আগস্ট মাসটি সত্যিকার অর্থে বাঙালি জাতি বা বাংলাদেশীদের জন্য শোকের মাস। কারণ এই মাসেই বাঙালির স্বকীয়তার ধারক ও বাহক তিনজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বাঙালি জাতির জনক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। প্রথমোক্ত দু’জন প্রকৃতির নিয়মে পরপারে পাড়ি জমালেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল। এছাড়াও ২০০৪ সালে ২১ শে আগস্ট বঙ্গবন্ধুরই কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট দেশব্যাপী ৪১৭টি স্পটে সিরিজ বোমা হামলা- এগুলোই বুঝিয়ে দেয় আগস্ট মাস সত্যিকার অর্থে বাঙালিদের জন্য শোকের মাস। এ মাসেই পাক হায়নাদের অনুসারী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দানবীয় রূপ ধারণ করে আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করার জন্য।
কারণ এই আগস্ট মাসটি হচ্ছে তাদের পূর্বসূরি পাকিস্তানীদের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মাস এবং যেহেতু বাংলাদেশ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেহেতু পাকিরা তাদের ক্ষতস্থানে মলম লাগানোর মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে এই মাসটিকে বার বার বেছে নেয়।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ইংরেজি, দিনটি ছিল আমাদের জাতীয় চেতনার এক ভয়ানক-বীভৎস, হৃদয়বিদারক, ধ্বংসমুহুর্ত। এই দিনটিতেই বঙ্গবন্ধু তার দুই কন্যা সন্তান ব্যতিত সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। এই নিদারুণ ভয়াল কালো রাতে হায়েনাদের মর্মন্তুদ নির্মমতা থেকে রেহাই পায়নি নিষ্পাপ শিশুপুত্র রাসেল, দুই পুত্রবধূ, শেখ মনির অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী এবং আত্মীয়স্বজন সহ নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা।
বাঙালির জাতীয় জীবনের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে স্বাধীনতা। আর এই পরম আরাধ্য স্বাধীনতাকে যিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন, যিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মানুষকে আকর্ষণ করতে পারতেন, যিনি মানুষকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসতেন, মানুষের ভালবাসাও পেয়েছিলেন- তিনি হচ্ছেন বাঙালির প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসন হতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বাঙালিরা মুক্ত হতে না হতেই করাচি ভিত্তিক নব্য উপনিবেশিক শাসনের উত্থান শুরু, আর সেই থেকেই সংগ্রাম শুরু শেখ মুজিবের। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন এবং সেখান থেকেই মূলত বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের শুরু। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা” এটা যে শুধু কথার কথা ছিল না, তা তিনি সারা জীবনে ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন সংগ্রাম, কর্ম ও নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দুইবার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল- প্রথমবার বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে আটক ছিলেন। দ্বিতীয়বার- মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় তিনি যখন পাকিস্তানী কারাগারে বন্দি ছিলেন। যে কাজটি পাকিস্তানী হায়েনারা করতে পারেনি, সেই কাজটি করলো পাকি চেতনা ধারণকারী, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত গোষ্ঠী। যাদের ধমনীতে তথাকথিত বাঙালির রক্ত বহমান ছিল। জাতি হিসেবে যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার, ঘৃণার ও কষ্টের। যে মানুষটি তার জীবন-যৌবন, সুখ-শান্তি, ব্যক্তিগত স্বপ্ন, স্বাদ- আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন; অথচ এদেশেই জন্ম নেওয়া কিছু কুলাঙ্গার সপরিবারে জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যা করে।
জাতির জনকের হত্যার ঘটনাকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হিসেবে অভিহিত করতে অন্তত আমি রাজি নই। রাজি না হওয়ার অন্যতম দুইটা কারণ হলো-
প্রথমত- পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণকারী ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্বকারী দল আওয়ামীলীগের বিপক্ষে ২৮% ভোট পড়েছিল। পক্ষান্তরে এই ২৫% ভোট পাকিস্তানী চেতনাকে লালন করে, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধী। এই পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী কখনো আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারে নি এবং বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি যেই করে হোক স্বপ্নের সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়বেনই; যা ছিল তাদের চোখের বিষফোঁড়া। এরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তা বাস্তবায়ন করে।
দ্বিতীয়ত- ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধান। এই লাইনটি পড়ে হয়তো অনেকে বিস্মিত হবেন ! কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে উক্ত সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে - “পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’’ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ছিন্ন হওয়া একটা দেশ, যারা সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃত, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সহকারে জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে, আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত; এরকম একটি দেশকে যখন পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে অভিহিত করে, তার নাগরিকদের বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হলে ফেডারেশনের মর্যাদাপ্রাপ্তির কথা বলে, তখন আর এর মর্ম অনুধাবন করতে খুব বড় মাপের দার্শনিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পাকিস্তান তাদের মনের সুপ্ত বাসনাকে প্রতিভাত করতে গিয়েই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিপক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল, তাদের কে ব্যবহার করে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, এটা কোন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিলো না, এটা ছিল স্বার্থান্বেষী কতিপয় গোষ্ঠীর জিঘাংসা চরিতার্থ করার এক জঘন্য হিংস্র প্রক্রিয়া। তা না হলে ছোট রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে কেন, ৪ বছরের শিশু সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু ঢাকায় দাদার বাসায় বেড়াতে এসে নির্মম হত্যার শিকার হবে কেন ? বেবী সেরনিয়াবাত যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, তাকেইবা কোন মরতে হলো, শেখ কামাল ও শেখ জামালের নবপরিণীতা স্ত্রী, যাদের হাতের মেহেদীর দাগ শুকায়নি তাদেরকে এভাবে জীবন দিতে হলো কেন ?
আমাদের স্বাধীনতার শত্রু ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসররা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েও পরাজয় মেনে নিতে পারেনি, তারাই প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিল। আন্তর্জাতিক যে চক্রটি ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের অনুঘটক তাদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীদের সৌহার্দ্য আজও বিদ্যমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালো রাতে অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ফারুক, যাতে তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। ১৫ই আগস্ট রাতে মেজর ফারুক অফিসারদের নির্দেশ দেয় বিমানবন্দরের কাছে হেডকোয়ার্টারের স্কোয়াড্রন অফিসে সমবেত হওয়ার এবং অফিসারদের অপারেশনের পরিকল্পনা জানায়।
১৪ই আগস্টের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর টু ফিল্ড রেজিমেন্টে সাজোঁয়া যানগুলো সচল হয়ে উঠে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০৫ এমএম কামানগুলোকে ভারি ট্রাক দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় নিয়মিত নৈশকালীন প্রশিক্ষণের জন্য রাত ১০টার দিকে সেনানিবাসের উত্তর প্রান্ত থেকে বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো ইউনিট থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং এয়ারপোর্টে ১৮টি কামান এবং ২৮টি ট্যাংক জড়ো হয়।
রাত ১১.৩০ ঘটিকার সময় মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ প্রমুখ সেখানে জড়ো হন। সিদ্ধান্ত হয় তারা ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোড, সোবহানবাগ মসজিদ এবং ৩২ নম্বর ব্রিজের রোড ব্লক করবে। প্রধান টার্গেট বঙ্গবন্ধুর বাসা আক্রমণের সাথে সাথে ধানমণ্ডিতেই শেখ ফজলুল হক মনি এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মেজর মহিউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের জন্য ১২টি ট্রাকে ৩৫০ জন সাধারণ সৈনিককে তৈরি করা হয় এবং ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর বাসা আক্রমণের সময় উপস্থিত থাকার অনুরোধ করা হলে তিনি পূর্ব সম্পর্কের অজুহাতে সেখানে উপস্থিত না থেকে স্বেচ্ছায় সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণের দায়িত্ব নেন। শেখ মণির বাসার আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া দুই প্লাটুন সৈন্য সহ রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে। ২৮টি ট্যাংক নিয়ে শেরে বাংলা নগরে রক্ষী বাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব নেন মেজর ফারুক। মেজর রশিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সমন্বয় করার। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবাইকে তাজা বুলেট ইস্যু করা হয়। ঘাতকের দল মেজর ফারুকের নেতৃত্বে ২৮টি ট্যাংক নিয়ে ভোররাত ৪টার দিকে বনানীর এমপি চেক পোস্ট হয়ে ধানমণ্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে ফজরের আজান পড়ে।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা বিউগল বাজিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শুরু করা মাত্রই বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে মানবরূপী নরপশুরা।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কিছু মুক্তিযোদ্ধাও জড়িত। আসলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তারা সবাই ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসকে প্রতিহত করার জন্য সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি বিজয় দিবসে হরতালের ডাক দিয়েছিল; মাওলানা ভাসানীসহ অনেক রথী-মহারথীরা সেদিন সর্বহারা পার্টির হরতালকে সমর্থন করেছিলেন। এসব বর্ণচোরা মহারথীরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে গিয়ে এবং এটাকে বৈধতা দানের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধুর বাকশালকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। যা একটি বাজে অজুহাত মাত্র। বাকশালই যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যার একমাত্র কারণ হয় তবে বাকশাল প্রবর্তনের পূর্বেই কেন আওয়ামীলীগের ৮জন সংসদ সদস্যকে খুন হতে হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৭২ সালে ২৯জন, ৭৩ সালে ৭৭ জন, ৭৪ সালে ৫২ জন এবং ৭৫ সালে ৪৪ জন আওয়ামী দলীয় প্রতিনিধি, ছাত্রনেতা, শ্রমিক নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে কেন নির্মমভাবে খুন হতে হয়েছিল। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এ ব্যাপারে কোন এক অজানা কারণে আওয়ামীলীগ নেতারা নীরব থাকেন !
১৫ই আগস্ট জাতীর পিতাকে হত্যার অব্যবহিত পরই খন্দকার মোশতাক শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ১৯৭২ সালে সংবিধানের বুকে ছুরি মেরে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। জুলফিকার আলী ভুট্টো মোশতাককে স্বীকৃতি দেন এবং ‘বাংলাদেশী মুসলিম ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল এবং ১৫ মিলিয়ন গজ কাপড় পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ রোজ শুক্রবার; খন্দকার মোশতাক ঘোষিত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ÔThe Bangladesh gazette, published by authority' লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক আহমদের স্বাক্ষর রয়েছে। অধ্যাদেশটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে - ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ভাগে- রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে যাদের মূল্যায়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করেই ৫ম সংবিধান সংশোধনী বিল ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পাশের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সহ ৪ বছরের সামরিক আইনের আওতায় জারি করা সব অধ্যাদেশ ও ঘোষণাকে বৈধতা দান করেন। এর পূর্বে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ৮/৬/১৯৭৬ সালের বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরী প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করেন-
১। কর্নেল শরীফুল হক ডালিম: প্রথম সচিব, চীন।
২। লে: কর্নেল আজিজ পাশা: প্রথম সচিব, আর্জেন্টিনা।
৩। মেজর মহিউদ্দিন : দ্বিতীয় সচিব, আলজেরিয়া।
৪। মেজর শাহরিয়ার রশীদ: দ্বিতীয় সচিব, ইন্দোনেশিয়া।
৫। মেজর বজলুল হুদা: দ্বিতীয় সচিব, পাকিস্তান।
৬। মেজর নুর চৌধুরী : দ্বিতীয় সচিব, সৌদি আরব।
৭। মেজর শরিফুল হোসেন: দ্বিতীয় সচিব, কুয়েত।
৮। ক্যাপ্টেন কিসমত হাসেম: দ্বিতীয় সচিব, আবুধাবি।
৯। লে: খায়রুজ্জামান: তৃতীয় সচিব, মিশর।
১০। লে: আব্দুল মাজেদ : তৃতীয় সচিব, সেনেগাল।
১১। লে: নাজমুল হোসেন: তৃতীয় সচিব, কানাডা।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জয়লাভ করলে ২৩জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সংসদে পাশ হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণ আইনে পরিণত হয়। এর ফলে মোশতাকের জারি করা এবং জিয়াউর রহমানের বৈধতা দেওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত হয়। যার ফলে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী সকল বাঁধা দূর হয়। আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে এবং বিচারের রায়ও কার্যকর করা হয়েছে।
দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে যদি হত্যা করা না হতো এবং আমরা যদি আরো দীর্ঘকাল তাঁর নেতৃত্ব পেতাম, তবে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই নয় ; সারা বিশ্বের কাছে হতো সমৃদ্ধ অর্থনীতির রোল মডেল। বঙ্গবন্ধু তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- ‘এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।’ জাতির জনক তাঁর কথা রেখেছেন, আমরা কি জনকের কথা রেখেছি, আমরা কি তাঁর স্বপ্নের সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পেরেছি ?
মো. মজিদুর রহমান : সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সম্পাদক, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগ।