মার্চ মাস বাংলাদেশের জন্য রক্তে রঞ্জিত বিভীষিকার মাস। মার্চ মাস এলেই স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। ১ মার্চ ১৯৭১, ঢাকা স্টেডিয়ামে ব্রিটিশ-পাকিস্তানের জমজমাট ক্রিকেট খেলা চলছে। আমরা সদলবলে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে গেয়েছি। খেলার মাঝখানেই খবর এলো তদানীন্তন পাকিস্তানের চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। ৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান সংসদ ডেকেছেন। স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সব কিছু ভণ্ডুল করে দিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন ইয়াহিয়া খান।
১ মার্চের এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা ঘটল। কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম মানুষের রণহুঙ্কারে গর্জে উঠল। ¯েøাগানে ¯েøাগানে মুখরিত হয়ে উঠল ঢাকা স্টেডিয়াম। বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় খেলা ক্রিকেট। সেই খেলা সঙ্গে সঙ্গেই ভণ্ডুল হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাস্তায় নেমে এলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে হোটেল পূর্বানীতে নেতাদের নিয়ে মিটিংয়ে বসলেন। মিটিং চলাকালে হাজার হাজার মানুষ মিছিলসহকারে সেখানে উপস্থিত হয়। এসব মিছিলের মুখ্য ¯েøাগান ছিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ মিটিংয়ের পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি জনসভায় সিদ্ধান্ত জানাবেন। ইতোমধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের ম্যাপঅঙ্কিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর ঢেউ লাগল। নতুন আঙ্গিকে স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নিল। এর পরপর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র জনতার এক বিশাল জনসভায়ও স্বাধীনতার ঘোষণার সনদসহ ১১ দফা দাবি উথাপন করে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ করল।
এদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করলেন পূর্ব পাকিস্তানে যেমন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ তেমন পশ্চিম পাকিস্তানে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনিও প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার। বিকল্প পথ হিসেবে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রস্তাব করলেন তিনি। আমি রোজকার মতো সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’ অফিসে যাই। স্বনামধন্য কবি সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিক ‘সমকাল’-এ আমি কাজ করি। দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাই সমকাল অফিসে কবি সিকানদার আবু জাফরের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ৭ মার্চের সকালে তদানীন্তন দৈনিক পাকিস্তানে কবি সিকানদার আবু জাফরের বুদ্ধিজীবী মহলের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতা ছাপা হলো। সাংবাদিক, সাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান পরম সাহসিকতার পরিচয় দিলেন পত্রিকায় এই কবিতাটি ছেপে। সকালে বঙ্গবন্ধু এই কবিতাটি পড়েছিলেন। তার অন্যতম বন্ধু সিকানদার আবু জাফরকে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন তার আর কোনো সংশয় নেই যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল তার পাশে আছে। বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা সব বুদ্ধিজীবী মহলে এক নতুন উদ্যম-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে ৭ মার্চের সকালে এই কবিতাটি ছাপা হওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। সকালে যথারীতি সমকাল অফিসে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সুসাহিত্যিক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ সমকালে এলেন। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ সাহিত্যাঙ্গনে এক দিক পাল এবং ‘আলোকিত মানুষ’ সৃষ্টির অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে আজ বাংলাদেশে বিবেচিত। আমরা দুজন রেসকোর্স ময়দানে এসে সভাস্থলে মঞ্চের ঠিক নিচেই বসলাম। হাজার হাজার মানুষ ¯েøাগানে ¯েøাগানে উদ্বীবিত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে এসে জমায়েত হতে থাকল। ¯েøাগানের মুখ্য বক্তব্য- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ মানুষে কানায় কানায় পরিপূর্ণ, বিস্ফোরণোন্মুখ মানুষের মাঝে একটাই আকাক্সক্ষা ‘দেশের স্বাধীনতা’।
৭ মার্চের ভাষণ সবাই জানেন। দ্বিতীয়, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক। তৃতীয়, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এটা চূড়ান্ত স্বাধীনতার ডাক বলে আমার মনে আর কোনো দ্বিধা ছিল না। এই মিটিংয়ের পর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি ক্ষমতা হস্তান্তর কর অথবা সশস্ত্র যুদ্ধ। মাসজুড়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর প্রতিদিন খবরের কাগজজুড়ে প্রকাশিত হতে থাকল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়তে শুরু করল। আমিও খুলনায় আমার স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে ঢাকা থেকে খুলনায় এলাম। সেখানেও একই অবস্থা। মিটিং-মিছিল, গুম-খুন, পুলিশি হামলা, মিলিটারি নির্যাতন মিলিয়ে অশান্ত পরিবেশ। ২৫ মার্চের কালরাত বর্বর পাকবাহিনী সশস্ত্র হামলা করল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। হাজার হাজার সিপাই নিহতের খবর মুখে মুখে প্রচারিত হলো। ঢাকার ইতিহাসে বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরপরই খুলনার শহরের বুকে সংঘটিত হলো আরেক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস।
রাত আনুমানিক ১১টা। খুলনার সাউথ মেট্রাল রোডের বাসিন্দা মহাদেব চক্রবর্তী, আমার সহপাঠী বিমলের বাবা ও এক ভাইসহ আরো কয়েকজনকে রাতে কারফিউর মধ্যে ধরে নিয়ে গেল দেখলাম। রাত ১২টায় হাজী মহসিন রোডের চৌরাস্তায় গুলি করে ওদের মেরে রাস্তায় ফেলে রাখল। রাতে কারফিউর মধ্যে কেউ বের হতে সাহস করল না। সকালে কারফিউর বিরতির সঙ্গে সঙ্গে লোকজন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করল। হাজার হাজার বাসিন্দা দেখতে এসে ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে টাউন ছেড়ে গ্রাম অভিমুখে যেতে শুরু করল।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে আমিও টাউনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে স্ত্রী, ছেলে এবং সদ্যজাত মেয়েকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। বহু কষ্টে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম। পরদিন সকালে সম্ভবত ২৯ মার্চ তালায় গেলাম। ওই দিন সর্বদলীয় নেতাদের নিয়ে মিটিংয়ে যোগ দিলাম। মিটিংয়ে দেশের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হলো। মিটিংয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি করা হলো। সর্বসম্মতিতে সেদিন আমাকেই এই সংগ্রাম কমিটির অধিনায়ক করা হলো। হাজার হাজার জনগণের সামনে বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস তুলে ধরে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে সদ্য নির্মিত বাংলাদেশের ম্যাপখচিত পতাকা ডাকবাংলোতে উড়ানো হলো। আমি ও সহ-অধিনায়ক প্রদীপ মজুমদার অন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এই পতাকা তুলে ধরলাম। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই নিভৃত পল্লীতেও শুরু হলো স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের সূচনা।
এই যুদ্ধের পথ ধরে দীর্ঘ নয়টি মাস কী দুরূহ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষ কীভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে, তার ইতিহাস যেমন বীরত্বব্যঞ্জক তেমনি মর্মান্তিক। এই যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন আমার ছোট সহোদর শহীদ কামেল বখত এবং বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনার শহীদ বেদার বখত, সহযোদ্ধা শংকর, আজীজ, সুশীল, বক্কর, আবুলসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা। গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করেছে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। অবশেষে জয়ী হয়েছে মুক্তিকামী মানুষ। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জয়ী অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা স্মরণীয়-বরণীয়। তোমরা আমাদের সব কাজের অনুপ্রেরণা, তোমরা যুগ যুগ জিয়ো। জয়গানে মুখরিত হোক মুক্তিকামী মানুষ।
সৈয়দ দিদার বখত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।