দীর্ঘ ওই মিছিল দেখে কর্মী-নেতারা যেমন উৎসাহিত বোধ করলেন- তেমনি পথচলা মানুষ ও দোকানে অবস্থানকারী ব্যবসায়ীরা বিস্মিত ও উজ্জীবিত বোধ করলেন। মিছিলে লোকসংখ্যাও ক্রমশ বাড়তে থাকায় পুলিশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মিছিলের পেছন পেছন ট্রাকে করে চলতে থাকল। সামনে একটি জিপ-সশস্ত্র পুলিশ। কিন্তু কেউ কোনো উসকানি দিতে সাহস পায়নি। পেছনে হাঁটাপথে অনেক পুলিশ।

মিছিল অবশেষে স্লোগানে স্লোগানে সারা শহর কাঁপিয়ে তুলে হেডপোস্ট অফিস হয়ে অনন্ত বাজার দিয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নবনির্মিত বাসভবনের আঙিনায় পৌঁছালে আওয়ামী লীগের নেতা এডভোকেট গোলাম হাসনায়েন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে দোয়া পাঠ ও মোনাজাত পরিচালনা করেন। আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করব এমন সময় একজন ছাত্র ছুটে এসে জানালো জাতীয় চার নেতার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংস হত্যার খবর। ৩ নভেম্বর রাতে এ ঘটনা ঘটলেও কোনো মিডিয়াতে তা প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি এবং সে কারণে পাবনাতে তা ওই দিন ওই সময় পর্যন্ত আমাদের কারো জানা ছিল না। যেহেতু জাতীয় চার নেতার একজন হলেন পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং তাঁরই বাসভবনের সামনে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে- তাই সবাই আবেগে, ক্ষোভে, শোকে বেদনার্ত হয়ে পড়েন এবং দাবি ওঠে পুনরায় মিছিল করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করার। যেহেতু তখন আবার মিছিল শুরু করলে তা সহজেই বিক্ষোভ থেকে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়তে পারে এবং শৃঙ্খলা রক্ষাও দুরূহ হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিতে পারে- তাই ঘোষণা করা হলো ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন একটি তারিখ নির্ধারণ করে শোক দিবস ও প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে। এই বলে সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

পাবনার এই সমাবেশ ও মিছিলের খবর কলকাতার আনন্দবাজারসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসমূহে প্রকাশিত হয়েছিল। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, যদি ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যালীলার প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো, নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের জনগণ, বিশাল কর্মীবাহিনী মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সবাই একাত্ম হয়ে সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং নির্ঘাত রাষ্ট্রক্ষমতা ষড়যন্ত্রকারী খোন্দকার মোশতাক গংদের হাত থেকে উদ্ধার করে একটি নতুন দেশপ্রেমিক সর্বদলীয় সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অব্যাহত রাখা যেত- বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাবৎ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করাও সম্ভব হতো। ৩ নভেম্বরের জাতীয় চার নেতা হত্যার মতো ঘটনাও এড়ানো সম্ভব হতো এবং তাঁদেরই নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন চালু করা যেত। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, তেমন কিছু ঘটল না। কেঁদেই শোকাচ্ছন্ন থাকতে হলো বাঙালি জাতিকে।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

SUMMARY

1665-1.png