বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার দ্রষ্টা ও স্রষ্টাই নন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কই নন, জাতির জনকই নন, দেশপ্রেম, মানবতা বোধ, অসাম্প্রদায়িকতা বোধ, রাজনৈতিক দর্শন, দূরদর্শিতা, জাতীয়তা বোধ, মহানুভবতা এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন বিবেচনায় ও বাঙালির সার্বিক মুক্তির দূত হিসেবে রাজনীতির ইতিহাসে বিরল ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর কিংবদন্তির এক প্রবাদ পুরুষ। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম-মানবপ্রেমের বিশেষ স্মারক হচ্ছে তাঁর আত্নজীবনীতে লেখা নিম্নোক্ত অনুভূতি— “একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসাবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উত্স ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে”।
মানবতাবাদী বঙ্গবন্ধুর নিম্নোক্ত উপলব্ধিও তাকে মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তিনি বলেছিলেন— “বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে”।
কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধু মানুষের প্রতি শুধু সহানুভূতিশীলই ছিলেন না, উদার ও অসাম্প্রদায়িকও ছিলেন। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাড়ি লুট ও তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তত্কালীন দাঙ্গাকারী গ্রুপগুলোর অন্যতম দাঙ্গাবাজ শাহ আজিজুর রহমান (সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী) তার দলবল নিয়ে যখন ডাঃ রায়ের বাড়িটি ঘিরে ফেলে তখন তার ডাকে কোলকাতার পুলিশ সেখানে পৌছবার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে পৌছে যান এবং দাঙ্গাবাজদের প্রতিহত করে বাড়িটি রক্ষা করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন-দূরদর্শিতা, গান্ধীবাদ-জিন্নাহবাদ-মাওবাদ-লেলিনবাদ-মার্কসবাদের তুলনায় অতুলনীয়। তারই কথায় দেখুন তার দর্শন-দূরদর্শিতা- “এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতী মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। এ দেশে যুগযুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতী মানুষ। আমার কোন কোন সহযোগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধু-বান্ধব বলেন শ্রেণি সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়, গণতান্ত্রিক পন্থায় ও সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আমি মনে করি বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মূল সূত্র ধরে বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে। আমি চাই শোষনমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন “সোনার বাঙলা” নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার সর্বোত্তম দুই উদাহরণের প্রথমটি হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের লক্ষ্যে তার ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি— যা ইতিহাসে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত। উক্ত সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতবিরোধ দেখা দেয়। মাওলানা ভাসানী দাবি তোলেন, “ভোটের আগে ভাত চাই”। বঙ্গবন্ধু বলেন- “ভোট পেলে ভাতের জন্য কারো কাছে করুণা ভিক্ষা করতে হবে না। বাঙালিরাই ভাতের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে”। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন তা ছিলো সঠিক এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল আর সেই জয়ের কারণেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পেরেছিলেন এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে স্বাধীনতার সে ঘোষণা গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনে ব্যস্ত মাওলানা ভাসানী তখন ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেখানে বিভিন্ন লেখা প্রকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব সৃষ্টি করা হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৭৩ সালের ১৫ মে ৩ দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন তিনি। কিন্তু মহানুভব বঙ্গবন্ধু অনশন ভাঙাতে তার কাছে ছুটে যান। আবার বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি নানা অসত্য অভিযোগও তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে, সরকারবিরোধী তত্পরতায় নানাভাবে উত্সাহ জোগাচ্ছেন এমন রিপোর্ট জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুর কাছে তুলে ধরে ভাসানীর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমতি চাইলে বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিগত সচিব রফিক সাহেবকে বলেন, “জাফলং থেকে এক ঝুড়ি ভাল কমলা আনো, সন্দেশ আর দই নিয়ে গিয়ে তাকে আমার সালাম পৌঁছাও। কমলা খেতে উনি খুব পছন্দ করেন”। বঙ্গবন্ধুর এমন মহানুভবতা-শ্রদ্ধাবোধ-ভালোবাসার বিপরীতে মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে হত্যা করার পর একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
বাংলার ইতিহাসে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর রাজনীতিবিদদের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু অনন্য। বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সৃষ্টির জন্য তিনি তার ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ১৩ বছর ৯ মাস অর্থাত্ প্রায় ১৪ বছর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে (১৯৪১-১৯৭১) জেল খেটেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে অমর রাজনীতিকরা বহু বিশেষণে ভূষিত হয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুই একমাত্র রাজনীতিক যার মতো বিশ্বের আর কোনো রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনায়ক এত এত বিশেষণে ভূষিত হননি। যেমন— বঙ্গবন্ধুকে আমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুকুটহীন সম্রাট, বাংলার রাখাল রাজা, স্বাধীনচেতা নেতা, কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ, ইতিহাসের মহানায়ক, মহান ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুঞ্জয়ী বীর, রাজনীতির মহাকবি, অমর ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের জনক, শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত, বাংলার মুক্তিদূত, স্বাধীনতাকামী বাঙালির মুক্তিদূত, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, বাংলা ও বাঙালি জাতির প্রতীক, শতাব্দীর মহানায়ক, স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, পোয়েট অফ পলিটিক্স, আর্কিটেক্ট অফ দ্যা ন্যাশন, ফাদার অফ দ্যা ন্যাশন ইত্যাদি বহু রকমের বিশেষণে ভূষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বঙ্গবন্ধু গ্রেট।
বিশ্বখ্যাত জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রাপ্তিও বঙ্গবন্ধুকে মহান করেছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর পূর্বে উক্ত পদক কোনো বাঙালি তো পায়ই নি, বরং যারা পেয়েছিলেন তারা সবাই বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো, হো-চি-মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, পাবলো নেরুদা, জওহর লাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং।
একজন মানুষ এমনি এমনিই মহান হন না, বহুবিধ গুণাবলি ধারণ ও প্রকাশ করতে পারেন বলেই তারা মহান-গ্রেট প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হন। উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ, চরিত্রের বহু দিক উন্মোচন করলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন বহুগুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যা তাকে ইতিহাসে অমলিন-কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তথা ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, অমরত্ব প্রদান করেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার থেকে বার বার আত্মজীবনী লেখার অনুরোধ শুনে বলেছিলেন, “লিখতে যে পারিনা, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায় ! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে ? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি”। সেই ১৮ বছর বয়স থেকে যে মানুষটি, দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, দেশের মানুষের ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে একটানা ৩০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যৌবনের সোনালি বছরগুলিই কাটিয়েছেন জেলের অভ্যন্তরে, সেই মানুষ যখন আত্ম মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন কথা বলতে পারেন তিনিই তো গ্রেট ব্যক্তিত্ব।
পৃথিবীর ইতিহাসে একজন মাত্র ব্যক্তির নামের সাথে গ্রেট শব্দটি যুক্ত রয়েছে, তিনি হলেন তত্কালীন ফরাসি সেনাপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। যত্সামান্য ত্যাগ ও বীরত্বের জন্য ফরাসি জাতি যদি তার নামের পাশে গ্রেট যুক্ত করে সম্মানিত করে পৃথিবীর ইতিহাসে গ্রেট ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তাহলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতি-আদর্শ-কীর্তির জন্য যেভাবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছিলেন এবং ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তিনি যে ভাবে প্রমাণ করেছেন সে সব বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু দ্য গ্রেট’ বিশেষণে সম্বোধন করে আরো সন্মানিত করা উচিত। তাহলে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরাও বিশ্ব দরবারে সন্মানিত হবো।