সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান শেখ মুজিব। তিনি বাঙালি জাতির পিতা। তাঁর দূরদর্শী ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে একটি পরাধীন জাতি পায় স্বাধীনতার স্বাদ। বহু বছরের শোষণ-দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি গড়ে তোলেন সমৃদ্ধিশালী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। একটি অবহেলিত ভূখণ্ডের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার মতো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল নেতা। সক্রেটিসের যোগ্য শিষ্য প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের যেসব গুণের কথা উল্লেখ করেছেন শেখ মুজিবের মধ্যে সেসব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। শেখ মুজিব আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, প্রজাপ্রেমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। যে মানুষটি কখনোই বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, শত্রু ভাবেননি, সেই শুদ্ধ চিত্তের মানুষটিকেই কয়েকজন স্বার্থপর-ঘাতক সপরিবারে হত্যা করল- যা শুধু বাঙালির ইতিহাসেরই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলে বিবেচিত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড শুধু একটি হত্যাকাণ্ডই নয়, একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে। আমরা যদি মুজিব হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রগুলো বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব- একটি স্বাধীন জাতিকে মূলত তারাই ধ্বংস করতে চায় যারা সা¤্রাজ্যবাদের পূজারী বা সা¤্রাজ্যবাদের মদদদাতা। সুতরাং যারা সা¤্রাজ্যবাদী এবং যারা সা¤্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারী হতে হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারী পর্যন্ত সবাই অপরাধী, সবাই মুজিব হন্তারক।
মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সমগ্র বাংলাদেশ থমকে গিয়েছিল। বজ্রাহত মানুষের মতো অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাংলার শোকাহত মানুষ। ঘনিষ্ঠ স্বজন মারা গেলে মানুষ যেমন বাকরুদ্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, মুজিব হত্যার ঘটনায়ও পুরো বাঙালি জাতি শোকে-দুঃখে পাথর হয়ে গিয়েছিল। মানুষ এখন সেই অবশ মুহূর্তগুলোর কথা ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করছেন, তাঁর নামে স্তুতি-স্তব করছেন, এটাই এখন ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আজ প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলল। এই অর্ধ শতাব্দীতে আমি অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি যা আগে কখনো করিনি। জাতীয় শোক দিবস এখন যেভাবে উৎসবের মতো করে পালন করা হচ্ছে আগের দিনের শোক দিবস এভাবে পালিত হতো না। অতীত দিনের সেসব শোক দিবসের জলুস ছিল না, কিন্তু গাম্ভীর্য ছিল। সেখানে সৃষ্টিশীলতার-মননশীলতার চর্চা থাকতো। আজকের দিনে ‘কাঙালি ভোজন’ আর নেতাকর্মীদের হৈ-হুল্লোড়ই প্রধান আকর্ষণ থাকে জাতীয় শোক দিবসে। ব্যানার-ফেস্টুনে নেতাকর্মীরা নিজের ছবি ছাপায় বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় করে, ভুল বানানে লেখা থাকে অসংখ্য আজগুবি ¯েøাগান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় নিয়ম রক্ষার অনুষ্ঠান। এগুলোকে আমি ছোট করে দেখছি না, তবে জাতীয় শোক দিবসের মর্যাদা আরো ব্যাপক ও হৃদয়স্পর্শী হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। ১৯৭৫-এর পরে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ভুলানো হয়েছে, তার নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তার কন্যা শেখ হাসিনা লড়াই-সংগ্রাম করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে থাকে, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণই আওয়ামী লীগের অনুক‚লে। সারাদেশে এখন আমি শুধু আওয়ামী লীগারই দেখি, অন্যান্য দলে যে কিছু নেতাকর্মী নেই, সে কথা বলবো না, তবে বর্তমানে যত আওয়ামী লীগার দেখছি- এত নেতাকর্মী আওয়ামী রাজনীতিতে থাকাকালীন কখনোই দেখিনি। আমার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এরা কারা? এরা কি সত্যিকার অর্থেই মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সিপাহসালার- নাকি সুবিধাবাদী, গুপ্তচর? ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা মুজিব আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করেছেন- আজ তারা অনেকেই আওয়ামী লীগে নেই, অনেকেই মারা গেছেন, অনেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর যারা শেখ মুজিবের পক্ষে দেশে-বিদেশে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, প্রকাশনা বের করেছে, সভা-সেমিনার, বক্তৃতার আয়োজন করেছে তাদের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৯৭৫-এর ২০ আগস্ট আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর নূরুল আমীন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. ম. আখতারুজ্জামানসহ একটি লিফলেট তৈরি করি। সেই লিফলেটটির হেডলাইন ছিল- ‘মীরজাফররা হুঁশিয়ার’। আর লিফলেটের বক্তব্য ছিল- ‘তোমরা যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সহযোগিতা করবে, তাদের সবংশে নির্বংশ করা হবে।’ লিফলেটের হাতের লেখা ছিল নূরুল আমীনের। পরে ওটা হাত মেশিনে ফটোকপি করা হয়। এই লিফলেটটি আমরা মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ডিসি ও এসপিদের কাছে ডাকযোগে পাঠাই এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এরপরে কিছু সাহসী যুবকের নেতৃত্বে প্রকাশিত হয়- ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ নামে একটি কবিতা সংকলন। এই বইটি পরে আমরা ভারতে থাকা অবস্থায় পুনঃপ্রকাশ করি এবং কলকাতা, দিল্লি, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে প্রেরণ করি।
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার শোক মিছিল যায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পরে ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম শোকসভা হয় লন্ডনের কনওয়ে হলে। কিন্তু সেদিনের শোকসভা পণ্ড করার জন্য জিয়ার অনুগত পেটোয়া বাহিনী হামলা করে- তখন লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানসহ অন্যরা (রুহুল কুদ্দুস, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) সাহসের সঙ্গে সেই হামলা মোকাবেলা করেন। জিয়ার অনুগতদের পিটিয়ে হল ছাড়া করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে আমরা দিল্লির গান্ধী মেমোরিয়াল হলে শোকসভার আয়োজন করি। এই শোকসভায় ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাই কমবেশি অংশ নেন। সেদিনের সেই শোকসভায় যারা বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাদের বেশ কয়েকজনের নাম আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। এরা হলেন- ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার, বিশ্বশান্তি পরিষদের রমেশ চন্দ্র, কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ভি ভি রাজু, জনতা পার্টির নেতা কৃষ্ণ কান্ত। সেদিনের শোকসভার সভাপতি ছিলেন বিপ্লবী ও লেখক মন্মথনাথ গুপ্ত।
আমি মনে করি জাতীয় শোক দিবসের তাৎপর্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন আমরা এটি সদ্ব্যবহার করব। শোক দিবসে কান্না-হাহাকার নয়, বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করাই হওয়া উচিত শোক দিবসের মূল লক্ষ্য। এ জন্য দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশি বেশি করে সভা-সেমিনার-প্রকাশনা ও গবেষণামনস্ক হওয়া দরকার।
২০২০-২০২১ সালকে মুজিব বর্ষ বলে সরকার ঘোষণা করেছে। এই দুই বছরে আমি মনে করি ব্যাপক কাজ হওয়া দরকার। দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা গবেষক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক নিয়ে গ্রন্থ মুদ্রণ করা দরকার। এগুলোই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আমি একজন সামান্য মানুষ। জানি না নিজের কথা বললে কে কীভাবে নেবেন তবু বলি- আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন থেকে এ পর্যন্ত আমরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রায় ৫০টির মতো গ্রন্থ রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমরা দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লেখকের প্রবন্ধ দিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যেই তালিকাভুক্ত লেখকের কাছে বার্তা পাঠিয়েছি। সেইসঙ্গে একশ বিখ্যাত কবির কবিতাও প্রকাশ করব ভিন্ন একটি গ্রন্থে। এর মধ্যেই ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে একটি নান্দনিক অ্যালবাম প্রকাশ করেছি। সেটাও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সাধারণ মানুষের। আমি মনে করি, শুধু শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে না থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদের কিছু করণীয় আছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ব্যক্তি মানুষের মনে যখন বঙ্গবন্ধু থাকবেন তখন আওয়ামী লীগ এমনিতেই যুগ-যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে। জাতীয় শোক দিবস এলে দেখি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরাও আজ ছদ্মবেশ ধারণ করে মুজিবপ্রেমী হওয়ার। খুব কষ্ট পাই। যারা পলিটিক্যালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তো আপস করার কথা ছিল না, তবু আজ আমরা সেটাই দেখছি। কেন দেখছি? দেখছি এই জন্য যে, আওয়ামী লীগাররা সংখ্যায় বৃহৎ দেখায় বটে- আসন সংখ্যা এখনো অনেক পিছিয়ে থাকে নানা ষড়যন্ত্রে।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হলো- বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল গঠন করেছিলেন তখন সেটি ছিল সময়ের দাবি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। বঙ্গবন্ধুও চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় দেশকে নিয়ে যেতে যদিও বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষ। বাকশালে সেদিন বাংলাদেশের বামপন্থিরা উৎসাহভরে দলে দলে যোগদান করেছিল। অথচ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে ওই বামপন্থিরাই জিয়ার পক্ষে ১৯ দফা ছাপে এবং জিয়ার খাল খনন কর্মসূচিতে কোদাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ দেশের বামপন্থিরা এটা কি কখনো ভাবেন যে, আওয়ামী লীগ এলে তারা যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তা অন্য কোনো সরকারের আমলে পান না। আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য দল ক্ষমতায় এলেই তাদের ওপর পীড়ন শুরু হয়। গর্তে ঢুকতে হয় তাদের। বাংলাদেশের বামপন্থিদের মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া জরুরি বলেই আমি মনে করি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে ঘরে-বাইরে। আওয়ামী লীগের উচিত হবে এসব ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন করে সব সময় এককভাবে ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টা করা। অতীতে বাংলাদেশ যারাই শাসন করেছে (আওয়ামী লীগ ছাড়া) তারাই চেয়েছে বাংলাদেশকে অনুন্নত ও মৌলবাদী ভাবধারায় নিয়ে যেতে। আওয়ামী লীগ এলেই কেবল উন্নত ও অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।