একটি ইতিহাস এবং শেখ হাসিনার জন্ম


উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতবাসীর মধ্যে আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটে। অরাজনৈতিকভাবে গঠিত হলেও কংগ্রেস গঠন ছিল সে চেতনারই প্রকাশ। পরবর্তী ১৯০৬ সালের ২৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলনে এক প্রস্তাবনার মাধ্যমে ব্রিটিশ-ভারতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’। তার কয়েক বছর পর ১৯০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইংরেজ শাসকরা ‘ভারতীয় কাউন্সিল আইন’ ঘোষণা করেন। এ আইনটি ‘মর্লে-মিন্টু’ আইন নামেও পরিচিত। এই আইনটি দ্বারা ভারতবর্ষে মুসলিম-হিন্দু দুটি ধর্মবিশ্বাসীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আলাদা জাতি স্বীকার করে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়- এ ঘটনাটি ছিল ভারতবর্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম স্বীকৃতি।

এ ঘটনাটি ছিল ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সরকারের ডিভাইডেশর রুলস প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। এ ঘটনার পর মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়কে চেষ্টা সত্ত্বেও কখনো এক করা যায়নি। বরং ভারতবর্ষের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এ দুটি সম্প্রদায়ের আত্মঘাতী সংঘাত বিশ^ মানবতাকে কলঙ্কিত করেছে। পরবর্তীকালে অসাম্প্রদায়িক দল কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগসহ কয়েকটি দল এই বিরোধকে রাজনৈতিকভাবে জিইয়ে রেখেছে। যার সর্বশেষ ভয়ঙ্কর প্রকাশ ঘটে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট।

অসাম্প্রদায়িক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দূরত্ব কমিয়ে ভারতের রাজনীতিকে সুস্থির পর্যায়ে আনয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ক্যাবিনেট মিশন পাঠায়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালের ১৬ মে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। যে বিবৃতিতে ১২ সদস্যবিশিষ্ট সরকার গঠনের প্রস্তাবনায় ৫ জন হিন্দু, ৫ জন মুসলিম, ১ জন তফসিলি হিন্দু, ১ জন অপর ধর্মের সদস্য রাখার কথা বলা হয়। জিন্নাহ এ প্রস্তাবনা মেনে নেন। কিন্তু কংগ্রেস সদস্য সংখ্যা সমতা মেনে নেয়নি। এ সংকট চলাকালে মুসলিম লীগের একই দাবি ও অধিকার থাকলেও দলটিকে বাদ দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেসকে এককভাবে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানায়। এই বিমাতাসুলভ আচরণে ব্রিটিশ সরকারের বিপক্ষে ভারতবর্ষের মুসলিম জাতি প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবর্ষ জুড়ে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস ঘোষণা করেন। সে সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস উপলক্ষে তিনি সমগ্র প্রদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।

মুসলিম লীগ নেতাদের এই প্রতিবাদ হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল নেতাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। বিশেষ করে কংগ্রেসকে সরকার গঠনের ক্ষমতা দেয়ার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস ঘোষণা করায় বঙ্গীয় কংগ্রেসের নেতারা প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতারা এ ঘোষণার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেন। তবে এ বিষয়টিকে জটিল করে তুলে হিন্দু মহাসভা। মহাসভার নেতারা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বসেন।

মুসলমান-হিন্দুর এই কঠোর অবস্থানের কারণে কলকাতায় ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হয়। সপ্তাহকাল ধরে চলমান দাঙ্গায় শত শত নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হয়। অসংখ্য মানুষকে সর্বস্ব হারাতে হয়। কলকাতা থেকে সমগ্র ভারতে সে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিহার প্রদেশে হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানকে কচুকাটা করা হয়, ধর্ষিত হয় শত-সহস্র নারী। এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে নোয়াখালীতে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিন্দু নিধন। সব ভারত সাম্প্রদায়িকতার আগুনে পুড়ে ছারখার হতে থাকে। এই দাঙ্গার নিষ্ঠুরতা রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ এভাবে তুলে ধরেছেন :

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ও পরবর্তী কয়েকদিন কলিকাতায় যে হৃদয়বিদারক, অচিন্তনীয় ও কল্পনাতীত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হইয়াছিল, যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া এমন নৃশংসতা আর কোথাও দেখা যায় না। … মনে হইলে সজীব চিত্রের মতোই চোখের সামনে ভাসিয়া ওঠে। গা কাঁটা দিয়া ওঠে। স্বাভাবিক হৃদয়বান মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিবার কথা। আমার নিতান্ত ঘনিষ্ঠ আলীপুর কোর্টের এক ব্রাহ্মণ তরুণ মুন্সেফ সত্য সত্যই কিছুকালের জন্য মনোবিকার রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। রিটায়ার্ড জজ ও বয়স্ক উকিল-ব্যারিস্টারের মতো উচ্চশিক্ষিত কৃষ্টিবান ভদ্রলোকদিগকে খড়গ রামদা নিয়া তাদের মহল্লার বস্তির মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করিতে দেখিয়াই ঐ তরুণ হাকিমের ভাবালু মনে অমন ধাক্কা লাগিয়াছিল। তিনি ছুটি লইয়া বেশ কিছুদিন সেন্ট্রাল হাসপাতালে থাকিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। আমার অবস্থাও প্রায় ঐ রূপ হইয়াছিল। আমার মহল্লায় হয়তো একজন মুচি ফুটপাতে বসিয়া মুসলমানদেরই জুতা মেরামত করিতেছে। হয়তো একজন হিন্দু নাপিত ফুটপাতে বসিয়া ক্ষৌরকাজ করিতেছে। হঠাৎ কয়েকজন মুসলমান আততায়ী ধারালো রড বা বল্লম তার মাথায়, গলায় বা পেটে এপার-ওপার ঢুকাইয়া দিল। মুহূর্তের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া লোকটি সেখানেই মরিয়া পড়িয়া রহিল। বীরেরা জয়ধ্বনি করিতে করিতে চলিলেন অন্য শিকারের তালাশে। এমন নৃশংসতা দেখিলে কার না মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিবে?

ভারতবর্ষ জুড়ে এমন অনেক ভয়াবহ ও নৃশংস দাঙ্গাই মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের আলাদা দুটি দেশ গঠনের ইন্ধন জোগায়। বিশেষ করে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা এটাকে পুঁজি করে রাজনীতি শুরু করেন। এ সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে দুটি ভাগ করে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের আলাদা একটি দেশ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম নেতারা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দেন-দরবার শুরু করেন। মুসলিম-হিন্দু দাঙ্গা কবলিত ভারতবর্ষে সে সময় তাদের যুক্তি ফেলে দেবার মতো ছিল না। ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতবর্ষ ভেঙে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ এবং ১৫ আগস্ট ‘ইন্ডিয়া’ নামে দুটি দেশ গঠন করে স্বাধীনতা দেয়া হয়।

এ ঘটনায় ভারতের মুসলমান ও হিন্দু দুই পক্ষই খুশি হয়েছিল। বেশি খুশি হয়েছিল হিন্দু জমিদার শাসিত পূর্ববাংলার মুসলিম সম্প্রদায়। সে খুশির ঢেউ দেশভাগের আগেই এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর শরীরেও লেগেছিল। তারা জেনেছিল, মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ হচ্ছে। তারা শিগগিরই ধর্মভিত্তিক স্বাধীন একটি দেশ পেতে যাচ্ছে। যে দেশে আর যায়ই থাক, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থাকবে না।

১৯৪৭ সালের মধ্যবর্তী সময় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়। এ সময় দুই শত বছরের দুঃসহ ব্রিটিশ-শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে এবং এ বছরের ১৪ আগস্ট নতুন একটি স্বপ্নের পতাকা উড়িয়ে মুসলিম-বাঙালি জাতির জন্য পাকিস্তান নামক নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম ঘটে। তখন পূর্ববাংলার প্রতিটি ঘরে আনন্দের স্রোতময় বন্যা। তারা জেনেছিল, নতুন দেশ তাদের ভাত দেবে, কাপড় দেবে, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দেবে। জমিদার-পাইক-পেয়াদা ও সাদা চামড়ার সাহেবদের অত্যাচার-অনাচার, চোটপাট থাকবে না। চাষ-বাসের জমির খাজনা লাগবে না- শত রকমের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির আকাঙ্খার ঘূর্ণায়নে তখন নব-আনন্দের অশ্রæধারায় সিক্ত পূর্ব বাংলার মুসলিম-বাঙালি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রিটিশ দুঃশাসন ও জমিদারদের দৌরাত্ম্য থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতিসত্তার গভীরে মুক্তির নতুন শিহরণ অনুভব করে। নতুন স্বাধীন-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনন্দ-স্রোত যে সময় পূর্ববাংলার প্রতিটি মুসলিম পরিবারে অনুরণিত, মুক্তিময় উজ্জ্বল সেই সময়ে শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতা লাভের পরের মাস ২৮ সেপ্টেম্বর বেগম ফজিলাতুন্নেছার কোল আলো করে জন্ম নেন। ফলে শেখ লুৎফর রহমানের পরিবারে তৃতীয় প্রজন্মের আগমনে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সংগ্রামী যুবনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয়ে যুক্ত হয় আরেকটি মধুর আনন্দ।

বাঙালি জাতির একটি স্মরণীয় ইতিহাসের সঙ্গে এক হয়ে মিশে যায় জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মকাল।

হাসানুর রশীদ : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বিশ্ব ইতিহাস কেন্দ্র ও জাদুঘর।

SUMMARY

1657-1.jpg