উগ্র সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে এবং একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকদের ক‚টকৌশল ও বিভাজননীতির প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে হিন্দু জনগোষ্ঠী ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রসর থাকে। সে কারণে তারা চাকরির সুবিধাসহ শাসককুলের আনুক‚ল্য লাভ করে। মুসলমানরা পিছিয়ে থাকে ইংরেজি শিক্ষায় অনগ্রসরতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির মনস্তাত্তি¡ক অবস্থানগত কারণে। প্রাক-ব্রিটিশকালে প্রায় গোটা ভারতবর্ষ মুসলমান শাসকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মুসলমানদের হাত থেকেই ভারতের শাসনভার নিয়েছে ইংরেজ। অতএব মুসলমান জনগোষ্ঠী ইংরেজ আধিপত্য বিরোধী ছিল প্রথম থেকেই। মোটকথা, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং সংকটের সমাধান টানতে ধর্মভিত্তিক দুই দেশ সহজ সমাধান হিসেবে মেনে নেয় হিন্দু ও মুসলমান নেতৃত্ব। ঐতিহাসিক সত্য এই যে, পাকিস্তান গঠনে বড় ভূমিকা রাখে বাঙালি মুসলমান। তবে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নভঙ্গ ঘটতে দেরি হয়নি। নতুন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নব্য মুসলমান উপনিবেশবাদীদের চেহারা স্পষ্ট হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাভাষার আন্দোলন সেই স্বপ্নভঙ্গেরই প্রথম বিস্ফোরণ।
বাংলা ভাষা আন্দোলন ঘটে দুটি পর্যায়ে। সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা পাকিস্তানি নব্য শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থানে। পরেরটি, অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ ভাষা আন্দোলন ঘটে ১৯৫২ সালে, যা আমাদের ইতিহাসে মহান একুশকে উপহার দিয়েছে। এই দুই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সদ্য জন্ম নেয়া পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষীরা তাদের হারানো জাতিসত্তা খুঁজে পায়। তারা একক ও অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ ঘটায়। যে সাম্প্রদায়িকতা পাকিস্তান সৃষ্টি করে, সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেই বাঙালি জনগোষ্ঠী রুখে দাঁড়ায় স্বল্পসময়ের ব্যবধানে। বলতেই হয়, সেটি ছিল এক তাৎপর্যময় জাতীয় উন্মেষ, একটি নবজাগরণ, যা বাঙালিকে নতুন করে আত্মসচেতন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার পথ দেখায়।
এই উন্মেষ বা আত্মসচেতনতার প্রথম রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির মূল কারিগর, তার চূড়ান্ত ভরাভুবি ঘটে এই নির্বাচনে। এই নির্বাচনেই বাঙালি গণমানুষ তার ভাষা-সংস্কৃতির পূর্ণ আবেগ নিয়ে, সকল মতপথের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে এক কাতারে নিয়ে আসে। অবশ্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির যুক্তফ্রন্ট সরকারকে অচিরেই ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানি ধর্ম জাতিতত্ত্বের পুরধারা। কারণ তারা বাংলার মাটিতে কখনোই সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন চায়নি।
বলাই বাহুল্য, বাহান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার যে স্ফ‚রণ ঘটে, তা আর থেমে থাকে না। সে পথ দীর্ঘ বা কণ্টকাকীর্ণ হলেও জাতিকে ক্রমান্বয়ে তা সামনে এগিয়ে নেয়। অগ্রসর করে। ১৯টি বছর ধরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি গণমানুষ আত্মানুসন্ধান করে, পরিশুদ্ধ হয়। এবং সেই আত্মানুসন্ধানের বাঁকে বাঁকে বাঙালি জাতি অগ্রসর হয়, পৌঁছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণাঙ্গনে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বাতাবরণে এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চায় বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মনোজগতে জাতি-পরিচয়ের যে দ্ব›দ্ব বা সংকট তৈরি হয়, বাংলাভাষা আন্দোলন সে সংকট বা দ্ব›দ্ব ভাঙতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীরা, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নির্বিশেষে, নতুন উপলব্ধিতে সমৃদ্ধ হয়। ভাষা ও সংস্কৃতির বাঁধন ধর্মের বাঁধনকে ছাপিয়ে বাঙালিকে জাগ্রত করে। যেন অন্ধকার থেকে আলোতে আসে তারা। পথপ্রদর্শনের সেই আলো জ্বালিয়ে দেয় বাহান্ন। নতুন সে পথেই জাতি এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানের মেকি ধর্ম বাঁধন কিংবা বর্বর সামরিক আধিপত্য, কিছুই তাকে বাঁধতে পারে না। বাঙালি নতুন করে নিজেকে আবিস্কার করে। তার আত্মপরিচয়ের সংকট ঘুচতে থাকে। ধর্ম ও সামরিক আধিপত্য যত তাকে বাঁধতে চায়, তত তার মোহমুক্তি ঘটে। ততই সে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধ হয়। বেগবান হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ।
এই প্রগতিশীল উত্তরণের নানান অবস্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভূমিকা রাখে। তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে ছাত্র বা তারুণ্যের সংগ্রাম। বলাই বাহুল্য, মুখ্য ভূমিকা রাখেন বাঙালির মুখ্য জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন। এরই মধ্যে যুক্ত হয় আগরতলা মামলা, যা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুতে বা বাঙালির অধিকার আন্দোলনের মূল নেতায় পরিণত করে। এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ঊনসত্তরের গণবিস্ফোরণ, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। পরিশেষে আসে ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
বাংলাভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির যে দীর্ঘ পথপরিক্রমা তাতে সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি বড় অংশীদারিত্ব আছে। ১৯৪৮-এর প্রথম ভাষা আন্দোলনে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা এমনকি ধর্মীয় জাতীয়তার প্রবক্তা তমদ্দুন মজলিশের ড. আবুল কাশেমসহ আরো অনেকেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদে মুখর হন। জাতীয়তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও মাতৃভাষার প্রশ্নে তারা এক হন। তারা চট্টগাম, কুমিল্লা ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলন করেন। এসব সম্মেলন জনচেতনায় বড় প্রভাব ফেলে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ও বিশ্বশান্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আসে এসব সম্মেলনে। সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে এসব সম্মেলন হয়ে ওঠে এক একটি মানবতাবাদী মঞ্চ। ঢাকার কার্জন হলে আয়োজিত ১৯৫৪ সালের তিনদিনের পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলনেই রাষ্ট্রভাষা ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লা তাঁর যুগান্তকারী বক্তব্যে হিন্দু-মুসলমানের দাড়ি-টিকি, লুঙ্গি-ধুতির পার্থক্যকে বাহ্য বিষয় আখ্যা দেন। বলেন, বাঙালির অন্তরে মা প্রকৃতি তাদের এক বাঙালি করেই সৃষ্টি করেছেন।
মোটকথা, ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মনোজগতে মহাবিক্ষার যে বহ্নিশিখা প্রজ¦লিত হয়েছিল, তার মুখ্য কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বঞ্চিত, অবহেলিত জাতির বুকে বল দিয়েছিলেন, কণ্ঠে প্রতিবাদের ভাষা দিয়েছিলেন, বিদ্রোহের মশাল জ্বলেছিল, জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও অধিকার বা আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করেছিলেন, প্রতিরোধে দাঁড়াবার শক্তি জুগিয়েছিলেন। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের সিঁড়ি বেয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত হবে যে, বাহান্নর ও মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্তে যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, সে রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ, সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি আজও আত্মসমর্পণ করেনি। পাকিস্তান রাষ্ট্র আত্মসমর্পণ করলেও এসব অপশক্তি আজও নানান অঙ্গনে সক্রিয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আবারো ফিরে আসে সাম্প্রদায়িকতা, ক‚পমণ্ড‚কতা, আসে ধর্মীয় উগ্রবাদ। পুনর্জাগরিত এই বিষবৃক্ষগুলো বাঙালির শাশ্বত উদারতাকে গ্রাস করতে উদ্যত। অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ কম। এক-দুটি নির্বাচনী বিজয় রাজনৈতিক শক্তির অধিষ্ঠান ঘটায় বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ডের পূর্ণ মেরামত ঘটে না। অতএব বাঙালি জীবনে আরেকটি বড় লড়াই প্রয়োজন। সে লড়াই সংস্কৃতির লড়াই, মনোজাগতিক মুক্তির লড়াই। বাহান্নর ও একাত্তরের চেতনা পুনঃস্থাপনের লড়াই। মানবিক, আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ লড়াইয়ের বিকল্প আছে বলে আমি মনে করিনে।
আমরা জানি, দুটি ঐতিহাসিক মহালগ্ন আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। ২০২০ সাল বাংলাদেশের রাষ্ট্র জনক, জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীর বছর। ২০২১ সালে পালিত হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী। এই দুটি মহালগ্ন ঘিরে আমরা যদি একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হই, একটি সার্থক সাংস্কৃতিক নবজাগরণ, আমার বিশ্বাস, তাহলেই কেবল একুশ ও একাত্তরের শহীদরা তৃপ্ত হবে। বাঙালি ও বাংলাদেশ নিরাপদ হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সহজতর হবে।
হারুন হাবীব : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।