সেই রক্তঝরা দিন


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

কিছুদিন যাবৎ মা বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তাই মাত্র দুই দিন আগে তাকে পিজিতে ভর্তি করা হয়েছে। মাকে ঘিরেই আমাদের পরিবার। তাই ঐ সময় বলতে গেলে সিদ্দিকী পরিবারের দ্বিতীয় ঠিকানায় পরিণত হয়েছিল ঢাকার পিজি হাসপাতাল । মা`র কেবিনের পাশের বেডে চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মা নাকি খালা ছিলেন। রাত অনুমান একটা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই দেখি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি ট্যাংক কাকরাইলের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমার বাসা মোহাম্মদপুরে । ময়মনসিংহ সড়ক ধরে সামান্য এগিয়েই দেখলাম আরেকটি আস্তে আস্তে দক্ষিণে যাচ্ছে। সোনারগাঁর ওখানেও একটি।

এতক্ষণ মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি, ট্যাংকগুলি ওদিকে যাচ্ছে কোথাও। কিন্তু পরপর তিনটি ট্যাংক ওভাবে দেখে কেন যেন মনে হল ওরা যাচ্ছে কোথায়? গাড়ি ঘোরালাম। শেরাটনের সামনে দিয়ে কাকরাইলের মোড়ে গিয়ে দেখি চুপচাপ একটি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থামালাম না। মৎস্য ভবনের পাশ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট হয়ে পিজির রাস্তা ধরে আবার ফিরে এলাম। ট্যাংক তিনটি কাকরাইলের মোড়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমের কাছে-ধারে দাঁড়িয়ে আছে। রাত তখন প্রায় সোয়া একটা। মনে তেমন কোনো দুঃশ্চিন্তা ছিল না। কোনো গাড়ি-ঘোড়া নেই। রাস্তা ফাকা । সাঁই সাঁই করে কাওরান বাজারে চলে এলাম। আবার দেখি দু’টি দক্ষিণে ধেয়ে চলেছে।

ব্যাপার কী! বৃহস্পতিবার রাত। সাপ্তাহিক রাত্রিকালীন সামরিক মহড়া নয়তো? বিজয় সরণী শেষে এমপি হোস্টেলের সোজাসুজি উত্তরে রক্ষিবাহিনীর সদরদপ্তর ছিল তখন। কর্নেল আনোয়ারুল আলম শহীদ রক্ষীবাহিনীর অন্যতম পরিচালক। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আমার একজন সহকর্মী ছিলেন। ঢুকে পড়লাম রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। সামনেই ছিল আনোয়ারুল আলম শহীদের অফিস। গাড়ি থেকে নামতেই তিনি দৌড়ে এলেন। সদর দপ্তরে যারা ছিল তারা প্রায় সবাই আমার চেনা। তার কারণও ছিল। রক্ষীবাহিনীর প্রায় পাঁচ ভাগের দুই ভাগই আমার দলের (কাদেরিয়া বাহিনীর) সদস্যদের নিয়ে। ৬৫-৭০ জন লিডারের মধ্যে ৩৫ জনই আমার দলের।

রাত প্রায় একটা পঁচিশ। গিয়ে বসলাম শহীদের অফিসে। কৌতূহল বসে জিজ্ঞেস করলাম, রাস্তায় ট্যাংক, এত রাত পর্যন্ত আপনিও অফিসে। ব্যাপার কী বলুন তো?

কাল সকালে লিডার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। আপনি জানেনই। কারা গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফাটিয়েছে। তাই শহরে টহল দিতে তিনটি ট্যাংক বের করা হয়েছে। এবং আমাদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

তাই নাকি! আমরা তিনটি শুনেছি। হয়তো বেশিও বেরুতে পারে। তিনটা না পাঁচটা- এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কী আছে?

শহীদের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না । ছুটলাম ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। তার কাছে যেতে আমার কোনো সময়-অসময় ছিল না। আমাদের বড় ভালবাসতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন, অপরিসীম গুরুত্বও দিতেন। আমার মনে পড়ে না, সেই একটি অনুরোধ ছাড়া আমার কোনো কথা তিনি ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিচ তলায় ডান পাশে অভ্যর্থনা কক্ষ ছিল । সেকশন অফিসার পদ মর্যাদার একজন ডিউটিতে ছিলেন। গেটের রক্ষীরা কেউ ফেরায়নি। কারণ, প্রায় সবাই আমাকে চিনত, আমার মর্যাদার কথাও জানত। একমাস আগে গভর্নর মনোনীত হওয়ায় রক্ষীদের কাছে মর্যাদা আরো বেড়েছে। অত রাতে আমাকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। নেতার সঙ্গে কথা বলব শুনে অস্বস্তিতে যেন কেমন হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, `স্যার এতরাতে স্যার আপনিই রিং করেন স্যার।’

রিসিভার তুলে বোতাম টিপলাম । এক টিপে কাজ হল না। ৮-১০ সে পর আবার টিপতেই পিতার কণ্ঠে ভেসে এল—

কে?

আমি কাদের।

এত রাতে!

হ্যাঁ, এত রাতেই। আমি একটু কথা বলতে চাই।

আয়, উপরে চলে আয়।

গেট খুলে উপরে গেলাম। লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়ে তিনি বেরিয়ে এলেন। লার বারান্দায় কাধে হাত দিয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। কী রে? কী হয়েছে? একটু পরেই তো সকাল হবে। কী এমন কথা যে রাতটাও অপেক্ষা করতে পারলি না!

আপনি তো জানেন, মা পিজি হাসপাতালে।

হ্যাঁ, জানিই তো। তোর মাকে দেখা-শুনা করতে প্রফেসর নুরুল ইসলামকে বলে দিয়েছি। কেন, তোর মায়ের কী হয়েছে?

না, তার কিছু হয় নি। মাকে দেখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই ট্যাংক দেখলাম।

তাতে কী হয়েছে? তুই জানিস না, গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বােমা ফাটিয়েছে? তাই আমি মহড়া দিতে শহরে তিনটা ট্যাংক নামাতে বলেছি।

তিনটা নামাতে বলেছেন? আমি তো বেশি দেখলাম।

বেশি! কত বেশি? ক`টা দেখলি?

তা পাঁচটা তো এক ময়মনসিংহ সড়কের উপরেই দেখে এলাম।

না, তা হয় কী করে? আমি তো তিনটা নামাতে বলেছি।

বঙ্গবন্ধুর কথায় আমার যেন কেমন মনে হতে লাগল। অনেক দিন থেকে জাতির পিতাকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্রের জাল নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে, তা তিনিও জানতেন। আমার কাছে নানা জায়গা থেকে নানা রকম চিঠি এসেছে। এ নিয়ে নেতাকে অনেক বলেছি। তিনি প্রতিবারই নিরুৎসাহিত করেছেন। ১৪ আগস্ট রাত একটা চল্লিশ মিনিটে আবার বললাম।

না, তিনি সেদিন আমার কথা শুনেন নি। আমিই হয়তো তাকে ঠিকভাবে আমার সারকথা বুঝাতে পারিনি। কারণ, সেদিন তো আমি কোনো মন্ত্রী ছিলাম না। বা বড় মাপের কোনো নেতাও ছিলাম না। তাই হয়তো পারিনি। যখনই সেদিনের সেকথা মনে হয়, আমি আমাকে ধরে রাখতে পারি না, বেদনায় বুক দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে আসে। দু`চোখ ঝাপসা হয়ে শুধুই অন্ধকার দেখি। ঐ মানুষটার মৃত্যুতে কার কতটা ক্ষতি হয়েছে জানি না। কিন্তু আমি আমারটা তো জানি। যৌবন কেটেছে নির্বাসনে, অবহেলায়, অনাদরে । জীবনে যা পাবার এবং হারাবার এসবই ঐ একটি মানুষের জন্যই হয়েছে। শঙ্কিত কণ্ঠে নেতাকে বললাম, আমার যেন কেমন লাগছে। আপনি জানেনই তো ষড়যন্ত্রকারীরা বসে নেই। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি।

কেনরে, মনে করব কেন? তোর কোন কথায় কখন কী মনে করেছি? এই যে তুই এত রাতে এলি, আমি কি কিছু মনে করেছি?

সেদিন আপনি তো কাউকে কিছু না বলে একাই হুজুর মাওলানা ভাসানীকে দেখতে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গিয়েছিলেন। শুনেছি রাজাবাদশাহ ও ভাল শাসকরা দেশের মানুষের অবস্থা দেখতে কখনো-কখনো ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। আপনিও একবার বেরিয়ে পড়ুন না।

বলিস কী রে! আমি কী সেই ছোট্টটি আছি? দেশের প্রেসিডেন্ট। রাতে একাকী অনঙ বেরিয়ে পড়ব! সারাদেশে হৈ-হুল্পেড় পড়ে যাবে না?

পড়ুক না। দুনিয়া জানুক, দেশের মানুষের খবর নিতে আপনি রাস্তায় বেরিয়েছেন।

না রে কাদের। এত রাতে তুই আর পাগলামি করিস না। দেখিস, কিছু হবে না। বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমা গিয়ে।

তখন আমিই কি জানতাম আমার পরম আশ্রয় নেতা ও পিতার সঙ্গে সেই শেষ দেখা। দুই-আড়াই ঘণ্টা পর কী ঘটতে যাচ্ছে তার বিন্দু-বিসর্গও যদি টের পেতাম তাহলে কি তাকে ওভাবে ছেড়ে আসতাম? না, কখনো না। বাড়ি ফিরে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? মোয়াজ্জিনের ডাক—‘আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাউম, আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম’-এর পরিবর্তে গুলির শব্দেই যখন ঘুম ভাঙল তখন সব শেষ। হাজার বছরের বাঙালির আরাধ্য ধন, অমৃতের বরপুত্রের প্রাণহীন দেহ তখন ধানমণ্ডির বাড়ির সিড়িতে পড়ে আছে।

ছোটবোন সেলিনা সিদ্দিকীর প্রচণ্ড কড়াঘাতে ঘুম ভাঙে। বললাম, কী রে কী হয়েছে?

ভীষণ উৎকণ্ঠিত জবাব তাড়াতাড়ি উঠুন। কী আবার হবে? সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ করেছে।

বলিস কী?

বিশ্বাস না হয় শুনুন, রহিমা আপা ফোন করেছে। ফোন ধরতেই রহিমার বিচলিত কণ্ঠ। ছোটভাই, তাড়াতাড়ি বাড়ি ছাড়েন (আমাদের পরিবারের সবাই আমাকে ‘ছোটভাই` বলে ডাকে।)

বিশ্বাস হচ্ছিল না। রহিমাই রেডিও শোনাল। স্পষ্ট শুনলাম, মুজিব সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। কণ্ঠটি কোনো ঘোষকের ছিল না। তাই মনে হচ্ছিল কোনো উম্মাদ হয়তো বাংলাদেশ বেতারে ঢুকে মাতলামি করছে। একটু পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। না, সেদিনের ঘটনা কোনো মাতলামি ছিল না। সেটা ছিল রূঢ় বাস্তব। এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরুলাম। পাশের বাড়ির গাড়ি করে ইউসুফ নিয়ে চলল রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল কোথায় যাব? দিশেহারা পাগলের মতো ছুটলাম ধানমণ্ডির দিকে।

রাস্তায় কোনো গাড়ি-ঘোড়া, লোকজন নেই, কেমন যেন থমথমে। ২৭ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে কয়েক গজ এগুতেই এক বয়সী ভদ্রলোক এসে গাড়ির সামনে দাড়ালেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। টান মেরে দরজা খুলে সামনে ঝুকে ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছেন? আপনি কিছু জানেন না? আমি `না` বলতেই লোকটি আমার হাত ধরে জোর করে টেনে তা তাঁর বাড়ির প্রকাণ্ড ড্রয়িং রুমে ধাক্কা মেরে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওদিকে যাবেন না। একটু আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গোলাগুলি হয়েছে। কী হয়েছে জানি না। আপনি গেলে খোঁজখবর নিয়ে যান।’

ততক্ষণে আমার চেতনার অনেকটা হয়তো লোপ পেয়েছিল। ভদ্রলোক এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। কখন কীভাবে ঢকঢক করে পানি পান করে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না । গলা শুকিয়ে জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। শরীরে কোনো বল ছিল না। কীভাবে যেন গাড়িতে উঠে মোহাম্মদপুর গজনবী রোডে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের দাদুর জয় ভিলায় আশ্রয় নিলাম। দিদা-দাদু আমার জন্যেই নাকি চিন্তা করছিলেন। অনবরত রেডিও বেজেই চলেছে। বারবার নিজেকে মেজর ডালিম পরিচয় দিয়ে ঘোষণা করছে, ‘মুজিব সরকারকে উৎখাত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে।’

শুনে কেমন যেন হয়ে গেলাম। বলে কী! এ অসম্ভব, কিছুতেই হতে পারে না! তখনো আমার চোখে পানি আসে নি। কিন্তু সকল চিন্তা ও অনুভূতি কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরেই পাকিস্তানের খবর শুনলাম। তারা প্রচার করল, বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে তার ধানমণ্ডির বাড়িতে নিহত হয়েছেন। এতক্ষণে ভয়েস অব আমেরিকাও হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত খবর পরিবেশন করল। খবর শুনে মনে একটি প্রশ্ন উঁকি মারতে লাগল– এত তাড়াতাড়ি ওরা জানল কী করে? তবে কি ওরা সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই কাজটি করেছে? একটু পরেই শুরু হল হল মোশতাক সরকারের প্রতি সরকারি-বেসরকারি, বড়-বড় রথী-মহারথী, হোমড়া-চোমড়াদের আনুগত্য প্রকাশের পালা।

রক্ষীবাহিনীর পরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদ, যার সঙ্গে গতরাতে আমার কথা হয়েছিল, সে এবং আরেক পরিচালক মেজর (অবঃ) হাসান রেডিওতে গিয়ে খুনী মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য জানাল। এরপর পুলিশের আই.জি. নুরুল ইসলাম, বিডিআর প্রধান বি. খলিলুর রহমান, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম, উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, আরো অনেকে। এ যেন আনুগত্যের এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দুপুর গড়িয়ে গেল। ইতোমধ্যে খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়ে গেছে। সেই মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের প্রায় সব মন্ত্রী স্থান পেয়েছে। যারা পাননি বা যাননি তারা পরে জীবন দিয়েছেন জেলখানায়। বঙ্গভবন তখন প্রত্যক্ষ খুনী মেজর-কর্নেলদের দখলে। কর্নেল ফারুক, রশীদ, মেজর হুদা, নুর সহ আরো ক`জন খুনীর দাপটে প্রকম্পিত।

মোদাব্বের দাদুর গজনবী রোডের বাড়িটা খুব নিরাপদ মনে হচ্ছিলো না। আমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আরিফ আহমেদ দুলাল পীড়াপীড়ি করছিল কোথাও যেতে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় যাব। সিরাজদ্দৌলা নাটকে শুনেছিলাম, ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা`– আমার অবস্থাও তাই হয়েছে।

কত জন একটুক্ষণের জন্যে তাদের বাড়িতে নিতে ব্যাকুল হয়ে থাকত। ঢাকা শহরে আমার কত জায়গা, কত ঠিকানা। কিন্তু কিছু নেই। টাঙ্গাইলেন সিলিমপুরের আব্দুস সবুর দারোগা খুবই ধনী মানুষ। মুসলিম লীগ করতেন মুক্তিযুদ্ধ না করলেও হানাদারদের সঙ্গে মিলে কোনো ভূমিকা নেননি। তার ছেলে এবং ভাতিজা আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ছিল। সবুর সাহেবের ছেলে আবার দুলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই সে জোর করতে লাগল ওখানে যেতে।

শেষ পর্যন্ত খিলজি রোডে সবুর সাহেবের বাড়িতেই গেলাম। সেই দুঃসময়ে সবুর সাহেব এবং তার স্ত্রীর অভাবনীয় সহমর্মিতায় অভিভূত ও বিস্মিত হলাম । এ যে কয় ঘণ্টা তাদের বাড়িতে ছিলাম কখনো আমাকে একা হতে দেননি। স্বামী-স্ত্রীর একজন না একজন সব সময় পাশে থেকেছেন এবং বারবার সান্তনা দিয়েছেন। আল্লাহর রহমতে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এ বাড়ি থেকেই বিকেল চারটায় মান্নান সাহেবকে ফোন করলাম। তখন তিনি আবার খুনী মোশতাকের মন্ত্রী। আমি তখন আসলেই খুব শঙ্কিত হলাম। ফোন ধরতেই মান্নান ভাই বললেন, ‘কাদের, আমি দেখছি, তুমি কোনো চিন্তা করো না। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শুধু বললেন, `Take Care of the boy.` আমি বুঝতে পারলাম না। প্রেসিডেন্টকে বললাম, `Who is the boy?` তখন তিনি তোমার কথা বললেন। তুমি আগে নিজেকে রক্ষা করো। তারপর যা করার করো। ফোন ছেড়ে দিলাম। সারাদিন ছোট-বড়, সামরিক-বেসামরিক, নেতা উপনেতা কারো সঙ্গেই কথা বলতে বাকি রাখিনি। এরপর আর তেমন কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। বিকেল হয়ে আসছে। সারাদিন কিছু মুখে দিই নি। ক্ষুধাও অনুভব করিনি। বাড়ির সবাই অনেক বলে-কয়ে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে গেলেন। সারাদিন না খাওয়ায় গলা শুকিয়ে ছিল। কয়েক লোকমা হয়তো খেয়েছিও। তখনই টিভিতে খবর শুরু হল। প্রথমেই মোশতাক মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ । সব চেনা মুখ। সবাই বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের সহকর্মী। দেহমনে তরঙ্গ খেলে গেল। সারাদিন চোখে পানি আসেনি। মুহূর্তে দু’চোখ থেকে টপ টপ করে ভাতের থালাতে পানি পড়তে লাগল। এতক্ষণ যে মাংস চিবুচ্ছিলাম, মনে হতে লাগল, এ যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস। আর খাওয়া হল না। সেই আমার মাংস খাওয়া বন্ধ হলো। সারা দেহ মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে লাগলো। এতক্ষণ ছিলাম হতোদ্যম, দুর্বল, শোকাতুর। সব ভয়-ভীতি জড়তা মুহূর্তে কেটে গেল। টার-পাঁচটা ফোন করলাম। ভালো করে কথাও বলতে পারছিলাম না। কিন্তু তবু কয়েক জনকে একত্র হতে বললাম। খিলজি রোডের বাড়িতেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু কর্তব্যের আহবানে রাত ৯টায় ঠিকানা ছাড়লাম। আস্তানায় গিয়ে দেখি দু একজন ছাড়া সবাই এসেছে। ঘনিষ্ঠ অন্যরাও খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। কথা হলো- কী করা যায়। সবার মত–প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিনা চ্যালেঞ্জে কিছুতেই যেতে দেয়া হবে না, মরতে হয় মরব । তার বদলা আমরা নেবই। স্থির হল, প্রতিরোধ সংগ্রাম যে শুরু হয়েছে দেশবাসীকে জানাতে হবে এবং তা এখনই। একটা লিফলেট লেখা হল। তেমন কোনো কথা নয়। বাঙালিরা কোনোদিন কোনো অন্যায় সহ্য করে না। কোনো রক্ত চক্ষুকে ভয় করেনি। তারা জীবন দিতে এবং নিতেও যে জানে, তাই শুধু জানিয়ে দেয়া। লেখা হল, ‘নরঘাতকেরা জাতির জনকের তিন পুত্র কামাল, জামাল, রাসেলকে হত্যা করতে পারলেও তার আদর্শের চতুর্থ সন্তান, আমি কাদের সিদ্দিকী বেঁচে আছি। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ আমরা বাঙালিরা নেবই নেব।’

পরদিন মা`র সঙ্গে দেখা। মাকে দেখে দু`চোখে বান ডাকল । মা`র বুক ভিজে গেল আমার চোখের পানিতে। এ কান্না যেন আর থামতে চায় না। অনেক পরে কিছুটা শান্ত হলে মা বললেন, ‘বজ্র, তুই এখনো ঘরে? ওরা পেলেই তোকে মেরে ফেলবে। যদি মরতে হয়, রাস্তায় গিয়ে প্রতিবাদ করে গুলি খেয়ে মর। তবু আমি বলতে পারব, আমার ছেলে জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদ করে মরেছে। ঘরে বসে মরলে আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। তুই আমাকে অমন শাস্তি দিস না।’

মা চলে গেল, আমারও বারবার মনে হতে লাগল, আর চাই কী? পথের নির্দেশ পেয়ে গেছি। সন্ধ্যা নামতেই বেরিয়ে পড়লাম অজানার পথে, প্রতিরোধের দুর্গ গড়তে। দীর্ঘ ১৬ বছর আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

[রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ১২৩ থেকে ১২৯)]

বাংলা ইনসাইডার

SUMMARY

1625-1.png