১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং নিকটাত্মীয়দের ট্যাঙ্ক নামিয়ে হত্যাকারীরা তাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা চরিতার্থ করেনি। যারা হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল তাদের সঙ্গে নিহত কারো কোনো ধরনের দ্ব›দ্ব-সংঘাত ছিল না, অনেকের জানা পরিচয়ও ছিল না। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া প্রতিটি ব্যক্তিই ছিল সামরিক বাহিনীর সাবেক অথবা কর্মরত সদস্য। হত্যাকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণের পেছনে অনেকেরই সহযোগিতা ছিল, ট্যাঙ্ক ও গোলাগুলি সরবরাহে কেউ কেউ নেপথ্যে কাজ করেছে। এরও পেছনে ছিল আরো বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নানা প্রস্তুতি, পরিকল্পনা- যা অতি গোপনে দেশের সবচাইতে সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের চোখে ধুলা দিতে পেরেছিল। এটিকে এক কথায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর গোপন মিশন নামে অভিহিত করা হয়। সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক-কামান-বন্দুক ছাড়া তৎকালীন বাস্তবতায় এমন নিষ্ঠুর রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অধিকন্তু রাতের আঁধার ছাড়াও এটি করা সম্ভব ছিল না। ষড়যন্ত্রকারীরা এসব জেনেশুনেই তাদের প্রস্তুতি সেভাবে নিয়েছিল। অধিকন্তু দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুগে বিশ^ মোড়ল রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে যেসব সরকার তাদের বলয়ের প্রতি শতভাগ আনুগত্য পোষণ করে চলত না তাদের ‘মার্কিন শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করত, জোট নিরপেক্ষ শক্তিকে মার্কিনবিরোধী বলে তকমা লাগিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাত, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই সব সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী শক্তিকে সমর্থন জানাত। বাংলাদেশ বিশ^ রাজনীতির এমন এক হিংসাত্মক পরিস্থিতির শিকার হয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে বা ৭ম নৌবহর প্রেরণের মাধ্যমে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে দেশটি আমাদের পাশে আন্তরিকভাবে দাঁড়ায়নি, অধিকন্তু কিসিঞ্জার সাহেব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিরূপ মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্র, হঠকারী শক্তিকে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের রসদ জুগিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া নেপথ্য শক্তির পেছনে মার্কিন তৎকালীন সরকার ও বিভিন্ন অপশক্তির সমর্থনই হয়তো তাদের কাছে বড় শক্তি ছিল। সে কারণেই প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যকার ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী সংখ্যায় ব্যাপক না হয়েও রাষ্ট্র ক্ষমতায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার ও নিকটজনদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, সেভাবেই তারা ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে রাতের আঁধারে হামলা করে। সেই সময় সরকার প্রধানের বাড়িতে যে ধরনের নিরাপত্তা বিধান থাকা দরকার ছিল- তাতে চরম ঘাটতি ছিল। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে এসেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন; একটি ‘শোষণহীন সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি শুরু থেকে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু একবারও সরকারি বঙ্গভবন ও গণভবনে থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, ভাবতে চাননি তাকে হত্যা করা বা স্পর্শ করার কথা কোনো বাঙালি করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর বিশ^াসের এমন দুর্বলতার কথা জানত, অঙ্ক কষে দেখেছিল দেশি এবং তাদের সহযোগী বিদেশি শক্তিসমূহ। সুতরাং ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে রাতের আঁধারে হামলা করার হিসাবটি ততটা কঠিন বা দুরূহ ছিল না। সেই সময়ে ঢাকা শহরে রাতের আঁধারে এক দুইটা ট্যাঙ্ক ঘোরাফিরা করলেও কেউ কি কল্পনা করতে পারত যে এসব ট্যাঙ্কের গন্তব্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হবে? কিংবা এগুলো বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল? সেনাবাহিনী কি তখন এমন ভাবনা ভাবতে পারত?
সদ্য স্বাধীন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের দাগ তখনো শুকায়নি, মা-বোনদের হাহাকার চারদিকে কানে ভেসে আসত, পাকিস্তান থেকে চার লাখ বাঙালির ফিরে আসা, চারদিকে হাজারো সমস্যার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু দেশটাকে সাংবিধানিকভাবে পরিচালিত করতে শুরু করেছেন, যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র অনেকটাই জমা নিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছেন, খাদ্য সংকট মোকাবেলা করছিলেন, দেশটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশি মর্যাদা লাভের অধিকারী হলো, শত সমস্যার মধ্যেও সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছিল, আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে এমন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ ১৯৭৫ সালে নির্মিত হয়; একটি জাগরণের উপলব্ধি চারদিকে পরিলক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেই ধারায় কিছুকাল অগ্রসর হতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই হয়তো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পরিস্থিতি অতিক্রম করতে সক্ষম হবে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ী এক দেশের নাম বাংলাদেশ উচ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছিল। ঠিক সে ধরনের পরিবেশ পছন্দ ছিল বিদেশি কোনো কোনো মহলের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ এবং তাদের মুরব্বি দেশসমূহ বিশ^ অভিজ্ঞতায় তাদের জন্য মস্তবড় থ্রেট হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করতে থাকে, সে ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রের মূল কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই তাদের বিবেচনায় সবচাইতে বড় বিপজ্জনক রাষ্ট্র নেতা হিসেবে দেখতে থাকে, সুতরাং তাদের পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই ভেতরের ষড়যন্ত্রকারী শক্তিসমূহ দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগঠনের বেশ ক’জন প্রভাবশালী নেতা ১৯৭১ সালেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা মুজিবদরদী হয়ে আড়ালে মুক্তিযুদ্ধকে দ্বিধাবিভক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের প্রবল ¯্রােতের তোড়ে এসব তত্ত্ব ভেসে যায়। এরাই স্বাধীনতার পর গোপনে একত্রিত হতে থাকে। নানা গুজব, অপপ্রচার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অভাব-অভিযোগ ইত্যাদিকে বড় করে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার, নিকটাত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে ছড়িয়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষ এতে ততটা কান দেয়নি, বিভ্রান্ত হয়নি। ফলে ওই সব অপশক্তি বুঝতে পেরেছিল যে, শেখ মুজিবের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় সহজে চিড় ধরানো যাবে না। আবার শেখ মুজিবকে খুব বেশি সময়ও দেয়া যাবে না। কেননা শেখ মুজিব তার গুণাগুণ দিয়েই রাজনীতিতে শীর্ষ স্থানে উঠেছেন, সাফল্য তার জীবনে যত বেশি ভর করেছে তাতে কোনো গণকের পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না যে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার সোনার বাংলা গড়তে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হবেন। যে নেতার অনুপস্থিতেও মুক্তিযুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি, দেশ স্বাধীন না হয়ে থাকেনি, মানুষ অকাতরে জীবন দিতে দ্বিধা করেনি, সেই নেতা ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’ সফল হবেন না- তা কী করে ভাবা যায়? ১৫ আগস্ট সংঘটিত করতে যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী গোপনে যুক্ত হতে থাকে, তারা এসব কিছু হিসাব-নিকাশ করেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে এমন সব কিলারদের রিক্রুট করা হয়, বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছোট সদস্য রাসেলকে হত্যার মাধ্যমে তাদের পশু মনোবৃত্তির পরিচয়ই শুধু দেয়নি, ভবিষ্যতে যাতে বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকে কেউ বাংলাদেশের হাল ধরতে না পারে সেটির প্রমাণ তারা রাখে। একইভাবে বঙ্গবন্ধুর নিকটাত্মীয় স্বজনদের সেই রাতে হত্যা করা হয়। এই পর্ব শেষ করে হত্যাকারীরা খন্দকার মোশতাক, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর গংদের ক্ষমতায় আসীন করে। দ্রুতই সামরিক বাহিনীর প্রধান পদ থেকে মে. জে. শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে বসানো হয়। থলের বিড়াল কিন্তু এতেই দেখা যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের গৃহবন্দি থেকে জেলে নেয়া হয়। অচিরেই যখন মোশতাকের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে, সংসদ সদস্যদের ভেতর থেকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুরু হতে থাকে তখন ষড়যন্ত্রের বহর আরো বাড়ানো হয়, জেলের অভ্যন্তরে ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়- যেন তারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নেতৃত্ব দিতে না পারেন। কিন্তু তাতেও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকেনি। সামরিক বাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, অপপ্রচার ঘটিয়ে পরিস্থতিকে আরো ঘোলাটে করা হয়, এরপরই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার মূল অবস্থানে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে নিতে ধর্ম, ভারতবিরোধিতা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আমদানি, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে রাজনীতির চাবিকাঠি তুলে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের হাতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের এমন সমাধি রচিত হবে- তা ক’জন বুঝতে পেরেছিল, বুঝতে পেরেছিল- সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। বাংলাদেশে তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথচলাকে পিচ্ছিলই শুধু করেননি, রুদ্ধও করে দিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বড় অংশ তার দলে স্থান করে নেয়, নীতি, আদর্শ ইত্যাদিও বিদায় নিতে থাকে।
গণতন্ত্রের পথ চলা এভাবে এতটাই জটিল ও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ে যে, বাংলাদেশে এখন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে দোদুল্যমান, বিভ্রান্ত, দিকভ্রান্ত এবং আপসকামী হয়ে পড়েছে। এরা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে, বিষয়টিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলে প্রচার করার চেষ্টা করে, এখনো নানাভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে, গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যাচার, সাম্প্রদায়িকতা, ভারতবিরোধিতা ইত্যাদি মুখরোচক বিষয়কে গত সাড়ে চার দশক ধরে প্রচার করে বেড়াচ্ছে, এটিই তাদের রাজনীতির উপজীব্য। ১৯৯৬ সাল থেকে বিএনপি খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৫ আগস্টে নামিয়ে আনে, কেক কেটে তা পালন করার উদ্যোগ নেয়। অথচ ১৯৯১ সালে সরকার প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়ার জন্ম তারিখ ১৯ আগস্ট দেখানো হয়। শুধু তাই নয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যায় অংশ নেয়া সবাইকে পুরস্কৃত করেছে, বিদেশি দূতাবাসে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে, তাদের বিচারের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংবিধানে ইনডেমনিটি অন্তর্ভুক্ত করে। এক সময় বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট পালনে বাধা দেয়া হতো, ফ্রিডম পার্টিকে মাঠে নামিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হতো। ১৯৯১-এ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াত-ফ্রিডম পার্টিসহ সব উগ্র, হঠকারী শক্তিকে নিয়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী শক্তিকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টিকে সংসদে প্রধান বিরোধী দল করা হয়। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হলে বিএনপি তাতে বাধা দেয়। বিচারের রায় ২০০১ সালের পর দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বাধা প্রদান করে। কার্যত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে বিএনপিসহ যেসব দল রাজনীতিতে স্থান করে নেয় তারা বঙ্গবন্ধুকেই শুধু তার ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে সচেষ্ট তা নয়, তারা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার রাজনীতির ধারক, বাহক, পৃষ্ঠপোষকের অবস্থানে নিজেদের প্রদর্শন করছে, তাদের শাসনামলে বাংলাদেশ ‘দ্বিতীয় পাকিস্তানের’ স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের তেমন কিছুই তাতে থাকে না, উন্নয়ন, প্রগতি ইত্যাদির কোনো বালাই নেই, কেবলই সাম্প্রদায়িকতা, আওয়ামী বিরোধিতা ইত্যাদিই এই রাজনীতির প্রধান উপজীব্য।
এই শক্তির কাছে বাংলাদেশে এখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি মস্ত বড় শত্রু। সে কারণেই ২০০১-২০০৬ সালে আওয়ামী নিধন হয়েছে নির্বিচারে, ২১ আগস্ট সংঘটিত হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার নানা ষড়যন্ত্র সংঘটিত হয়েছে, অনেকবারই শেখ হাসিনার সরকারকে ‘আরব বসন্তের’ মতো রাস্তায় মানুষ জড়ো করে উৎখাতের চেষ্টা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যানারে একবার উৎখাত করার চেষ্টা করা হয়েছিল, ৫ মে, ২০১৩ সালে হেফাজতের ব্যানারে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করা হয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সর্বশেষ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সামাজিক আন্দোলনের ওপরও ভর করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রের নানা নাটিকা এখন রচিত হচ্ছে, হবেও। কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসীরাই শুধু নয়, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে বিশ^াসী মানুষজন কতটা এসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকবে, বুঝবে এবং প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেবে সেটিই বড় প্রশ্ন।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়।