রাজনীতিতে মত, পথ ও দলের ভিন্নতা থাকতেই পারে। তাই বলে রাষ্ট্রের জনককে অস্বীকার করা? জনকের কোনো ভুলভ্রান্তির জন্যও কি জনককে অস্বীকার করা যায়? যদি ধরেও নিই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে একদলীয় শাসন, রক্ষীবাহিনী, রাষ্ট্রপতির শাসন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ, চতুর্থ সংশোধনী সবই ভ্রান্ত ছিল, তবু সেই ভুল দর্শন তো ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের জন্য বাংলাদেশে বলবৎ ছিল। এখন তো তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাহলে কিসের বিদ্বেষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি? রাষ্ট্রের জনককে স্বীকার করা রাজনৈতিক পরাজয় নয়
পৌরুষদীপ্ত চেহারায়, বাঙালির চিরায়ত অবয়বে, ব্যক্তিত্বে, উচ্চতায়, উঁচু তর্জনীতে, কণ্ঠে, সাহসে, লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তায়, আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, বাংলা ও বাঙালির প্রতি চির বিশ্বস্ত রাজনীতিক, বাঙালির চিরায়ত স্বপ্নের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সারথি তিনি। তাঁর তর্জনী উঠলেই একটি জাতি জেগে উঠত। আমি বঙ্গবন্ধুর কথা বলছি। বাঙালির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে এমন দরদি নেতা, জনক, স্থপতি, বন্ধু একবারই জন্মেছিলেন। গোপালগঞ্জের নিভৃতপল্লী টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কর্ম, ত্যাগ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহসিকতা, সততা, সর্বোপরি বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি তাঁর অতল ভালোবাসায় নেতা থেকে বাংলা ও বাঙালির পরম আত্মীয়ে পরিণত হয়েছেন। তাইতো বঙ্গবন্ধুর কল্যাণ কামনায় বাঙালি রোজা রেখেছে, নামাজ পড়েছে, পূজা-অর্চনা করেছে। কোনো নেতার জন্য মানুষের এমন দরদ কস্মিনকালেও শোনেনি কেউ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালির আত্মার বন্ধন তৈরি হয়েছে বলেই মৃত্যুতেও সে বন্ধন ছিন্ন হয়নি, হওয়ার নয়।
তাইতো মৃত্যুর কয়েক দশক পরও মুজিবকে মুছে ফেলার সব অপচেষ্টা পদদলিত করে বিশ্বব্যাপী বিবিসির জরিপে কালজয়ী রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। বাঙালির হৃদয়ের আকাশে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্য গগনে। বাঙালির কাছে মুজিবের তুলনা শুধুই মুজিব। কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু কিভাবে তাঁর চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়, অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা সমকালীন রজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছলেন? এ প্রশ্নের উত্তর বঙ্গবন্ধু নিজেই দিয়েছেন ১৯৭৩ সালের ৩০ মে লিখিত তাঁর ডায়েরির পাতায়। তিনি লিখেছেন. ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। ’ অতল দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা, বাঙালির অন্তরে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ গেঁথে দেওয়া, জেল-জুলুম, মামলা, নির্যাতন, ষড়যন্ত্রে দমে না যাওয়া বরং ত্যাগ, নিষ্ঠা, সাহসিকতা, সততা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা দিয়ে মোকাবেলা করার বঙ্গবন্ধুর অনন্য রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নির্ভরশীল বন্ধু হিসেবে বাঙালি হৃদয়ে তাঁকে এক বিশেষ উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ম্যাকব্রাইড যথার্থই বলেছেন, ‘ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরন ধিং ঃযব ংড়ঁষ ড়ভ যরং হধঃরড়হ.’ (বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর জাতির প্রাণভোমরা)। বাঙালির আজন্ম লালিত স্বপ্ন বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালির একটি স্থায়ী, স্বাধীন, সার্বভৌম ঠিকানা গড়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি তাই ভালোবেসে তাঁকে রাষ্ট্রের স্থপতি, জনক, পিতা বলে সম্বোধন করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের নাম লেখাতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি একাট্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। বাঙালিকে এক কাতারে নিয়ে আসা সহজ কাজ ছিল না। এক লহমায় এটি হয়নি। দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ পথ বেয়ে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ ও দুরূহ এ চ্যালেঞ্জের সফল সমাপ্তি হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক সিরিলডন টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন, ‘মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার জন্য বর্তমানের চমকপ্রদ নাটকীয় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘটনা শেখ মুজিবের এক দিনের ইতিহাস নয়, ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি তাঁর লক্ষ্য ছিল। ’ এ দীর্ঘ যাত্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কারাগার হয়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর আবাস। বিচারে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে অন্তত দুবার। তবু দমে যাননি বঙ্গবন্ধু। বরং নিজের ও পরিবারের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-সাধ বিসর্জন দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে জীবন বাজি রেখে সাহসী থেকে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছেন। পারিবারিক জীবনের কিছু উপলক্ষ থাকে, যা পরিবারপ্রধানের উপস্থিতির বাইরে মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত ও পরিবারের স্বপ্নকে কোরবানি করেছেন নিজ হাতে। স্ত্রীর সন্তান জন্মদানের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে, সন্তানের বিয়ের সময়ও বঙ্গবন্ধু কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি। দীর্ঘ কারাবাসে পিতৃস্নেহবঞ্চিত সন্তানের কাছে বঙ্গবন্ধু অচেনা হয়ে উঠেছেন কখনো কখনো। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ার বিপজ্জনক ঝুঁকি যেমন নিয়েছেন তেমনি ভয়ানক ষড়যন্ত্র আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার। ছয় দফা ঘোষণার পর অনেকেই ধরে নিয়েছিল মুজিবের রাজনীতি ও গ্রহণযোগ্যতা এখানেই শেষ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযোগ তুলে ছয় দফার সমালোচনায় মেতে ওঠেন। ডানপন্থী দলগুলো ছয় দফাকে পাকিস্তান ধ্বংস করার ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে। অন্যদিকে কিছু বামপন্থী ছয় দফার ভেতরে সিআইএর সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয় দফার প্রবল সমালোচনা হয়। দলের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ছিলেন চরমভাবে ছয় দফাবিরোধী। এই বিরোধিতা এতই প্রকট ছিল যে দলের মধ্যেই ভাঙন শুরু হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সব নেতা ও পূর্ব পাকিস্তানের আব্দুস সালাম খানের মতো অনেকেই দল থেকে বেরিয়ে ১৯৬৭ সালের মে মাসে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) গঠন করেন। আর পূর্ব বাংলার সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ তাঁর অনুসারীদের নিয়ে দলের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন। ১৯৭০ সালের যে নির্বাচন দেশ-বিদেশে বাংলার জনগণের বৈধ নেতৃত্বের স্বীকৃতি এনে দেয়, স্বাধীনতার আন্দোলনকে চূড়ান্ত যৌক্তিক রূপ দেয়, সে নির্বাচনের সময়ও বঙ্গবন্ধুকে কম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। ইয়াহিয়া খান ঘোষিত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ স্লোগানে ভাসানীর নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য। আন্দোলন নস্যাৎ করতে বঙ্গবন্ধুকে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট’, ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর একটি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের কথা যখন চিন্তা করি, তখন আপনাআপনিই একটি বিষয় আমার মনে চলে আসে, সৃষ্টিকর্তা বুঝি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। মহান প্রভু বাংলার স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। সৃষ্টিকর্তা বোধ করি বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্ক আর হৃদয়ে ভাষণখানি মুদ্রণ করে দিয়েছিলেন। তাই ভয়ানক চাপ আর টান টান উত্তেজনার মধ্যেও অলিখিত ভাষণ দিতে কোথাও থমকে যাননি বঙ্গবন্ধু। অনেকেই আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে প্রদত্ত ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে তুলনা করেন। কিন্তু আব্রাহাম লিংকন প্রদত্ত ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত, আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল তাত্ক্ষণিক এবং অলিখিত। তার চেয়েও বড় কথা, কী ভয়ংকর ঝুঁকি আর চাপের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে এ ভাষণ দিতে হয়েছিল, তা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। মার্চের শুরু থেকেই নানা ঘটনাপরম্পরায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে সারা দেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল ৭ই মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি তরুণরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল এমন কিছু না বলা, যা পাকিস্তানিপক্ষকে তখনই অজুহাত দেবে অপ্রস্তুত জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ যখন তুঙ্গে তখন ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন তিনি যেন এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন, যাতে আর প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ না থাকে। একই দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে আগামী ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। অন্যদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে হুমকি দেন, ‘মার্কিন সরকার পাকিস্তান ভাঙা সহ্য করবে না। ’ এত কিছুর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্য আরেকটি দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল আন্দোলন ও জনগণকে চাঙ্গা রাখা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে বক্তৃতা করা কঠিনতম সিদ্ধান্ত ছিল। বাঙালিকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু অবলীলায় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন, রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। সারা জীবন তিনি শুধু দিয়েই এসেছেন দেশকে, বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত জীবনটাও দিতে হয়েছে জনককে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করে, জীবন দিয়ে বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বঙ্গবন্ধু শোধ করে গেলেন। তবু বঙ্গবন্ধুকে আজও হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি এ ভূখণ্ডের কিছু মানুষ। এরা বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করে না। স্থপতি, জনক হিসেবে স্বীকার তো দূরের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর কোনো অবদানই স্বীকার করে না এ দলভুক্তরা। ওরা বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয় না, বঙ্গবন্ধুর অবদানের সরাসরি বিরোধিতা করে ওরা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নানা ঘটনার বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করে। তাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ নাগরিকের চেয়ে বেশি কিছু নন। তাদের মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শেখ মুজিব মাত্র। তারা অবয়বে বাঙালি হলেও চিন্তাচেতনা, মেধা-মনন, রাজনীতিতে পাকিস্তানি। কি অভিযোগ তাদের বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে? মোটা দাগে তাদের অভিযোগ হলো, বঙ্গবন্ধু ভারতপন্থী ও ইসলামের শত্রু, বঙ্গবন্ধুর সরকার দুর্নীতিপরায়ণ ছিল, একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেনাবাহিনীর সমান্তরাল রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সবচেয়ে তীব্র বিতর্ক বোধ করি রক্ষীবাহিনী ও বাকশাল সৃষ্টি নিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখনই কিছু মানুষ পরিকল্পিতভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। পাঁচজন সংসদ সদস্যসহ কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে, ঈদের জামাতে হামলা করে, পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়, রেললাইন ধ্বংস করে, সার কারখানা ধ্বংস করে, জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে খাদ্যাস্ত্র ব্যবহার করার প্রকাশ্য হুমকি দেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনৈতিক দল-উপদলকে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উত্খাতের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেন।
সে সময়ের দুর্নীতির বিষয় বঙ্গবন্ধু নিজেই তুলে ধরেছেন এবং কঠোর পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি কখনো। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ সালে খুনি মোশতাকের ক্যাবিনেট মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে শেখ মুজিবের অর্থ ও ধনসম্পদের বিবরণী রেডিও-টিভি ও পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। বিকেলে সব ব্যাংকের এমডিকে বঙ্গভবনে ডাকা হলো। কর্নেল রশিদ নিজে দরবার হলে তাঁদের সবাইকে ১৫-২০ জওয়ানের স্টেনগান ও এসএলআরের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল : ‘মীরজাফর শেখ মুজিবের কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, আপনারা তার বিবরণী নিয়ে এসেছেন?’ সোনালী ব্যাংকের এমডি ছাড়া সবাই বললেন, তাদের কারো ব্যাংকে তাঁদের কোনো অ্যাকাউন্ট বা টাকা-পয়সা নেই। সোনালী ব্যাংকের এমডি বললেন যে সোনালী ব্যাংক, ধানমণ্ডি শাখায় তাঁর তিন হাজার ৩০০ টাকা আছে।
রাজনীতিতে মত, পথ ও দলের ভিন্নতা থাকতেই পারে। তাই বলে রাষ্ট্রের জনককে অস্বীকার করা? জনকের কোনো ভুলভ্রান্তির জন্যও কি জনককে অস্বীকার করা যায়? যদি ধরেও নিই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে একদলীয় শাসন, রক্ষীবাহিনী, রাষ্ট্রপতির শাসন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ, চতুর্থ সংশোধনী সবই ভ্রান্ত ছিল, তবু সেই ভুল দর্শন তো ছয় মাসের কিছু বেশি সময়ের জন্য বাংলাদেশে বলবৎ ছিল। এখন তো তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাহলে কিসের বিদ্বেষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি? রাষ্ট্রের জনককে স্বীকার করা রাজনৈতিক পরাজয় নয়। বরং বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা। রাজনীতি যার যার, বঙ্গবন্ধু সবার।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়