বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও বাংলাদেশের পর্যটন


মো. জিয়াউল হক হাওলাদার
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পরিস্ফুটিত করার জন্য এক মহান আদর্শ এবং বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে এক মহান মূর্ত প্রতীক। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুধু একজন মহাকাব্যিক মহানায়কই নন, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরির ক্ষেত্রেও তার রাজনৈতিক দর্শন এবং রাজনৈতিক জীবন আজ এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়শীল দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের পরিচিতিকে তুলে ধরা ও পর্যটন শিল্পের প্রচার এবং বিপণনে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক পরিচিতি ও ইমেজ এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিশীলা হিসেবে কাজ করতে পারে। 
অনেক পর্যটক বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান অবলোকনের জন্য ইংল্যান্ডের স্ট্রেটফোর্ড উপন এভন ভ্রমণ করেন এবং নেলসন ম্যান্ডেলার বাসভবন এবং রাজনৈতিক স্মৃতি দেখার জন্য সাউথ আফ্রিকায় ভ্রমণে যান। এ মাটির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক এবং অবিসংবাদিত ঐতিহাসিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদেশে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। তার রাজনৈতিক দর্শনের ওপর বিভিন্ন ভাষায় একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচার করা প্রয়োজন। ২০২০ সাল হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিষয়ে এরই মধ্যে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক, সম্পাদক এবং মানবাধিকার কর্মী স্যার ফ্রাঙ্ক পিটার্স বঙ্গবন্ধুর তথ্যচিত্র তৈরি ও প্রচার এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করেছেন। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু ও তার ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র এবং রাজনৈতিক দর্শনকে তথ্যচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন ও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রোগ্রাম গ্রহণের বিষয়ে তিনি পরামর্শ প্রদান করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান, প্রাথমিক জীবন, ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক কর্মজীবন, কারাগারের জীবন এবং তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বক্তৃতাসহ সবই বাংলাদেশের জন্য প্রত্যাশিত পর্যটন আকর্ষণ। বিশ্বব্যাপী এসব বিষয় ব্যাপকভাবে চিত্রিত ও প্রচার করা আমাদের দায়িত্ব। তার ওপর বিভিন্ন প্রকাশনা এবং ভিডিওগ্রাফি বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করা উচিত। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ (ডিএফপি) এ বিষয়ে একযোগে কাজ করতে পারে।
ইউনেস্কো এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণকে একটি ‘ডকুমেন্টারি বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে মনোনীত করেছে। তার বীরত্বপূর্ণ বক্তৃতা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এখনও আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণা। বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এ ভাষণকে ব্যাপকভাবে দেশে এবং বিদেশে প্রচার করা উচিত।
বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কর্মজীবনের তথ্যও পর্যটকদের কাছে অনেক আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারে, কারণ এ ধরনের রাজনৈতিক দর্শন বিশ্বের অন্য কোনো নেতা এখনও তৈরি করতে সক্ষম হননি। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তার জাতীয়তাবাদী ভাষণের কারণে কারাগারে পাঠানো হয়, যা খুব বিরল। বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগের সম্মেলনকালে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ধর্মঘট শুরু করেন। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার জন্য ২০২০-২১ সালকে বঙ্গবন্ধু বর্ষ ঘোষণা করেছেন। বিস্তারিত প্রোগ্রাম এরই মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। 
এ দেশে পর্যটন উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন স্বপ্নদর্শী নেতা। তিনি এদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য তার রাষ্ট্রপতি আদেশ (পিও) নং-১৪৩ বলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) তৈরি করেছিলেন, যা বিপিসির ভবিষ্যতে প্রচার এবং পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য চমৎকার দিকনির্দেশিকা এবং প্রধান লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইধহমষধফবংয রং ধ ড়িহফবৎভঁষ পড়ঁহঃৎু. ডব যধাব ভবৎঃরষব ষধহফ ধহফ রসসবহংব হধঃঁৎধষ ৎবংড়ঁৎপবং. বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তিনি বাংলাদেশকে সুইজারল্যান্ডের মতো করে সাজাতে চেয়েছিলেন। 
এই মহাকাব্যিক চরিত্রকে তুলে ধরে বাংলাদেশের পর্যটনকে যথাযথ রূপে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে কিছু নির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে এবং বিশ্বকে এ মহান কিংবদন্তি সম্পর্কে জানাতে হবে। বিভিন্ন ধরনের বহুভাষিক প্রকাশনা এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর বই, ব্রোশিওর, লিফলেট বিতরণ এবং তার কর্মজীবন সম্পর্কে তথ্য বিতরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ব্যাপক প্রচারের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তৈরি তথ্যচিত্র ইন্টারনেট, ফেইসবুক, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ংড়পরধষ সবফরধ) প্রচার করা একান্ত জরুরি। আইসিটি মন্ত্রণালয়কে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী বড় বড় পর্যটনসমৃদ্ধ দেশগুলোতে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রোডশো এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে এবং বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ঢাকায় একটি স্থাপত্য নিদর্শন স্থাপন করা যেতে পারে। এছাড়া ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আগত বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) তার আবাসন ও রেস্তোরাঁ ব্যবহারের ওপর বিশেষ ছাড়ের অফার দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বিস্তার করা বাংলাদেশের নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। এ উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি করতে এবং বাংলাদেশে আরও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সহায়তা করবে। 

 

SUMMARY

1637-1.png