বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : পোয়েট অব পলিটিক্স


** এম আর মাহবুব **

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্ম : ১৭ মার্চ, ১৯২০ মৃত্যু : ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বেঁচেছিলেন মাত্র পঞ্চান্ন বছর। বাল্যকাল ও কৈশোর থেকেই সংগ্রাম শুরু। তার সারাটি জীবন ত্যাগ ও সাধনার জীবন। তিলে তিলে নিজেকে উৎসর্গ করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সঙ্গত কারণেই বলা হয়, বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই একজন সচেতন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দেশ ও জাতির কাছে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘ সময়ের একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের ফসল। হাজার বছরের সেই সংগ্রামের কাক্সিক্ষত অর্জন আমাদের মহান স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু হলেন সেই মহামানব যার সফল নেতৃত্বে হাজার বছরের সংগ্রাম সার্থকতা লাভ করেছে। সে কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির ইতিহাস, হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস হলেও বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বীজ লুকিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে।

আজন্ম মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই এ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ছিল অন্যতম দাবি। ১১ মার্চের ঐতিহাসিক ধর্মঘটে তিনি পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার।’ ১১ মার্চের হরতাল ও গ্রেপ্তার সূচক শেখ মুজিবের জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে।

১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ জেল থেকে তিনি মুক্ত হন। ১৬ মার্চ তারই সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে কারাবন্দি শেখ মুজিব সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও জেলে অনশনরত অবস্থায় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ ও নির্দেশনা দিতেন। বাহান্ন-পরবর্তীকাল থেকে আমৃত্যু তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৮ সালে সাময়িক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এক কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাস।

বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক এ সংগ্রামে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। অবর্ণনীয় ত্যাগ ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে ১৮ বার জেলে গেছেন, মোট সাড়ে ১১ বছর কারাবন্দি ছিলেন। তবু স্বাধীনতার প্রশ্নে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তার দৃপ্ত উচ্চরণ : ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে আলোচ্য গ্রন্থটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মোট ৫১ জন চিন্তাবিদের মননশীল লেখা নিয়ে গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন শ্যামল দত্ত এবং সালেক নাছির উদ্দিন। শ্যামল দত্ত দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং সালেক নাছির উদ্দিন দৈনিক ভোরের কাগজে সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত। বঙ্গবন্ধু জীবনের নানাদিক নিয়ে এমন একটি চমৎকার কর্মযজ্ঞের জন্য ধন্যবাদ তাদের প্রাপ্য। এ গ্রন্থে সংকলিত অধিকাংশ লেখাই দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়াও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা বিভিন্ন বই থেকে নেয়া হয়েছে এবং সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গ্রন্থনা করা হয়েছে। ৫১টি লেখায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। সার্বিক বিচারে বঙ্গবন্ধুকে জানা ও বুঝার জন্য এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ বললে অত্যুক্তি হবে না। বইটিতে লেখকের নাম এবং লেখার শিরোনাম সূচিবদ্ধ হয়েছে এভাবে : মো. আবদুল হামিদ : আমার বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা : শেখ মুজিব আমার পিতা, প্রণব মুখোপাধ্যায় : বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, আনিসুজ্জামান : বঙ্গবন্ধুকে অবলোকন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : পোয়েট অব পলিটিক্স, ড. কামাল হোসেন : মানুষকে আপন করার জাদুকর, ফারুক চৌধুরী : পররাষ্ট্র সম্পর্কের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু, তোয়াব খান : মহানায়ক বঙ্গবন্ধু, এনায়েতউল্লাহ খান : বুলেটের মুখে বুক পেতে দিয়েছিলেন যিনি, রেহমান সোবহান : বঙ্গবন্ধু আমাকেও ডেকেছিলেন, শামসুল হুদা : স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুজ্জামান খান : লেখক বঙ্গবন্ধু, রফিকুন নবী : চারুকলায় প্রায়ই আসতেন তিনি, শেখ রেহানা : শোকাহত হৃদয়ের ভাব, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : বাঙালির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু, তোফায়েল আহমেদ : বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ, আমিনুল হক বাদশা : মানবপ্রেমই ছিল বঙ্গবন্ধুর চরম দুর্বলতা, নূরে আলম সিদ্দিকী : শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ, সুবিদ আলী ভূইয়া : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, ডা. এস এ মালেক : বঙ্গবন্ধু হত্যার রহস্য, হাসনাত আবদুল হাই : সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, রাশেদ খান মেনন : রাজনীতি হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য, সেলিনা হোসেন : দাবায়া রাখতে পারবা না, ড. আতিউর রহমান : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থ, অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ : বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, শাহরিয়ার কবির : বঙ্গবন্ধুর দর্শন, হারুন হাবীব : বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্র উপলব্ধি, অনুপম হায়াৎ : প্রিয় শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র বঙ্গবন্ধু, ড. এ কে আবদুল মোমেন : জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু, ড. এ কে আজাদ চৌধুরী : আপসহীন সংগ্রামী জননেতা, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষকদের জবাবদিহিতা, আবদুল মান্নান : বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের অজানা কাহিনী, ড. মীজানুর রহমান : বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ, ড. শরীফ এনামুল কবির : কিশোর মুজিবের মানবপ্রেম, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া : শোক নয়, শপথ নেওয়ার সময়, মোহীত উল আলম : বঙ্গবন্ধু : একটি পুনর্মূল্যায়ন, বিভুরঞ্জন সরকার : স্মৃতিতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা : বঙ্গবন্ধু এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : বঙ্গবন্ধুর জনগণ ও জনগণের বঙ্গবন্ধু, কাইয়ুম নিজামী : বঙ্গবন্ধু এবং তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, শেখর দত্ত : বঙ্গবন্ধু : স্মৃতিতে-স্মরণে, ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন : ইসলাম, অপপ্রচার ও বঙ্গবন্ধু, আনিসুল হক : বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি চিঠি, এম. আর. মাহবুব : রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, চৌধুরী মনজুর লিয়াকত : তিনিই জয়ী, মাহবুবুল আলম : বঙ্গবন্ধুর মানবিক গুণাবলি, মিজানুর রহমান খান : অহিংস বঙ্গবন্ধু, মোহাম্মদ শাহজাহান : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, সৈয়দ বোরহান কবীর : বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শন, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : ভাষণ থেকে রোজনামচা, ড. মিল্টন বিশ্বাস : সাহিত্যের পরিসরে বঙ্গবন্ধু।

লেখার শিরোনামগুলো লক্ষ করলে স্পষ্টই বুঝা যায় বইটিতে বঙ্গবন্ধুকে নানা মাত্রায়, নানাদিক থেকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হৃদয়গ্রাহী লেখা ছাড়াও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আজো আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হই, বাঙালি হিসেবে তাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আসলে নিজের জাতিসত্তা সম্পর্কে গর্ববোধ না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। সেটিই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে আমার প্রথম শিক্ষা।’ তিনি আরো বলেন, “…আজ বাংলাদেশ ফের মুজিব আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে। আমি বলি ‘মুজিবিজয়’। সেটিই তার দর্শন; বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।”

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শিরোনামের লেখাটিতে বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরকালের অজানা স্মৃতি ফুটে উঠেছে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধুকে অবলোকন’ নামের একটি প্রবন্ধ। এতে তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা লাভে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ প্রবন্ধটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি আলোচ্য প্রবন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করে যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শেখ মুজিব তিনজনই ছিলেন বাঙালি। কিন্তু দেশ ও কালের গণ্ডি অতিক্রম করে তারা হয়েছেন বিশ্বমানব। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, নজরুল বিদ্রোহী কবি এবং শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু।’

ড. কামাল হোসেনের ‘মানুষকে আপন করার জাদুকর’ শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। একটি স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ফারুক চৌধুরীর ‘পররাষ্ট্র সম্পর্কের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক লেখায়। বিশিষ্ট সাংবাদিক তোয়াব খান, এনায়েতউল্লাহ খান, শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক রেহমান সোবহানের লেখাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যনির্ভর।

শামসুজ্জামান খান, রফিকুন নবী, সেলিনা হোসেন, ড. মিল্টন বিশ্বাস, মহাকবি কাইয়ুম নিজামী ও আনিসুল হক লিখিত প্রবন্ধসমগ্রে বঙ্গবন্ধুর লেখালেখি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রীতি এবং মানবতাবোধ ফুটে উঠেছে সাবলীল ও নান্দনিকতার ভঙ্গিতে।

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ‘শোকাহত হৃদয়ের ভাব’ নামক লেখাটিতে ১৫ আগস্টের শোকাবহ স্মৃতি, পিতা হারানো এক কন্যার করুণ আকুতি, পিতার স্নেহস্পর্শ ছাড়াও বাংলার মানুষের ভাগোন্নয়নে সংগ্রামী পথচলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। সর্বহারা, ত্যাগী অথচ প্রত্যয়ী ও সংগ্রামী নারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার সাহসী উচ্চারণ : ‘পিতার আদর্শের অনুসারী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে গর্ববোধ করেছি।’

‘বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিতভাবেই এক ও অভিন্ন’ এমন সত্য উচ্চারণে পিছপা হননি ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন। ‘বাঙালির আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি আরো উল্লেখ করেন : ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনীতি কীভাবে কেমন করে এবং কোন অগ্রাধিকারে গ্রথিত হয়েছিল তা স্মরণ করা যেতে পারে। রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেখড়ি তার শৈশবে মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়া গিমাডাঙা নদীর কিনারে গ্রামবাংলার মাঠে-ময়দানে। দুটো জিনিস তার মন-মানসিকতায় অর্থনীতি সম্পর্কে রেখাপাত করে। প্রথমত, তিনি দেখেছিলেন দারিদ্র্যের কদর্য কশাঘাতে মানুষ কীভাবে দুর্দশার চরম শিখরে পৌঁছে সর্বস্বান্ত হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি উপলব্ধি করেন যে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুন পরম মমতায় গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়াতেন, অন্ন-বস্ত্রের সাহায্যের হাত প্রসারিত করতেন। তাই তো বস্ত্রহীন পথচারীকে গায়ের জামা খুলে দিয়ে এলেও এবং পিতার অনুপস্থিতিতে পারিবারিক গোলা থেকে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত গরিব-দুঃখীকে ধান বিতরণ করে শেখ মুজিবকে পিতার সস্নেহ অনুমোদন পেতে কষ্ট হয়নি।’

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থাকা একজন সৌভাগ্য পুরুষ তোফায়েল আহমেদ। ‘বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে তিনি নানা স্মৃতিকথাসহ বঙ্গবন্ধুর চেতনায় আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কথা লিখেছেন। আমিনুল হক বাদশার ‘মানবপ্রেমই ছিল বঙ্গবন্ধুর চরম দুর্বলতা’ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু দয়া, ক্ষমাশীলতা ও মানবপ্রেমের এক অনন্য কাহিনী বিধৃত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর আরেক ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস ও কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ড ১৫ আগস্টের শোকগাথা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন- ‘শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ’ প্রবন্ধটি। ড. আতিউর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থ’ এই রচনাটি থেকে আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধু কতটা কৃষকবান্ধব ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করে।’ ভাষাসৈনিক শামসুল হুদার ‘স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এবং এম আর মাহবুবের ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’ প্রবন্ধ দুটিতে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যথাযথ ভূমিকা তথ্যসহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধির কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক লিখিত ‘শিক্ষকদের জবাবদিহিতা’ এবং অনুপম হায়াৎ লিখিত ‘প্রিয় শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘শিক্ষকদের জবাবদিহিতা থাকবে বিবেকের কাছে।’ এই তথ্যটি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের প্রবন্ধ থেকেই জানা যায়। অনুপম হায়াৎ বলেছেন, ‘নিজের শিক্ষক ছাড়াও বঙ্গবন্ধু সমগ্র শিক্ষক সম্প্রদায়কে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।’

‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে সুবিদ আলী ভূইয়া বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- এ দুটি শব্দ একে অপরের পরিপূরক, যা আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জনগণের প্রতি ভালোবাসা আর একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।’

‘বঙ্গবন্ধু হত্যার রহস্য’ প্রবন্ধে ডা. এস এ মালেক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বড় অপরাধ কেন তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন। তারচেয়ে বড় অপরাধ কেন তিনি সার্বিক মুক্তির কর্মসূচির ঘোষণা এবং কেন তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পট সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গঠন করার উদ্যোগ নিলেন।’

‘জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু’ প্রবন্ধে ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন এবং সেই ভাষণে তিনি প্রায় ৫০টি ইস্যু তুলে ধরেন, যা এখনো মানব জাতিকে নাড়া দেয় এবং সেইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন, যা এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু একবার মাত্র জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তিনি তার ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে নীলনকশা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন তা আজো আমাদের আলোর দিশারি। মানবজাতির কঠিন সমস্যাগুলো যা তিনি তার ভাষণে তুলে ধরেন সেগুলো আজো বিশ্ববাসীর জীবনকে করে তুলেছে সংকটময় ও বিপদসংকুল। বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে ভাষণ তাই এক অনন্য ভাষণের ব্যাপ্তি, এর অ্যাপিল, এর আহ্বান আজো অবাক হওয়ার।

আলোচ্য গ্রন্থে সংকলিত অন্য লেখকদের প্রবন্ধেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের বুদ্ধিদীপ্ত মূল্যায়ন ও মন্তব্য স্থান পেয়েছে। বইটি আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ কিছু ছবির কারণে। বইয়ের অধিকাংশ পাতায়ই ছবি ছাপানো হয়েছে। রাজনীতি, সংগ্রাম, পারিবারিক ছবি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর একক ছবিগুলো দেখলে যে কারো ভালো লাগবে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ছবিগুলো নিশ্চিতভাবে বইটির ঐতিহাসিক মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০৮ পৃষ্ঠার অ্যালবাম আকারের বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা প্রকাশ। প্রকাশকাল মার্চ, ২০১৮ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো’- এই ¯েøাগান সংবলিত বঙ্গবন্ধুর মুখের প্রতিকৃতি নিয়ে চমৎকার প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রæব এষ। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৮০০ টাকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এমন একটি অনবদ্য ও অসাধারণ কাজ করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাই সম্পাদকদ্বয় শ্যামল দত্ত ও সালেক নাছির উদ্দিনকে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

SUMMARY

1641-1.png