জাতির পিতার আদর্শ ও আজকের প্রজন্ম ভাবনা


ড. শিরীণ আখতার
বছর ঘুরে ১৫ আগস্ট আমাদের সামনে ফিরে আসে। অতপর আমরা দুঃখভারাক্রান্ত হই। শোকে নুয়ে পড়ি। জাতির পিতা হারানোর মতো ইতিহাসের চরম সময়টি নিয়ে আমরা হাজারো ভাবনার অবগাহনে ডুব দিই। পুরো জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে সেদিন কেন এমন নিষ্ঠুর চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছিল মহাকালের এই মহানায়ককে? এই ভাবনা আমার কাছে যেমন, ঠিক এই সময়ের তরুণ প্রজন্মকেও সমানভাবে ভাবিয়ে তুলে। আর এই ভাবনার মধ্যে দিয়েই আমরা আত্মোপলব্ধির পথ খুঁজে বেড়াই। আমরা শত্রুমিত্র চিহ্নিত করতে পারি। শুভ আর অশুভ শক্তির পরখ বুঝতে পারি।

সমকালীন উপমহাদেশে যে ক’জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিল ব্যতিক্রম। তাঁর বেড়ে ওঠার পরতে পরতে তাকালে আমরা দেখি তিনি নিজেকে কীভাবে অপরিসীম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কীভাবে বাংলার বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, হয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তথা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা।

আমরা জানি, ইতিহাসই যুগে যুগে প্রবাদ পুরুষদের জন্ম দেয়। ইতিহাসের হাতে তৈরি হওয়া সেই ব্যক্তিরাই আবার ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তেমনি একজন প্রবাদ পুরুষ। বঙ্গবন্ধু একদিনে তৈরি হয়নি, তিনি নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করেছিলেন সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে। মানুষের হৃদয়ের গহীনে থাকা ভাষা তথা অনুভূতিগুলো তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন। এই যে বুঝতে পারার ক্ষমতা তা–ই তাঁকে জনগণের কাতারে নিয়ে গিয়ে ছিল।

তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি। অধিকার, স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষের কল্যাণ সাধন এবং স্বাধীন ও মুক্তির লক্ষ্যে তাদের চালিত করা। পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মনে সূর্যের আলোর প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্বলিত করেছেন, জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাগিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তি। ‘জয় বাংলা’ দিয়ে বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। সেই সাথে বাঙালি জাতিকে একটি চেতনায়, একটি ভাবধারায় ও একটি আকাঙ্ক্ষায় তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। সর্বোপরি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ–ধারা ও তার ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের যেসব ঐতিহাসিক অর্জন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার প্রতীক ও কেন্দ্রবিন্দু। আর তা সম্ভব হয়েছিল তাঁর অদম্য, একনিষ্ঠ দেশপ্রেম ও কৃতিত্বের কারণেই।

মানুষ হিসেবে, একজন বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন কত গভীর ছিল, রাজনীতিক কুশীলব হিসেবে তিনি মানুষের ভালোবাসার সাথে নিজেকে কতটা সম্পৃক্ত করেছিলেন প্রকৃতপক্ষে তা–ই তাঁকে অমর করে রেখেছে। তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই তাঁর সেই পরিচয় পাই। তিনি বলেছেন ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

ব্যক্তিগত গুণাবলী, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অসামান্য চরিত্রমাধুর্যের সৌরভে অবিস্মরণীয় নেতাদের কাতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ইতিহাসের অতুলনীয় এক মহাকাব্যের মতো। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ভালো মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন যে কারও আদর্শ হওয়ার মতো। এই প্রজন্মের ছেলেরা যখন এখনকার রাজনীতিবিদদের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরতে চায়, তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তাদেরকে তাঁর দেখানো পথে চলতে উৎসাহ জাগায়।

বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে এমন এক মহান নেতা পেয়েছে। একই সাথে আমাদের দুর্ভাগ্যও যে তাঁকে আমাদের হারাতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে না থাকলেও ইতিহাসের মহাসড়কের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব পথ তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনদর্শন তিনি আমাদের জন্য তথা সমস্ত বাঙালি জাতির জন্য অপার আদর্শ হিসেবে রেখে গেছেন। সে আদর্শ ধারণ করে বাঙালি এগিয়ে যেতে পারে সামনের দিকে। কেননা একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার অতীত ইতিহাস, বর্তমান কর্মকাণ্ড আর আগামী প্রজন্মের ভাবনার উপর। তরুণ প্রজন্মকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম।

অনেক ত্যাগ ও সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে প্রিয় স্বদেশকে আমরা পাই স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গে অর্জন, সংকট ও সম্ভাবনা আমরা খুঁজে দেখতে চেয়েছি; আর চেয়েছি এ অনুসন্ধান হোক তারুণ্যের চোখে। সেই তারুণ্য, যাদের প্রত্যেকের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে, জন্মেই যারা পেয়েছে স্বাধীনতার আস্বাদ, পরাধীনতার শৃঙ্খল বিষয়ে যারা অনভিজ্ঞ এবং যারা দেখেনি ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি শোষণ সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই। প্রিয় বাংলাদেশ, যার সমৃদ্ধি আমাদের গৌরবান্বিত করে, যার ব্যর্থতা আমাদের বিদীর্ণ করে, সেই বাংলাদেশকে আরও বর্ণিল, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে আজকের তারুণ্যের অপার সম্ভাবনাই যে সবচেয়ে বড় শক্তি, তা আমরা বিশ্বাস করি। পূর্ব প্রজন্মের গৌরব ও কীর্তি পরবর্তী প্রজন্মের স্পর্ধিত হাতে এগিয়ে যায় সামনে, এটিই সমাজ প্রগতির শিক্ষা। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা। তাদের অস্তিত্বে থাকবে বাংলাদেশ। তরুণদের কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। তাদের সব স্বপ্ন হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। তরুণদের এই ভাবনায় যুক্ত করতে হবে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শ।

জানতে হবে, বঙ্গবন্ধুর মতো পুরো জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গ করার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ব্যক্তিচিন্তা, স্বার্থপরতা কিংবা আত্মকেন্দ্রিকতা নয় বরং তাঁর চিন্তা ছিল সামগ্রিক। তিনি আমাদের যে বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন তা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম যদি এসব না ভেবে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

সেজন্য অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের পড়া/অধ্যয়ন করতে হবে। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে জাতির পিতা হয়ে ওঠেছিলেন তা এখানে রয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে তিনি এসব লিখেও দিয়ে গেছেন। আমাদের অভিভাবকদের উচিত বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও জ্ঞানের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি, মানুষের প্রতি আস্থা রাখা, স্বদেশের প্রতি নিজেকে নিয়োজিত করার যে দৃষ্টান্ত–তা শিক্ষা দেয়া।

বঙ্গবন্ধু জীবনের একটি মুহূর্তও অযথা ব্যয় করেননি। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আজকের প্রজন্মের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মূল্যবোধের সেতুবন্ধন তৈরি করে দিতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা অব্যাহত রেখে আমাদের দায়িত্ববোধের প্রমাণ রাখতে হবে। বাংলাদেশের একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রার কাজ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাহলে বাংলার মাটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর যে রক্ত মিশে আছে সেখান থেকে জন্ম হবে হাজারো বঙ্গবন্ধুর। যারা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দেবে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং এনে দেবে মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা আর দূর করবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হানাহানি। তাহলেই বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিরল ভূমিকা আমদের অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরকাল।

আজকের তরুণদের ভেতর রাজনীতিবিমুখতা প্রত্যক্ষ করে কখনও কখনও হতাশ হতে হয়। অপরাজনীতি এবং সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক রাজনীতি দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। বঙ্গবন্ধরু হত্যাকাণ্ডের পর অপরাজনীতির উল্লম্ফন ও বিচিত্র বিকাশ দেখে তরুণদের মনে রাজনীতি সম্পর্কেই অনীহা তৈরি হতে পারে। রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে কাজ করতেই হবে এমন নয়, রাজনীতি সচেতনতাই জরুরি। সেক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীন দেশের স্থপতির আদর্শচর্চা একান্ত জরুরি। বঙ্গবন্ধুর দেশাত্মবোধের মানসচিত্তে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠলে দেশ সোনার মানুষে ভরে উঠবে এবং সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের মানসিকতা এবং জনগণের প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় যুগযুগান্তরের দর্শন হিসাবে আমাদের সামনে কাজ করবে। তার দর্শনের পথই আমাদের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কেননা বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম। অনুকরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের নাম। ব্যক্তিত্বের সাথে নেতৃত্বের যোগাযোগ তা বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। বিরল নেতৃত্বগুণ, সম্মোহনী শক্তি, অসাধারণ বাগ্মিতা, ভাব–প্রকাশের নিজস্ব ধরণ, তাঁকে কালের নায়কে পরিণত করেছিল। তাঁর হৃদয়ভর্তি আবেগ ছিল। সে আবেগকে তিনি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেনি, বঙ্গবন্ধুই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। কেবল জাতিগোষ্ঠী নয়–পৃথিবীর সমস্ত মানুষই তাঁর আপনজন–বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের অংশ, তা বঙ্গবন্ধুর চরিত্র থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, মানবিক হতে হবে, নিষ্ঠাবান হতে হবে, চরিত্রের মধ্যে সৎগুণাবলীর প্রকাশ ঘটাতে হবে। যা কিছু নিজের জন্য, দেশের জন্য উত্তম–তা–ই করতে হবে। আর যা কিছু মন্দ তা পরিত্যাগ করতে হবে। এককেন্দ্রিক নয়, সামষ্টিক চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। সকলের জন্য কাজ করা এবং সকলকে সুখের অংশীদার করা প্রকৃত মানুষের কর্তব্য।

আর এই বোধ নিজের মধ্যে জাগ্রত করার জন্য দরকার প্রকৃত ইতিহাস পাঠ। সাথে সাথে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সমাজ–সজ্ঞানতা এবং দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এসব শিরোধার্য করলেই আজকের তরুণের মাঝে স্বদেশপ্রেম এবং জাতির জনকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জাগরূক রাখবে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে যে জীবনদর্শন দিয়ে গেছেন–আদর্শ রেখেছেন তা অমলিন, অমর হবে তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎকর্ষতায়। তাই রক্তাক্ত আগস্ট হোক বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর দেশপ্রেমের আদর্শ লালন ও চর্চার শপথ।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, গবেষক। উপ–উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1629-1.png