বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ


মাহজাবিন খালেদ

বহু আন্দোলন ও  সংগ্রামের  মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই আন্দোলন সংগ্রামে যিনি গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন এবং সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। এসময় তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাগারে বন্দি থেকেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তবুও তিনি পিছপা হননি।  তার এই ত্যাগ তিতিক্ষার ফসলই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশেরও জন্ম হতো না। আজ দুঃখ হয় স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে বঙ্গবন্ধুর নামকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে খুনি মোস্তাক-জিয়ার অনুসারী বিএনপি জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। তারা বর্তমান প্রজন্মকে বিকৃত ইতিহাস পড়িয়ে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে। সেই বিভ্রান্ত থেকে বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষত্ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানানো উচিত।                                             

২৫ মার্চ রাতে বাঙালির উপর ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী। তারা প্রথমেই গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের আহবান জানান। শুরু হয় সারা দেশে সশস্ত্র লড়াই। সারা বাংলাদেশেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক সর্বস্তরের জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকরা, ইপিআর বাহিনীর সৈনিকরা, পুলিশবাহিনী, আনসারবাহিনী ও মুজাহিদবাহিনীর সদস্যরা। অধিকাংশ স্থানেই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিকরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে কয়েকজন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না করলেই হয় না। এর মধ্যে উল্লেখ্য মেজর খালেদ মোশাররফ,  মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর সি আর দত্ত, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও মেজর রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। পাকিস্তান সামরিক জান্তা মেজর খালেদ মোশাররফকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ঢাকা থেকে কুমিল্লা এবং পরে সীমান্ত এলাকায় শমসেরনগর পাঠায়। সেখান থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পান। তার নির্দেশেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। তার সৈনিকরা পাকিস্তানিদের হত্যা এবং গ্রেফতার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে হানাদারমুক্ত করে। সেখানে অবস্থান করেই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র শ্রমিক যুবকদের নিয়ে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সদর দপ্তর  হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় স্থানান্তর করেন। গঠন করেন দুই নং সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্স। এর মাধ্যমেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে। তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল দেশের বিশাল এক এলাকা। অর্থাত্ দুই নং সেক্টর ১১টি সেক্টরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বড় এবং তিনটি ফোর্সের মধ্যে ‘কে’ ফোর্সও ছিল সবচেয়ে বড়।

খালেদ মোশাররফের তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে ১৯৭১ সালের চার এপ্রিল যুদ্ধরত বাঙালি অধিনায়কদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর মমিন চৌধুরী, মেজর কাজী নুরুজ্জামান এবং অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্ণেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা, লেঃ কর্ণেল আঃ রব প্রমুখ। এই বৈঠকের প্রধান উদ্যোগী ছিলেন চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক বিদ্রোহী বীর বাঙালি মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সহযোগিতায় যুদ্ধরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের তার সদর দপ্তরে মিলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে ১৯৭১ সালের চার এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিন। কারণ ঐ সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার ফলেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সম্মেলনেই এমএ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। যদিও মেজর জিয়া প্রধান সেনাপতির দাবিদার ছিলেন কিন্তু খালেদ মোশাররফের প্রচেষ্টায় জিয়ার দাবি ব্যর্থ হয়। এদিকে ২৬ মার্চের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যায়। সেখানেই ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল  গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা হয় তাজউদ্দিন আহমদকে। উক্ত মন্ত্রী পরিষদ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার ভবেরপাড়া গ্রামে। উক্ত গ্রামের নাম রাখা হয় মুজিবনগর, তাই সরকারের নাম হয় মুজিবনগর সরকার। এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য খন্দকার মোস্তাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করা হয়। একই সাথে তার কয়েকজন সহকর্মীকে অপসারণ করা হয়। যদিও ওসমানী বারবার কুচক্রী জিয়ার বিচারের কথা বলেছেন কিন্তু তাকে মুজিবনগর সরকার কোনো শাস্তি দেয়নি শুধু যুদ্ধকালীন সময়ের বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য। সেদিন যদি এই মোস্তাক-জিয়া চক্রের শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো তাহলে হয়ত স্বাধীন বাংলাদেশে ১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর ও ৭ নভেম্বরের মত ঘটনা ঘটতো না। দেশ ও জাতি হারাতো না মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, হারাতো না জাতীয় চার নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এইচএম কামারুজ্জামানকে, হারাতো না ২নং সেক্টর ও ‘কে ফোর্সের’ অধিনায়ক মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরোত্তম, এটিএম হায়দার বীরোত্তম, খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রমসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে। তাই আজ আমাদের সেই খুনি মোস্তাক-জিয়া চক্রের অনুসারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। না হলে হুমকির সম্মুখীন হবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। 

SUMMARY

165-1.jpg