সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মামলার রায় কার্যকর হতে সময় নিয়েছিল প্রায় ৩৮ বছর। আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হতে সময় নিল প্রায় ১৪ বছর। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দিতেই এই দুটি ঘটনা ঘটিয়েছিল। দেশি-বিদেশি চক্র চায়নি শেখ পরিবার বেঁচে থাকুক। কারণ এই পরিবারকে নিঃশেষ করতে পারলেই হয়তো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, এই ইতিহাস কারো অজানা নেই। হত্যা করেই তারা থেমে থাকেনি, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন না হয় সেই লক্ষ্যে খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ বন্ধ করে। কারণ যারা পাকিস্তানি দোসর তারাতো আর এই বিচার চায়নি। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে এই অধ্যাদেশ বাতিল করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ উন্মুক্ত করে এই খুনিদের বিচার করেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হতে সময় নেয় প্রায় ১৪ বছর। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই ঘটনা ঘটায়। উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিলেই হয়তো আওয়ামী লীগের গতিপথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ দেশের ইতিহাসে একটি নাম। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন।
যারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন- মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অকাল প্রয়াত নেতা শামসুল হক- তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক এই ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একদিন বাঙালির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ বাঙালিদেরই করতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই প্রথমে তোমাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। তারপর ২৩ জুন এই ঐতিহাসিক দিনটি বেছে নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। লক্ষ্য ছিল একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করা।’ জাতির পিতা যে লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, ১৯৬২-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে বাংলার মানুষকে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯৬২তে আমাদের স্লোগান ছিল ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
১৯৬৬তে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়েছিলেন লাহোরে। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে ৬ দফা দিলেন। বিমানবন্দরে জাতির সামনে ৬ দফা পেশ করলেন এবং ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জাতির পিতা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন এবং শহীদ জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক হলেন।
৬ দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমাদের বলতেন ‘সাঁকো দিলাম, এই সাঁকো দিয়েই একদিন আমরা স্বাধীনতায় পৌঁছব।’ ৬ দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষদিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিক‚ল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালে ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’ সেদিনের বক্তৃতায় তিনি আরো বলেছিলেন, ‘৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতাদের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়- এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান।’ সত্যিকার অর্থেই আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। ৬ দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করা হলো। আমরা জাগ্রত ছাত্র সমাজ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে রাজপথে নেমে এসে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছিলাম। আসাদ, মকবুল, রুস্তম, মতিয়ুরসহ অসংখ্য শহীদের বিনিময়ে। তখন স্লোগান ছিল ‘পাঞ্জাব না বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা’। এভাবে ধাপে ধাপে বাংলার যুবসমাজ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং জাতির পিতাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছি। তারপরে আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যখন ১ মার্চ জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করল ইয়াহিয়া খান। তখন দাবানলের মতো আগুন জ্বলে উঠল।
রাজপথে লাখ লাখ লোক নেমে এল। শুরু হলো আরেক দফা আন্দোলন। তারপর জাতির জনক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করলেন এবং শেষ করলেন এই কথা বলে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই বক্তৃতাটিই ছিল আমাদের ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু ৯ মাস মিয়ানওয়ালী কারাগারে কারারুদ্ধ অবস্থায় যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন আমরা তখন হাতিয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর দেশকে স্বাধীন করেছি।
সুতরাং জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এই যে ইতিহাস, তার শুরু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই; সুতরাং আওয়ামী লীগের অর্থই হলো সংগ্রাম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আর চক্রান্ত করে ধ্বংস করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যখন সফল হতে পারেনি, ভবিষতেও আর পারবে না। ঘরে ঘরে মুজিব সৈনিকের জন্ম হয়েছে। শত চেষ্টা করেও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আর সফল হতে পারবে না।
এ কে এম দেলোয়ার হোসেন : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।