১৫ই আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যিনি


 আগস্টের পর – ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটায় তখন মৃত্যুর শীতলতা। শেখ মুজিবের লাশ দাফন করা হয়েছে টুঙ্গীপাড়ায়, পরিবারের বাকীদের জায়গা হয়েছে বনানী কবরস্থানে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন সেযাত্রায়। তবে তাদেরও শিকার হতে হয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতির, পেরিয়ে আসতে হয়েছে বিরুদ্ধ স্রোত।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা তখন ছিলেন ইউরোপে। কিন্ত ১৫ই আগস্টের পর কেউই তাদের দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। বেলজিয়ামের বাংলাদেশ হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তা সানাউল হক আর মামুন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা ১৫ই আগস্টে বেলজিয়ামেই ছিলেন। এই দুজন তখন ফোন করলেন জার্মানীতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাসায়, তাকে বললেন- ‘হুমায়ুন তুমি আমার বাসায় যে মেহমানগো পাঠিয়েছো তাদের ফেরত নিয়ে যাও।’

১৫ই আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যিনি

রাষ্ট্রপতির কণ্যা থেকে হুট করেই যেন অনাহুত আগন্তক হয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। পরিবারহারা এই দুটো মেয়ের জন্যে মায়া আর মমতার সবটুকু ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে তখন এগিয়ে এসেছিলেন আরেকজন নারী, তার নাম মাহজাবীন চৌধুরী, সম্পর্কে তিনি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ফোনে বেলজিয়ামের বাংলাদেশ হাইকমিশনে শুধু অনুরোধ করেছিলেন, দুই বোনকে জার্মানীতে আসার জন্যে যাতে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। তার সেই অনুরোধটাও রাখা হয়নি। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তখন তার ব্যক্তিগত গাড়িটা পাঠালেন বেলজিয়াম বর্ডারে, সেটাতে করেই ১৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা, তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া, বোন শেখ রেহানা এবং ছেলে জয় এসেছিলেন তার বাসায়।

ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসলে কি হয়েছে, কত জনকে হত্যা করা হয়েছে, সেসব নিয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারণা তাদের ছিল না সেই সময়ে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে যে একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছে, সেটাও তারা জানতেন না। তখনও তারা জানতেন, শুধু বঙ্গবন্ধুই বেঁচে নেই, বাকীরা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। ছোট ভাই রাসেলের জন্যে সারাদিন কান্নাকাটি করতেন দুই বোন। হুমায়ুন রশীদের সঙ্গে ১৫ই আগস্টে তাদের প্রথম যখন দেখা হয়, শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘চাচা গো, আমাদের কাছে রাসেলকে এনে দাও।’ রশীদ সাহেব জবাবে বলেছিলেন, ‘রাসেলকে এখানে আনার চেষ্টা করছি। তোমরা শান্ত হও।’ তিনি নিজেও তখন জানতেন না, শেখ রাসেল বা বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউই ঢাকায় জীবিত নেই।

১৫ই আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যিনি

গতবছর বাংলাট্রিবিউনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছিলেন মাহজাবীন চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন- ‘ছয় দিন শেখ সাহেবের দুই মেয়ে আমাদের বাসায় ছিল, এক মুহুর্তের জন্যেও তাদের স্বাভাবিক দেখিনি। শুধু কান্না, হাউ মাউ, চিৎকার করে কান্না। আমাদের বাড়িটি ছিল তিন তলা। তৃতীয়তলায় ওদের দুই বোনের জন্যে দুটি রুম ছিল। একটিতে ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনাকে নিয়ে থাকতেন, অপরটিতে শেখ হাসিনার সন্তান নিয়ে শেখ রেহানা থাকত। ওই দুই রুমেই তারা থেকেছে। খাওয়া নাই, ঘুম নাই দুই বোনের। অনেক চেষ্টা করেছি তাদের মুখে খাওয়ার তুলে দেওয়ার, ঘুম পাড়ানোর। কিন্তু কিছুতেই তাদের চিৎকার করা কান্না থামাতে পারতাম না। কোনোমতেই সান্ত্বনা দিয়ে তাদের দুই বোনকে কুলানো যেতো না।’

বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে নিজেদের বাসায় আশ্রয় দেয়ায় প্রচুর হুমকিও সহ্য করতে হয়েছিল হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী আর মাহজাবীন চৌধুরীকে। মাহজাবীন চৌধুরীর ভাষ্যমতে- ‘‘জার্মানিতে বাংলাদেশি যারা থাকতেন তাদের মধ্য থেকে ২০/১৫ জনের একটি দল আমাদের বাসা ঘেরাও করেছিল একদিন। তারা আমাদের বাসায় হামলা করে বোমা মারার হুমকি দেয়। কারণ, এখানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, তাই। আমি বাইরে এসে বললাম ‘এটা জার্মানি, বাংলাদেশ নয়, এখানে কার বাড়িতে হামলা করবে তোমরা?’’ শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানাকে আশ্রয় দেয়ায় শাস্তিস্বরূপ জিয়া সরকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে ছয় মাসের জন্যে ওএসডি করেছিল।

১৫ই আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যিনি

মাহজাবীন চৌধুরী বলছিলেন, ১৮ বা ১৯ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা শুনলেন বাংলাদেশের এই ক্যু-র সঙ্গে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জড়িত কথাটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। এই ঘটনার পর শেখ হাসিনা বারবার বলেছিলেন, ‘আব্বা আমাদের সবসময় বলতেন কখনও কোন বিপদে পড়লে তোমরা মোশতাক কাকাকে জানিও, যেও। সেই মোশতাক কাকাই আমাদের এতিম করলেন!’

যে ছয়দিন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে জার্মানীতে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর আশ্রিয়ে ছিলেন, সেই ছয়টা দিন তারা শুধু কান্নাকাটিই করেছেন। তখনও তারা বিশ্বাস করতেন, বঙ্গবন্ধু ছাড়া পরিবারের বাকী সবাই বেঁচে আছেন। জার্মানী থেকে তারা ভারতে চলে গিয়েছিলেন, সেখানে গিয়েই খবর পেয়েছিলেন, পরিবারের একজন সদস্যকেও ছাড়েনি হায়েনারা, এমনকি ছোট্ট শেখ রাসেলকেও না!

জার্মানী থেকে বিদায়ের সময় হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শেখ হাসিনাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন- ‘যাও মা তুমি একদিন বাংলাদেশের ইন্দিরা গান্ধী হবে।’ হূমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কথাটা কেমন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে! শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন, আওয়ামীলীগের হাল ধরেছেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও। বিভীষিকাময় এক কালরাতে পরিবারের সবাইকে হুট করে হারিয়ে ফেলা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা স্বজন হারানোর শোক কাটিয়ে উঠেছেন, সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে গিয়েছেন দুর্বার গতিতে।- বাংলাট্রিবিউন

SUMMARY

1615-1.jpg