বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শিশু ভাবনা, পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা


মো: মোজাম্মেল হক :
১৭ মার্চ, ১৯২০ সাল, মঙ্গলবার দিনটি বাঙালি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে অসংখ্য শিশু জন্মগ্রহণ করলেও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় খোকার (বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম) জন্মের কারণে এই দিনটি বাঙালি জাতির কাছে স্মরণীয় দিন। ১৭ মার্চ, মাতা সায়েরা খাতুনের গর্ভে এই শিশুটি যে পরবর্তীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হবে তা শিশুমন থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব ও আদর্শের গুণগুলো প্রামাণ্যস্বরূপ। শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যকালের ভাবনা আমাদের প্রভাবিত করে এবং সেই ভাবনীয়তা পরবর্তী প্রজন্মে প্রভাব পড়বে। বর্তমানে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান, মাতা মোসা. সায়েরা খাতুন, দাদা শেখ আব্দুর রশিদ। তিনি শেখ বংশের ছিলেন। গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষাজীবন শুরু করে। এরপর সীতানাথ একাডেমী, গোপালগঞ্জ; ইসলামীয়া কলেজ (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) কলকাতা; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে পড়াশুনা করেন। লেখাপড়া করার সময় তিনি বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা ডাক নাম রেণু।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ : বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর জীবনের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে মিশন স্কুলে অধ্যায়নরত অবস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে অন্যতম সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ২৩ জুন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকলীন যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধরণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এরপর ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৪ মে, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে কৃষি, বন, সমবায় ও পল্লী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় বার গণপরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়। ঐ বছরে ফেব্রুয়ারী মাসে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন যা “বাঙালির মুক্তির সনদ” বলা হয়। ১৯৬৮ সালে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য” মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করা হয়। ১৯৬৮ সালে, ২২ ফেব্রুয়রী এই মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এ মামলার নাম দিয়েছিলেন “ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা”। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অপারগতা দেখালে বঙ্গবন্ধু অসহযোগী আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৭১ সালে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই জ্বালাময়ী ভাষণ পরবর্তীতে বাঙালি জাতিকে উৎসাহিত করে। ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির উপর নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে কারা অবস্থায় করাচিতে হস্তান্তর করেন। করাচিতে অবস্থানকালে পাকিস্তান সরকার দেশদ্রোহিতার মামলায় মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন এরপরও তিনি তাঁর আদর্শের উপর অটুট ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের, ১০ জানুয়ারী স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট বিপদগামী সেনাসদ্যসের হাতে পরিবারসহ তিনি নিজেও শাহাদাতবরণ করেন।
 
২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে এক বিশাল জনসভায় তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মান সূচক “বঙ্গবন্ধু” খেতাবে ভূষিত করেন। ৩ মার্চ, ১৯৭১ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ গঠিত স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের “জাতির জনক” হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। ৫ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে মার্কিন সাপ্তাহিক “নিউজউইক” ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুর উপর একটি কভার স্টোরি করেন যার নাম ছিল Civil war in Pakistan. প্রতিবেদনটিতে বঙ্গবন্ধুকে “রাজনীতির কবি” (poet of politics) হিসেবে অভিহিত করা হয়। লোরেন জেঙ্কিন্স তাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরী করেন। ২৬ মার্চ ২০০৪ সাল থেকে প্রচারিত বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । ১৪ এপ্রিল ২০০৪ সালে “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি” হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর শিশু ভাবনা: ১৯৩৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন মাদারীপুরে আসলেন তখন প্রতিদিন বিকেলে সভায় যোগ দিতেন। সেই সময় স্বদেশী আন্দোলনের যুগ চলছিল। তখন সবাই আতঙ্কে ছিল। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলন তখন ঘরে ঘরে। ১৫/১৬ বছর বয়সীদের স্বদেশী দলে ভেড়াত। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর মনে বিদ্রুপ ধারণা সৃষ্টি হয়, ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে তিনিও স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিলেন। সভায় যোগদান করতে মাঝে-মাঝে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর যাওয়া আসা করতেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সাথে মেলামেশা করতেন। ১৯৩৭ সালে আবার লেখা-পড়া শুরু করলেন। সেই স্কুলের মাষ্টার আবদুল হামিদের বাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখলেন। মাষ্টার গোপালগঞ্জে একটি “মুসলিম সেবা সমিতি” গঠন করেন। যার দ্বারা গরিব ছেলেদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সকল মুসলমানের বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রবিবার সবাই মিলে থালি নিয়ে বাড়ি-বাড়ি চাল উঠিয়ে আনতেন এবং ঐ চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই ও পরীক্ষার খরচ চলতো। ঘুরে ঘুরে জায়গীরও ঠিক করে দিতেন। শেখ মুজিবুর রহমান অনেক কাজ করতেন তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষ¥া রোগে আক্রান্ত হয়ে আবদুল হামিদ মারা যান। তখন শেখ মুজিবুর রহমান সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করেন। স্কুলে পড়ার সময় শেখ মুজিবুর রহমানের একটি দল ছিল যদি কেউ অন্যায়ভাবে আক্রমণ করতে আসলে তাদের বিরুদ্ধে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

১৯৩৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তাঁরা দুজন গোপালগঞ্জে আসবেন। শেখ মুজিবুর রহমান তখন স্কুলের ছাত্র। সেই সভায় তিনি সেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত সভা সুষ্ঠভাবে হওয়ার পর মিশন স্কুল পরিদর্শনে গেলেন সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবুর রহমান তখন মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুল পরিদর্শনের সময় সোহরাওয়ার্দী কিছু জিজ্ঞাসা করলেন, শেখ মুজিবুর রহমান উত্তর দিলেন। তিনি পরিচয় জানতে চাইলেন শেখ মুজিবুর রহমান পরিচয় দিলেন। সোহরাওয়ার্দী তাকে আদর করলেন এবং বললেন , তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই? বললাম, “না” কোন প্রতিষ্ঠান নেই মুসলিম ছাত্রলীগও নেই। তিনি কিছু না বলে নোটবুক বের করে শেখ মুজিবুর রহমানের ঠিকানা নিলেন। হঠৎ একদিন এক বন্ধুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে খুব উত্তেজনা চলছে। তখন শেখ মুাজবুর রহমানকে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। একপর্যায়ে পুলিশ তাঁর মা-বাবাকে গ্রেফতার করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ফুফাতো ভাই পরিস্থিতি অনুধাবন করে বললেন পার্শ্বের বাড়িতে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বললাম না যাব না। লোকেরা আমাকে ভীতু বলবে, যে আমি ভয় পেয়েছি। পরবর্তীতে তাকে ও তাঁর বন্ধুদের গ্রেফতার করা হয় এবং কোর্টে চালান করা হয়। অনেক ঘটনার পর আলোচনার মাধ্যমে মামলার শেষ হয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে লাগে ১৫০০ টাকা । এটাই তাঁর প্রথম কারাগারের জীবন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

শিশু অধিকার ও সনদ : বর্তমানে বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয় জাতিসংঘের ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ পালনের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। জাতিসংঘ ১৯৫৯ সালে প্রথম শিশু অধিকার সনদ নামে প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। অত:পর ১৯৭৯ সালে বিশেষ শিশু বছর পালিত হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘে বিশ্ব রাষ্ট্রপ্রধানগণ শিশু অধিকার নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করে ৫৪টি ধারা সংবলিত শিশু অধিকার সনদ প্রণয়ন করেন।

পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা : শেখ মুজিবুর রহমান জন্মলাভের পর ১৯৩৯ সালে প্রথম কারাজীবনের অভিজ্ঞতা। এরপর সকল ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শকে অক্ষুন্নত রেখে ধাপে-ধাপে এগিয়ে চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর চরিত্র ও কৃতিত্বের কারণে যুগ্ম সম্পাদক এরপর সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাজারো মিথ্যা মামলা তাঁর আদর্শকে দমাতে পারেনি। পারেনি বাঙালির অধিকার ছিনিয়ে নিতে। জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিল তাঁর আদর্শ, সততা, ন্যায়নীতি ও বীরত্ব দেখে। তাই বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশেরও জন্ম হতো না। আজ দুঃখ হয় স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। তাঁরা বর্তমান প্রজন্মকে বিকৃত ইতিহাস পড়িয়ে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে। সেই বিভ্রান্ত থেকে বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর আদর্শ, সততা, ন্যায়নীতি আজও আমাদের মাঝে বিদ্যমান। বাঙালি জাতি আজ সর্বোচ্চে পৌঁছানোর পশ্চ্যাতে তাঁর অবদান অতুলনীয়। পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালিরা তাঁর দেখানো পথে চলবে এবং তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করবে।

লেখক : ছাত্র, সম্মান ৪র্থ বর্ষ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ , রাজশাহী। মোবাইল- ০১৭৬২-৮৪১৭০২

SUMMARY

1630-1.jpg