বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন? রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক অবদানের জন্য কি তিনি দেশে-বিদেশে নন্দিত হয়েছেন? কিংবা মৌলিক কোনো তত্ত্ব দিতে না পারলেও এ যাবৎকালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নানা তত্ত্বের সংশ্লেষণ ঘটিয়ে এ বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকটিকে সমৃদ্ধ করেছেন?
সব প্রশ্নের উত্তর হবে- 'না'। অথচ শেখ মুজিবুর রহমান নামের মানুষটি আবাল্য রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়েই ভাবনাচিন্তা করেছেন। শুধু অলস ভাবনাচিন্তা নয়; প্রচণ্ড সক্রিয়তা নিয়ে নিজের সমগ্র সত্তাকে দেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। সেই রাজনীতি তাকে নিয়ে গেছে ত্যাগের পথে, দুঃখ বরণের পথে। দুঃখ তাকে বিচলিত করতে পারেনি। দেশের দুঃখ বরণের ব্রত তার নিজের দুঃখকে তুচ্ছ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক সংগ্রাম করেই তার দেশকে তিনি স্বাধীনতার উপল উপকূলে পেঁৗছিয়ে দিয়েছেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হয়েছেন এবং সেই স্বাধীন রাষ্ট্রকে আধুনিক ও প্রগতিশীল করে তোলার নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। সে নীতিমালাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতেই আত্মবিসর্জন দিয়েছেন।
এই যে একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রটির জন্য নীতিমালা ও তার প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ; এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল তার যে রাষ্ট্রচিন্তা, তার উৎস কী?
এক কথায় এর দ্ব্যর্থহীন জবাব- 'স্বদেশপ্রেম'। মুজিবের ছিল খাঁটি, নির্ভেজাল, নিরঙ্কুশ ও আপসহীন স্বদেশপ্রেম। সেই স্বদেশপ্রেম থেকেই তার রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। বইয়ের পাতা থেকে তিনি রাষ্ট্রচিন্তা আহরণ করতে যাননি, কিংবা একান্ত মৌলিক বা অভিনব কোনো রাষ্ট্রচিন্তা দিয়ে পৃথিবীকে হতচকিয়ে দিতেও চাননি।
"মুজিব মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলে ভান করেন না। তিনি একজন রাজনীতির কবি; প্রকৌশলী নন। শিল্পকৌশলের প্রতি উৎসাহের পরিবর্তে শিল্পকলার প্রতি ঝোঁক বাঙালিদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কাজেই সব শ্রেণি ও আদর্শের অনুসারীদের একতাবদ্ধ করার জন্য তার 'স্টাইল' (পদ্ধতি) সবচেয়ে বেশি উপযোগী ছিল।" (Mujib does not pretend to be an original thinker. He is a poet of politics; not an engineer, but the Bengalis temd to be more artistic than technical, any how, and so this style may be just what was needed to unite all the classes and ideologies of the region)- ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে News Week পত্রিকায় সংবাদ ভাষ্যকারের এই মন্তব্য মুজিবের রাষ্ট্রচিন্তার স্বরূপটিকে সঠিকভাবেই অনাবৃত করেছে, বলা যেতে পারে।
স্বদেশপ্রেম একটি মহৎ আবেগের নাম। আবেগহীন মানুষ স্বদেশপ্রেমিক হতে পারে না। শেখ মুজিবের সেই আবেগ প্রচুর ও প্রবলই ছিল। কিন্তু আবেগের তোড়ে ভেসে গিয়ে শুধু স্বদেশপ্রেম কেন; কোনো প্রেমেরই সফল ও কাঙ্ক্ষিত পরিণতি দেওয়া যায় না। আবেগের ওপর কাণ্ডজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ চাই। শেখ মুজিবের ছিল সেই সবল কাণ্ডজ্ঞান। কাণ্ডজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত স্বদেশপ্রেমই মুজিবের রাষ্ট্রচিন্তাকে ধাপে ধাপে পরিপকস্ফ করে তুলেছে; তাকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছে।
স্বদেশপ্রেমের আবেগেই তিনি প্রথম যৌবনে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই তার সবল কাণ্ডজ্ঞানের বলে পাকিস্তানের প্রতারণাটি তিনি ধরে ফেলতে পেরেছিলেন। স্বদেশপ্রেম মানে তো স্বদেশের মাটি, মানুষ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য- সবকিছুর প্রতিই প্রেম। সেসবের প্রতি সংগ্রাম ও তনি্নষ্ঠ দৃষ্টিপাতেই তিনি উপলব্ধি করে ফেললেন যে, পাকিস্তানের মতো একটি অদ্ভুত ও কৃত্রিম রাষ্ট্রের থাবা থেকে মুক্ত করতে না পারলে তার স্বদেশের মুক্তিলাভ ঘটবে না। '৪৮ সালে যখন বাঙালির ভাষার ওপর আঘাত এলো, তখন থেকেই বিষয়টি তার চেতনাকে আলোড়িত করতে শুরু করেছিল। হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে বাংলাকে কার্যত উপনিবেশে পরিণত করে ফেলা, '৫৪-এর বিপুল ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্টের প্রতি পাকিস্তানি শাসকচক্রের অগণতান্ত্রিক আচরণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পাকিস্তানি অপপ্রয়াস, '৫৮-এর সামরিক স্বৈরাচারের রাষ্ট্রীয় মঞ্চে অবতরণ- এ সবকিছু দেখেশুনে শেখ মুজিব বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই তার রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্যবিন্দুরূপে নির্ধারিত করে ফেলেছিলেন। তার সেই লক্ষ্যের কথাটি বোধ হয় সর্বপ্রথম স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন '৬১ সালের নভেম্বরে। অবশ্য একটি গোপন বৈঠকে। বৈঠকটি ছিল সে সময়কার গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের নীতি ও কর্মপদ্ধতি স্থির করার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মণি সিংহ ও খোকা রায় এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। কমরেড খোকা রায় সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও রাজবন্দিদের মুক্তিসহ মোট চারটি জনপ্রিয় দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলার অভিমত ব্যক্ত করলে শেখ মুজিব বলেন, 'এসব দাবি-দাওয়া কর্মসূচিতে রাখুন, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দাদা, একটা কথা আমি খোলাখুলি বলতে চাই। আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন- এসব কোনো দাবিই পাঞ্জাবিরা মানবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখা দরকার।'
কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীনতার প্রস্তাব সমর্থন করলেও তাদের মতে তখনও সে রকম দাবি উত্থাপনের সময় হয়নি। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শেখ মুজিব কমিউনিস্টদের বক্তব্যের সারবত্তা মেনে নেন। ভেতরে ভেতরে তিনি সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ারই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারই প্রমাণ পাই ছেষট্টির ছয় দফা ঘোষণায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ও একাত্তরের সেই দুনিয়া কাঁপানো দিনগুলোতে এবং ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়।
বাংলাদেশই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। বাঙালির এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে কেন্দ্র করেই এর স্থপতি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার বহুমুখী উৎসারণ ঘটতে থাকে। ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা, সেই বাঙালির জাতিরাষ্ট্রটির প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাকে শুধু রাষ্ট্রভাষাই করা হলো না; বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘেও বাংলা ভাষাতে ভাষণ দান করলেন। এর ভেতর দিয়ে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার একটি প্রতীকী প্রকাশ ঘটল। বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা দানই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পেঁৗছানোর জন্যই তিনি তার নিজের মতো পথের সন্ধানে ব্রতী হন এবং এ ক্ষেত্রেও তার গভীর স্বদেশপ্রেম ও তীক্ষষ্ট কাণ্ডজ্ঞানই হয় সন্ধানী আলো।
বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৭ মার্চের সেই অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় ভাষণটি শেষ করেছিলেন যে বাক্যটি দিয়ে, সেটি ছিল- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। ৯ মাসে স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়েছিল অবশ্যই। কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম তো এত সহজে শেষ হওয়ার নয়। মুক্তির সংগ্রাম একটি স্থায়ী, দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশরূপেই বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানটি রচিত হয় এবং তাতে সংযোজিত হয় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মৌলনীতি। এই নীতিগুলোর একটিও নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর মৌলিক উদ্ভাবন নয়, তবু এর প্রতিটি সম্পর্কেই ছিল তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত মৌলিক ভাবনা ও প্রয়োগ পদ্ধতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনো বই লেখেননি, এমনকি তার আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়নি। তাই তার রাষ্ট্রচিন্তা তথা জীবনভাবনার স্বরূপ অন্বেষায় বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তার অভিমত, তার সম্পর্কে বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণ, তার নেতৃত্বাধীন বা প্রভাবাধীন সংগঠনগুলোর ঘোষণাপত্র_ এ রকম বিচিত্রবিধ উৎসের শরণাপন্ন হতে হয়। সেই সূত্রেই এখানে, 'মুজিববাদ'-এর লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের সাক্ষ্য থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে মোটা দাগের কিছু ধারণা পেতে পারি।
১৯৭২ সালেই খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের 'কতিপয় প্রশ্নের জবাবে' নিজের চিন্তা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-
'ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার ওপর গড়ে উঠেছে। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শোষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শোষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের সোনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শোষণে শোষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোনো কোনো সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন শ্রেণিসংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এদেশের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।
আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগোস্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র। আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র_ এই চারটি মূল সূত্র ধরে; বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।'
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে বেশ কিছুদিন বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা এ রকমই ছিল। কিন্তু অচিরেই তিনি তার চিন্তায় মূলগত পরিবর্তন না ঘটিয়েই এর কিছুটা পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য হলেন। দেশের অভ্যন্তরের চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা ও সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রই বঙ্গবন্ধুকে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের অভিসন্ধি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি এ সময়ে আরও গভীরভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। পৃথিবীটি যে শোষক ও শোষিত এই দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেছে- এ বিষয়টি স্পষ্ট উপলব্ধি করেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন- 'আমি শোষিতের পক্ষে।' এই উপলব্ধিজাত ঘোষণাকে নিজের দেশের বাস্তবে রূপায়িত করে তোলার জন্যই তিনি পূর্বঘোষিত 'সংসদীয় বিধিবিধান'-এর 'গণতান্ত্রিক পন্থা' অন্তত সাময়িকভাবে হলেও পরিহার করেন। অবশ্য '৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও ব্রিটিশ ধাঁচের সংসদীয় বিধি-বিধানের গোঁড়া অনুসৃতি ছিল না। সেটিতেও গণতন্ত্রকে কণ্টকমুক্ত করা ও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অধিকার খর্ব করা হয়েছিল; পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ভাবধারার পুনরুত্থানকে রোখার জন্যই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি, বরং সাংবিধানিক নিষেধবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েই পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্মমূলে আঘাত হেনে যাচ্ছিল এবং এ কাজে বিভ্রান্ত বামদেরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা পেয়ে গিয়েছিল। এ রকম অবাঞ্ছিত বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের প্রয়োগরীতিতে এক নতুন মাত্রার সংযোজন ঘটালেন এবং তার নাম দিলেন 'শোষিতের গণতন্ত্র'। এ ব্যবস্থায় সংসদীয় ও মন্ত্রিসভা-শাসিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্থলে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার এলো। বহুদলের বদলে একদলীয় পদ্ধতি প্রবর্তিত হলো। এবং এ রকম আরও বিধিবিধান জারি করা হলো, যেগুলোর সঙ্গে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের এতদিনকার অভ্যস্ত ধারণা খাপ খায় না। তবে ষাটের দশক থেকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্রনায়কদের নেতৃত্বে প্রায় অনুরূপ শাসন ও রাষ্ট্রনীতি চালু হয়ে গিয়েছিল। এর প্রতি দৃঢ় ও সক্রিয় সমর্থন ছিল সে সময়কার সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের। এ ধরনের শাসন প্রণালির নাম দেওয়া হয়েছিল 'জাতীয় গণতন্ত্র', অর্থনৈতিক বিচারে একে বলা হতো 'অপুঁজিবাদী বিকাশের পথ'। অর্থাৎ ধনতন্ত্রকে এড়িয়ে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পদ্ধতি।
জাতীয় গণতন্ত্র ও অপুঁজিবাদী বিকাশের তত্ত্ব-প্রচারকরূপে উলিয়ানভস্কি তখন বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। উলিয়ানভস্কি প্রচারিত তত্ত্ব কিংবা মিসর, তাঞ্জানিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশের শাসন প্রণালির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর 'শোষিতের গণতন্ত্র' ও 'দ্বিতীয় বিপ্লব'-এর কর্মসূচির কিছু সাযুজ্য থাকলেও, মর্মবস্তু ও বহিরঙ্গ উভয় দিক থেকেই এর প্রকৃতি অনেক পরিমাণে স্পষ্ট স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।
'জাতীয় গণতন্ত্র' নামে পরিচিত অনেক রাষ্ট্রের মতো বঙ্গবন্ধুও সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় শাসনের বিধান সংযোজিত করেছিলেন বটে, কিন্তু তার নিজেরই এতে পুরোপুরি সায় ছিল বলে মনে হয় না। শামসুজ্জামান খান ১৯৭৫ সালের জুন মাসে 'বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ'-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছেন, সে সময়ে তার ও প্রফেসর কবীর চৌধুরীর কাছে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-
'...ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস, সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করলাম, কত জেল খাটলাম আর এখন এক পার্টি করতে যাচ্ছি... আমি এটা চাইনি। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে।... অন্য কোনো পথ খোলা না দেখে আমি স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের নিয়ে সমমনাদের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে বাকশাল গঠন করছি। আমি সমাজতন্ত্রবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো দল বা ব্যক্তিকে বাকশালে নেব না। ...আমার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নয়, দেশকে বাঁচানোর জন্য এই পদক্ষেপ। আমি ক্ষমতা অনেক পেয়েছি, এমন আর কেউ পায় নাই। সে ক্ষমতা হলো জনগণের ভালোবাসা ও নজিরবিহীন সমর্থন।... আমার এই একদলীয় ব্যবস্থা হবে সাময়িক। দেশটাকে প্রতিবিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করে আমি আবার গণতন্ত্রে ফিরে যাব। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাব। তবে চেষ্টা করব আমার গণতন্ত্র যেন শোষকের গণতন্ত্র না হয়। আমার দুঃখী মানুষ যেন গণতন্ত্রের স্বাদ পায়।'
বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যিই আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেতেন কি-না, তা নিয়ে অলস জল্পনা-কল্পনা করা আজ একেবারেই অর্থহীন। তবে সন্দেহ নেই, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে তিনি সমগ্র জনগণের জন্য গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছিলেন। বিচার ব্যবস্থার এমন সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে জনগণ অতি সহজে দ্রুত ন্যায়বিচার পেতে পারে। তার নিজের ভাষায়- 'ইডেন বিল্ডিং বা গণভবনের মধ্যে আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইনে। আমি আস্তে আস্তে গ্রামে ইউনিয়নে থানায় জিলা পর্যায়ে এটা পেঁৗছে দিতে চাই, যাতে জনগণ তাদের সুবিধা পায়।'
'শোষিতের গণতন্ত্র' বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর চার দফা কর্মসূচির দিকে তাকালেই তার রাষ্ট্রচিন্তার মর্মকথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেগুলো হচ্ছে-
১. বাধ্যতামূলক বহুমুখী গ্রাম সমবায় গঠন।
২. মধ্যস্বত্বভোগী গ্রামীণ জোতদার, মহাজন, ধনিক-বণিক শ্রেণির উচ্ছেদ।
৩. উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন শক্তির বিকাশ সাধন।
৪. আমলাতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের ব্যাপক গণতন্ত্রায়ন।
সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন 'বহুমুখী সমবায়'-এর ওপর। '৭৫-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ওই সমবায় বা কো-অপারেটিভ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-
'পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রাম কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু যে বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদেরকে বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে।'
বঙ্গবন্ধু যে সমবায়ের ভাবনা ভেবেছিলেন, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা তথা সমাজের কাঠামোর আমূল রূপান্তরই ছিল তার লক্ষ্য। ধনতন্ত্রের তাত্তি্বকদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও প্রচারিত সমবায় ব্যবস্থার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিকল্পিত সমবায়ের কোনো মিল ছিল না। বরং বলা যেতে পারে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনারই তিনি উত্তরাধিকার বহন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলতেন- 'একমাত্র সমবায় প্রণালীর দ্বারাই গ্রাম আপন সর্বাঙ্গীণ শক্তিকে নিমজ্জন দশা থেকে উদ্ধার করতে পারবে, এই আমার বিশ্বাস।' কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, 'আক্ষেপের বিষয় এই যে, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সমবায়-প্রণালী কেবল টাকা ধার দেওয়ার মধ্যেই ম্লান হয়ে আছে, মহাজনী গ্রাম্যতাকেই কিঞ্চিৎ শোধিত আকারে বহন করছে, সম্মিলিত চেষ্টায় জীবিকা উৎপাদন ও ভোগের কাজে সে লাগল না।
তার প্রধান কারণ, যে শাসনতন্ত্রকে আশ্রয় করে আমলাবাহিনী সমবায়নীতি আমাদের দেশে আবির্ভূত হলো সে যন্ত্র, অন্ধ, বধির, উদাসীন।'
বঙ্গবন্ধুর সমবায়-নীতি রবীন্দ্রনাথ কথিত এ রকম 'আমলাবাহিনী সমবায় নীতি' থেকে স্বতন্ত্র, তার সমবায় নীতি ছিল সমাজতন্ত্রমুখী তথা শোষণমুক্তির পথগামী। এ ব্যাপারে শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়; নজরুলের রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজ বিপ্লবী ভাবনারও তিনি অনুসারী। 'শ্রমিক প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায়' নামক একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যরূপে নজরুল যে ইশতেহারটি রচনা করেছিলেন, তাতে ছিল-
'আধুনিক কলকারখানা, খনি, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, ট্রামওয়ে, স্টিমার প্রভৃতি সাধারণের হিতকরী জিনিস, লাভের জন্য ব্যবহৃত না হইয়া, দেশের উপকারের জন্য ব্যবহৃত হইবে এবং এতদ্সংক্রান্ত কর্মীগণের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সম্পত্তিরূপে পরিচালিত হইবে।
ভূমির স্বত্ব আত্ম-অভাব-পূরণক্ষম স্বায়ত্তশাসন বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের ওপর বর্তিবে- এই পল্লীতন্ত্র ভদ্র-শূদ্র সকল শ্রেণির শ্রমজীবীর হাতে থাকিবে।'
নজরুল-কাঙ্ক্ষিত এই 'স্বায়ত্তশাসন বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রে'র মর্মবাণীই ধারণ করেছিল বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্রের কর্মসূচি।
নজরুল নন শুধু; গ্রামবাংলার চারণ কবি মুকুন্দ দাসও স্বায়ত্তশাসন বিশিষ্ট পল্লীতন্ত্রের একটি পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। তার পরিকল্পনাটি ছিল এ রকম :
'প্রতি পাঁচখানা গ্রাম লইয়া হইবে এক একটি মৌজা; প্রতি মৌজায় থাকিবে আমানতী ব্যাংক- এবং ব্যাংকের সাহায্যে ও মাধ্যমে এই পাঁচখানি গ্রামে চলিবে যৌথভাবে চাষ, কারবার ও কুটিরশিল্প।'
চারণ কবির এই স্বপ্ন কি বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যেও সংক্রমিত হয়নি?
কেবল মুকুন্দ দাসের মতো চারণ কবির কথাই বা বলি কেন? আবহমান বাংলার লোকমানসেই তো বিদ্বেষ-বৈষম্য-মুক্ত শোষণহীন এক সমাজের স্বপ্ন-কল্পনা ও পরিকল্পনা জড়িত-মিশ্রিত হয়ে আছে। স্মরণ করতে পারি লালন ফকিরের সেই আর্তির কথা-
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু-মুসলমান
বৌদ্ধ-খ্রিস্টান
জাতিগোত্র নাহি রবে।
শোনায়ে লোভের বুলি
নেবে না কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ বলি
দূরে ঠেলে না দেবে।
আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই
সবার পাওনা খাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
ভবে কেউ নাহি পাবে।
আমাদের জনগণের মধ্যে ব্যাপ্ত এ রকম লৌকিক আর্তিই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রচিন্তার অমোঘ অবিচ্ছেদ্য অপরিহার্য উপাদান। কারণ তিনি যে আমাদেরই লোক।